জিজ্ঞাসু : অদ্ভুত ব্যাপার, সত্যিই কি এ রকমও হয় ! আপনি আর একটা কি ঘটনার কথা বলছিলেন, সেটা যদি বলেন !

গুরুমহারাজ : দ্যাখো, এ রকম ঘটনা আমার জীবনে অনেকবার ঘটেছে, কিন্তু আমি তোমাদের কাছে সেগুলোই উল্লেখ করতে চাইছি, যেগুলোর সাক্ষী রয়েছে। যেমন শম্ভুপুরের ঘটনায় যারা লাঠি হাতে ওখানে উপস্থিত ছিল, ওদের অনেকেই এখন আমার দীক্ষিত। দেবু সেনের পরিবার বা অন্য দু-চারটে ভক্ত-পরিবার ওখানে আমাকে নিয়ে যায় বা অন্যান্য মহারাজরাও যায় বিভিন্ন কাজে, ওরা সাহায্যও করে।
আর যে ঘটনাটি বলছি—এ ঘটনারও সাক্ষী আছে। তাছাড়া এই ঘটনাটির সঙ্গে আমার চাকরি ছাড়ার একটা যোগাযোগ রয়েছে। যাইহোক ঘটনাটি বলছি শোন। আমাদের তখন রায়না থেকে বাঁকুড়ার দিকে এক জায়গায় Camp হয়েছে। তখন Emergency Period, ওখানকার চাষীদের বিদ্যুতের অভাবে বোরোধান মারা যাচ্ছে, ফলে শত শত লোকে সরকারী দপ্তরে ধরণা, ঘেরাও এসব করে এমন Order বের করেছে যে, সাতদিনের মধ্যে ঐ বিস্তীর্ণ এলাকায় Electrification-এর কাজ তুলে দিতে হবে, নাহলে D. E, A. E—সবার চাকরি নিয়ে টানাটানি।

আমাদের দলকে ওখানে পাঠানো হ’ল কাজ তুলে দেবার জন্য, হাতে সময় মাত্র সাত দিন। আমার দলের ছেলেরা আমাকে খুবই ভালোবাসত, আমি যদি ওদের বলি তো রাতদিন খেটে ওরা কাজটা পাঁচ দিনেই তুলে দেবে ! কারণ কাজতো হাতের—ইচ্ছা করলেই করা যায়। মানুষের কাজের প্রতি নিষ্ঠা বা শ্রদ্ধার অভাব থাকে বলেই কাজে ফাঁকি মারে বা কাজ করতে চায় না। যাইহোক পুরোদমে কাজ চলছে আর A. E অর্থাৎ এ্যাসিট্যান্ট ইঞ্জিনীয়ার সদা- সর্বদা কাজের মাথায় মোতায়েন থাকছে কারণ ওরই ওটা এলাকা। ওর উপর ঊর্ধ্বতন অফিসারদের এমন চাপ রয়েছে যে, ও রাতেও ক্যাম্পে থাকতো। সেইসময় ইমার্জেন্সী পিরিয়ড তো, তখন একটু বেচাল হ’লেই অফিসারদের চাকরি চলে যেত। যাইহোক দ্রুত কাজ চলছে—কাজ এগোচ্ছেও বেশ, আমার মনে কাজটা শেষ করার ব্যাপারে আর কোন টেনশন ছিল না। তাই ভাবলাম—গর্ভধারিণী জননীর কাছে অনেকদিন যাইনি, আর সে মাসের টাকাটাও দেওয়া হয়নি, ফলে যাই একবার কৃষ্ণদেবপুর থেকে ঘুরে আসি। আবার মনে হতে লাগল চক্ষণজাদীর টগরের বাবা সাত্তার সাহেবকে কথা দেওয়া আছে তার মৃত্যুর সময় যেন আমি উপস্থিত থাকি, ফলে সেখানে যাওয়াটাও খুব প্রয়োজন। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ইঞ্জিনীয়ার সাহেবকে বললাম যে, ‘কাল সকালে আমাকে একবার বাড়ী যেতে হবে, তবে তাড়াতাড়িই ফিরবো। আর আমি আমার ছেলেদের বলে যাচ্ছি- আপনার কাজের যেন কোন অসুবিধা না হয়।’ ইঞ্জিনীয়ার, ওভারসীয়র এসব যারা ছিল- —তারা একথা শুনেই একেবারে লাফিয়ে উঠল, বলল ‘রবীনবাবু আপনি না থাকলে কোন কাজই হবে না, আমাদের চাকরি চলে যাবে, আপনাকে কিছু করতে হবে না, শুধু আপনি বসে থাকুন, এখানে যতদিন না কাজ শেষ হয় ! তারপর কাজ শেষ হলে আপনি একদিন কেন দশদিনের জন্য বাড়ী যান, কিছু বলবো না।’ আমি যত তাদের বোঝাবার চেষ্টা করি, তারা নাছোড়বান্দা, কোনমতেই আমার সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টাই করলো না। এই ঘটনায় মনটা ভীষণভাবে দুঃখিত হয়ে গেল। মনে হোল এরই নাম চাকরি – পরের গোলামি খাটা ! আমি চির মুক্ত, চির স্বাধীন আর চাকরি করতে এসে এই বন্ধন দশায় আটকে পড়লাম। চাকরিজীবনের উপর ঘৃণা এসে গেল, মনে হ’ল এই কাজটা শেষ হয়ে গেলেই মায়ের অনুমতি নিয়ে চাকরি ছেড়ে দেব। এইসব ভাবতে ভাবতে চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে ওদের কাছ থেকে একটু দূরে একটা আমগাছের শীতল ছায়ায় বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি সামনে গুরুদেব স্বামী বাউলানন্দজী, তিনি আমাকে উপরে উঠার জন্য ইঙ্গিত করতেই—আর আমার কিছু খেয়াল নেই, এরপর ঘটনাপ্রবাহ যে কি ঘটেছে তা জানি না। তৃষাণ সবই জেনেছিল কিন্তু প্রথমটায় আমাকে বলেনি, ও পরীক্ষা করতে চেয়েছিল—আমি এটা ইচ্ছা করে ঘটিয়েছি না মা জগদম্বার ইচ্ছায় হয়েছে—ইত্যাদি। ঘটনাটা যখন ঘটছে তখন ঘড়িতে সকাল ১০টা ১০ মিঃ। তৃষাণ তখন কালনা-বর্ধমান রুটের উপর সাতগাছিয়া স্টপেজে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ ও দেখল আমি একটা বাস থেকে নামলাম এবং ওর সাথে কিছু কথাবার্তা বলার পর একটা দোকানে দু’জনে জলখাবার খেলাম। এরপর আমি ওকে টগরের বাবা বর্ধমানের যে নার্সিংহোমে ভর্তি আছে তা জানালাম আর ওকে কিছু টাকা দিয়ে টগরের বাবা মারা গেলে কি করতে হবে তার নির্দেশ দিয়ে এবং শনিবারে তার সঙ্গে যে দেখা হচ্ছে তা জানিয়ে—অন্য একটা বাসে চেপে বিশেষ কাজ আছে বলে চলে গেলাম ।

