জিজ্ঞাসু : গুরুমহারাজ, ভাবতে অবাক লাগছে—আজকের আপনি, যে এত smart, গোটা দুনিয়ায় এমন মানুষ পাওয়া ভার, সেই আপনি ছোটবেলায় এতটাই হাবাগোবা ছিলেন যে, পাড়ার ছেলেরা আপনাকে কাজে লাগাতো ?

গুরুমহারাজ : হ্যারে সত্যি, এরকমই ছিলাম। তবে এর কারণ যদি জানতে চাস, তাহলে বলব—সেটা অত্যন্ত গভীর।
শিশু অবস্থায় মানুষ সবচেয়ে অসহায় জানিস্ । কারণ সে নিজের ইচ্ছায় শুধু হাত পা-টাই ছুঁড়তে পারে আর কাঁদতে-হাসতে ও পায়খানা-প্রস্রাব করতে পারে আর কিছুই করতে পারে না। আমার শিশু অবস্থাতেও পূর্ণজ্ঞান ছিল, ফলে ভাব, আমার অবস্থাটা ! আমি জানি ; আমি কে, কিজন্য এসেছি, কি কাজ আমার অথচ সময়ের প্রতীক্ষা আর পঞ্চভূতের ফাঁদে বা মহাপ্রকৃতির নিগড়ে বাঁধা অবস্থায় অসহায়ভাবে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা । শিশু অবস্থায় শিশু সবকিছুকেই উল্টো দেখে জানিস্ তো ।

বাড়ী-ঘর, গাছপালা, মায়ের মুখ—সব উল্টো মনে হয়, মনে হয় ঝুলন্ত। দারুণ অসহায় বোধ করে শিশু। একমাত্র মা যখন কোলে নেয় তখনই শিশু হয় নিশ্চিন্ত। তাই যেদিন আমি প্রথম উপুড় হতে পারলাম, সেদিন আমার জীবনের যেন প্রথম কৃতকার্যতা—সে কি আনন্দ আমার হয়েছিল । প্রতি মুহূর্তেই মনে হয়েছিল—আজ আমি এই প্রথম নিজে নতুন কিছু করেছি।

যাইহোক, যখন আমি একদম শিশু, উপুড় হতেও পারিনি তখন শায়িত অবস্থায় আমি আকাশ, ঘর-বাড়ী দেখতাম আর তখন থেকেই সেগুলোকেই বিশ্লেষণ করতাম। তাহলে বুঝতে পারছিস্ পঞ্চমহাভূতের বিশ্লেষণ শুরু হয়েছিল আমার অতি শৈশবে।

বস্তুবিজ্ঞান–ঋষি কণাদের বস্তুবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ এবং বিচার শুরু হয়েছিল তখন থেকেই এবং সিদ্ধান্তও দ্রুত সঞ্চয় হচ্ছিল।
এরপর যখন থেকে বাবা, মা, দাদা-দিদিদের দেখতে বা চিনতে শুরু করলাম, তখন থেকেই শুরু হল জীবন বিশ্লেষণ।

বস্তুবিশ্লেষণের শেষে দেখলাম, তার অভ্যন্তরে রয়েছে শক্তি। এবার সংঘাত শুরু হল শক্তি আর প্রাণের মধ্যে। পৃথিবীগ্রহে কোন সময় ঠিক এই সিদ্ধান্ত নিয়েই বিরোধ হয়েছিল ঋষি কণাদের followers এবং ন্যায়দর্শনপ্রণেতা ঋষি গৌতমের followers-দের মধ্যে। এই বিরোধ চলল কিছুকাল। এরপর আমার মধ্য থেকেই কপিল মুনির আবির্ভাব হল। উনি বললেন, ‘ঠিক আছে বস্তু র অভ্যন্তরে রয়েছে শক্তি আর জীবনের অভ্যন্তরে রয়েছে প্রাণ, এর কোনটি আদি, কোনটি শ্রেষ্ঠ এ নিয়ে বিতর্ক করলে হাজার বছর কেটে গেলেও কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারবে না। বিতর্ক রেখে বোঝ, এই যে শক্তি অথবা প্রাণ, এগুলি কোনটা কি—এসব বিচার করছো কি দিয়ে, মন দিয়ে তো ? অতএব তোমার মনকে অধ্যয়ন কর, ‘Read your mind’। তখন থেকেই আমার মন-অধ্যয়ন শুরু হল। দিদি গান গাইত, “মন নিয়ে কি মরব নাকি শেষে”। আমি মনের অন্ধি-সন্ধি analysis করতে শুরু করলাম। মনকে সম্পূর্ণ আয়ত্তে আনতে আমার বেশী সময় লাগেনি। এরপর মনকে বিশ্বমনের সঙ্গে যোগ করে যেখানকার মন সেখানে ফিরিয়ে দিলাম। সেই একটা গান শুনেছিলাম, “পিঞ্জর খুলে দিয়েছি, যা কিছু কথা ছিল বলে দিয়েছি- – যা রে যাবি চলে যা, যা রে… কথা নয়।” বুঝলাম কোন বাউলের গান, জীবনের বোধ থেকে উঠে আসা কথা। আমিও তখন মনকে দেহের পিঞ্জর থেকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছিলাম। এভাবেই তখন থেকে আমি বহির্মুখীনতা ত্যাগ করে অন্তর্মুখী হতে শুরু করলাম। তবে প্রাচীনকালেও ঠিক এমনিই হয়েছিল —ভগবান কপিল মুনির আবির্ভাবের পর বস্তুবাদী বা জড়বাদীদের সাথে ন্যায়বাদীদের বিবাদ মিটে গিয়েছিল। আর আজও বিবাদ- বিতর্ক মেটে অন্তর্মুখী হলেই।

মা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে বলেছিলেন – ভাবমুখে থাকতে। তিনি সেভাবেই ছিলেন। কিন্তু আমি দেখেছি বস্তুবিচার আর ভাববিচার একই। একটাকে ঠিকমতো বিশ্লেষণ করলে automatically অপরটায় চলে যাওয়া যায়। অর্থাৎ ঠাকুর বস্তুবিজ্ঞান দিয়েও বেদান্তকে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। যেটা আমি নিজে করে দেখছি, কোন অসুবিধা হয় না আমার। বস্তুবাদীদের আমি বস্তুবিজ্ঞান দিয়েই বোঝাতে পারি আর ভাববাদীদের ভাববিজ্ঞান দিয়ে।

তাহলে ভাব, ঐ ৪/৫ বছর বয়সের মধ্যেই আমার ভিতরে ঐসব সাংঘাতিক খেলা চলছিল। ষড়দর্শন অতিক্রম হচ্ছে তখন, বেদান্ত-দর্শনের উত্তর-মীমাংসা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সমস্ত কিছু বেদান্ত দিয়ে খচাখচ্ কেটে চলেছি ফলে ঐ সময় জাগতিক ব্যাপারসমূহে মাথা ঘামানোর আমার সময় কোথায় ? দেহের ব্যাপারে বা কোন ঘটনায় মনোযোগই ছিল না, শুধু যন্ত্রের মতো দেহটা ছিল, অন্য যে কেউ সেটা দিয়ে কিছু করিয়ে নিতো, আমার তো নিজস্বতা সেখানে কাজ করতো না। আর এই জন্যই লোকে আমাকে হাঁদা ভোঁদা বা ভোম্বল ভাবতো, কেউ ভাবতো কালা। বুঝতে পারলি ব্যাপারটা ?