জিজ্ঞাসু :– আচার্য শংকরের ‘অদ্বৈত মত’-ই কি পৃথিবীর সমস্ত দর্শন শাস্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মত ?
গুরুমহারাজ :– আচার্য শঙ্করের অদ্বৈত তত্ত্ব-কে ‘মত’ বললে !! উনি বোধের জগতের কথা বলেছেন_”সঃ ব্রহ্ম নির্বিশেষঃ”, এইটা প্রতিষ্ঠা করেছেন । কিন্তু তা করলে কি হবে__পণ্ডিতেরা তো তার কথার ভুল ব্যাখ্যা করেছে ! শংকর বলেছিলেন – “শ্লোকার্ধেন প্রবক্ষামি ……– ‘ব্রহ্ম সত্যং জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মৈব নাপরঃ’। ” পরবর্তীতে ব্যাখাকার পণ্ডিতেরা ওনার ব্যবহৃত ‘মিথ্যা’ শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা করেছে। এখানে ‘মিথ্যা’ মানে অসত্য নয়,–’মিথ্যা’ অর্থে অনিতা। জগতের সবকিছু ‘অসত্য’– কি করে হবে ? সত্য থেকে সত্যই আসে, সত্যই সৃষ্টি হয়। পুর্ণ থেকে পুর্ণ‌ই আসে ! সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ শঙ্করের অনেক আগেই বলেছেন, ” পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমদুচ্চতে, পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে৷”– উহাও পূর্ণ, ইহাও পূর্ণ । পূর্ণ থেকে পূর্ণ-ই আসে, পূর্ণ থেকে পূর্ণ বাদ দিলে পূর্ণ-ই অবশিষ্ট থাকে।৷
উপনিষদ বলেছে_ সত্য‌ই ব্রহ্ম । ব্রহ্ম যদি সত্য হয়__তাহলে জগৎ সত্য, জীবন সত্য, মৃত্যু সত্য। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন – ব্রহ্মও সত্য – লীলাও সত্য। জীবন মিথ্যা – জগৎ মিথ্যা হোলে সেই ‘জীবন’ দিয়ে সত্যের বোধ কি করে হবে ? অপূর্ণ কি করে পারে পূর্ণের বোধ করতে ?
বলা হোচ্ছে বোধের অন্তরায় ‘মায়া’। ‘মায়া’– কি ? এটা যেন ‘বন্ধ্যাপুত্র’ অথবা ‘শশশৃঙ্গ’ – অর্থাৎ একটা self-contradictory শব্দ। বন্ধ্যার পুত্র হোলে সে তো আর বন্ধ্যা থাকছে না। দ্যাখো – বন্ধ্যা সত্য, পুত্র‌ও সত্য কিন্তু ‘বন্ধ্যাপুত্র’ শব্দভ্রম ! তেমনই অপর একটি শব্দ __ শশশৃঙ্গ, শশকের শৃঙ্গ থাকলে তো_ সে আর শশক থাকছে না। ‘মায়া’কে মরীচিকা-র সাথে তুলনা করা হয়েছে শাস্ত্রে। এখানে মরু সত্য, জলাশয় সত্য, কিন্তু মরীচিকা ভ্রম যা শব্দজাল মাত্র!
দ্যাখো, এই জগৎ সত্য – জীবন সত্য – কিন্তু দৃষ্টিভ্রম, বুদ্ধিভ্রম ইত্যাদি নানান ভ্রমবশতঃ __ সবই ভ্রমে পর্যবসিত হোচ্ছে। যা দেখা হোচ্ছে – সেটা ঠিক নয়, যা ভাবা হোচ্ছে__ সেটাও ঠিক নয় ! আবার অপরদিকে দেখা যাচ্ছে__যা নাই, তাকেই দেখা হোচ্ছে বা আছে ধরে নিয়ে বোঝার চেষ্টা হোচ্ছে – এটাই ভ্রান্তি বা ‘মায়া’৷ এটাকে বোঝাতে গিয়েই পণ্ডিতেরা ‘মিথ্যা’_এই শব্দটি ব্যবহার করেছে । আর তাতেই তোমার আমার মতো সাধারণ মানুষ ভুল বুঝছে_ভুল করছে।৷
বুঝতে পারলে কি ব্যাপারটা ! আচার্য শংকর ছিলেন বোধি ব্যক্তি। তিনি যুগ প্রয়োজনে শরীর ধারণ করেছিলেন এবং উপনিষদের মূল সত্য থেকে সরে যাওয়া এবং নানাভাবে বিভক্ত হয়ে যাওয়া তৎকালীন পন্ডিতদেরকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। মহাপুরুষগণ এটাই করেন। তাঁরা কখনোই ফলের আশা করেন না। তাঁরা জানেন যে, এই জগত ‘য্যায়সা কি ত্যায়সা’ ! আমার গুরুদেব রামানন্দ অবধূতজীও বলেছিলেন__”জগ্ ঝুট্ হ্যায়, কুত্তা কি পুছ্ হ্যায়!”