আবার বর্ধমানে নার্সিংহোমে টগরের বাবার তখন শেষ অবস্থা। ঠিক ঐ দশটা দশ মিনিটেই আমি সাত্তার সাহেবের শেষ শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে ওনার সাথে কথা বলেছি, টগরের মা এবং টগরসহ বাকীদের মনে জোর আনার জন্য সাহস দিয়েছি, আর এও বলেছি যে, তৃষাণ আসবে, চিন্তার কোন কারণ নেই—ওনার ব্যবস্থা করে দেবে। তারপর টগরকে পাশের হোটেলে নিয়ে গিয়ে ভালো করে খাইয়েছি, কারণ বাবা মারা গেলে হয়তো আর খেতে পাবে না। তারপর ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে, ‘ভীষণ কাজের চাপ, অতএব শনিবার দেখা হবে’ একথা জানিয়ে চলে গিয়েছি।

আমার আর একটা শরীর ঠিক ঐ সময়েই অর্থাৎ দশটা দশ মিনিটেই কৃষ্ণদেবপুরে আমার মায়ের কাছে প্রকট হয়েছিল। সেই শরীরটা মাকে প্রণাম করে মাকে দেয় অর্থ দিয়েছে, মায়ের কাছে বসে জলখাবার খেয়েছে, তারপর ভীষণ ব্যস্ত অতএব শনি/রবিবার আবার আসবে বলে বিদায় নিয়েছে। অর্থাৎ সেই মুহূর্তে মূল শরীরসহ চারটে আমার শরীর একই সময়ে চার জায়গায় প্রকাশমান ছিল।

আমার মূল শরীরটা তো মাঠে আমগাছতলায় বসে বিশ্রামরত অবস্থায় ছিল। এদিকে যে এত কাণ্ড ঘটে গেছে তাতো আমি জানি না ! কিন্তু যখন আমার ঐ অবস্থাটা কাটল তখন যেন আমার মনে হল যে, আমার শরীর অনেকটা ফ্রেস হয়েছে এবং আমার মনের মধ্যে যে চাপ ছিল, সেটাও আর একদম নেই। যাইহোক, শুক্রবার পর্যন্ত অর্থাৎ আরও ২/৩ দিন পর্যন্ত কাজটা চলেছিল। তারপর যথারীতি শনিবার সকালেই তৃষাণ গিয়ে হাজির। ও গিয়ে খবর দিল যে, টগরের বাবার মৃত্যু হয়েছে। শুনেই আমি বললাম, ‘চল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি, একবার টগরদের বাড়ী যাওয়া দরকার।’ ও তখনও আমাকে ঘটনাগুলো বলেনি। তৃষাণ তো ঐ ঘটনার দিন আমার কাছে টগরের বাবার অন্তিম অবস্থার কথা শুনেই বর্ধমানে নার্সিংহোমে চলে গিয়েছিল। ওখানে টগররা বলেছে যে, ‘রবীনদা কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ওদের সঙ্গে কাটিয়েছে।’ একথা শুনে প্রথমটাই মৃদু প্রতিবাদ করেছিল। তারপর যখন টগরের মাও ব্যাপারটার সত্যতার কথা বলে, তখন তৃষাণ চুপ করে যায়। এদিকে তো টগরের বাবা মারা যাওয়ায় সেদিকেই সবাই ব্যস্ত, এই ব্যাপারটায় আর কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। তৃষাণ বুদ্ধিমান ছেলে, ওর মনে কিন্তু একটা ধন্দ রয়েই গিয়েছিল যে, এর মধ্যে রহস্য কিছু একটা আছে ! এবার ও যখন শনিবার ক্যাম্পে এল এবং আমি যখন বললাম যে, ‘টগরের বাবা মারা গেল – দ্যাখো দেখি ওনার মৃত্যুকালে আমার থাকার কথা ছিল, তা আর হল না । তখনও তৃষাণ চুপ ছিল, কিছু বলেনি। তারপর চক্ষণজাদী পৌঁছে প্রাথমিক শোকপর্ব সামাল দেবার পর সেদিনের ঘটনার কথা উঠল। বর্ধমানে আমার উপস্থিতির কথা তুলে টগরের মা বলতে লাগলেন, বাপী, তোর উপস্থিতির জন্যই টগরের বাবার মৃত্যুকালেও আনন্দ হয়েছিল আর আমরাও মনে জোর পেয়েছিলাম এবং তুই ভাগ্যিস্ তৃষাণকে পাঠিয়েছিলি – নাহলে কি যে হত’—ইত্যাদি সব কথা।
আমি এসব শুনে অবাক হয়ে তৃষাণের দিকে তাকাতেই তৃষাণ হেসে আমাকে ইঙ্গিতে চুপ করতে বলল। পরে ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা কৃষ্ণদেবপুরের দিকে রওনা হলাম। পথে যেতে যেতে তৃষাণ আমাকে ঘটনাগুলো বলল। এর পর কৃষ্ণদেবপুরে পৌঁছে আর এক বিস্ময়! মাকে প্রণাম করে টাকা দিতেই মা বলে উঠল, ‘কিসের টাকা রে ! এইতো ৩/৪ দিন আগে এসে টাকা দিয়ে গেলি !”

যাইহোক এইরকম ঘটনা পরেও ঘটেছে, এখন আমি বুঝতে পারি যে, মা জগদম্বা বর্তমানে এই পরমানন্দরূপ শরীরটাকে নিয়ে নানান খেলা খেলছেন। তবু ঐ যে ঘটনা দুটোর কথা উল্লেখ করলাম, ওগুলোর কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কিন্তু আমি আজ পর্যন্ত পাইনি। পরবর্তীকালে আমার সন্ন্যাসের পর ব্রহ্মজ্ঞপুরুষ গুরুদেব স্বামী রামানন্দ অবধূতজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এইসব ঘটনাগুলি ঘটার পিছনে কারণ কি ?’ উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ব্রহ্ম কা অনন্ত মহিমা হোতি হ্যায় বেটা ! ইয়েভী এক মহিমা থী। লেকিন ইয়ে সব ঘটনাহী মায়া হ্যায়, কেবল ব্রহ্মহী সত্য।’ (ব্রহ্মের অনন্ত মহিমা বেটা ! এটাও তাঁর একটা মহিমা। কিন্তু জানবে সমস্ত ঘটনাটাই মায়া—কেবল ব্ৰহ্মই সত্য।)
আবার জান তো ঐ ঘটনাগুলোর কারণ সম্পর্কে কোন ভগবৎ ভক্তের কাছে জানতে চাইলে, তিনি উত্তরে বলবেন— ‘ওগুলি ভগবানের লীলা।’ আর কোন যোগীর কাছে ঐ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তিনি হয়ত বলবেন, ‘ওগুলি পরমেশ্বরের যোগ-বিভূতি।’ তা অনেকে ঐ সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলতে পারেন, কিন্তু আমি তো জানি—ঐ ঘটনাগুলোর আজ পর্যন্ত কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না !