জিজ্ঞাসু :– আপনি বলছিলেন আধ্যাত্মিকতায় কোন short-cut নাই(অর্থাৎ কঠিনভাবে সাধন-ভজন করতেই হবে)। কিন্তু সত্যিই কি নাই ?
গুরুমহারাজ :– আছে ! গুরুবাক্যে ঐকান্তিক নিষ্ঠা এবং অটল বিশ্বাস থাকলে কারো সাধন-ভজন না থাকলেও, শুধু এটার দ্বারাই ঈশ্বর-কৃপা লাভ হয়। প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত __এর ভুরিভুরি নিদর্শন‌ও রয়েছে ! আগে একদিন তোমাদের রামদাস কাঠিয়াবাবার কথা বলেছিলাম_কিভাবে একটা বিপরীত ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁর গুরু কৃপা লাভ হয়েছিল। আজকে আমি বলছি অন্য একজনের কথা – যার সাথে আমার দেখা হয়েছিল বৃন্দাবনে ‘কেলিকদম’ নামে এক স্থানে। __উনি একজন যোগী ছিলেন। একদিন দেখি উনি বালিতে শুকনো কাঠ পুঁতে মন্ত্র বলছেন আর জল ঢালছেন। আমি প্রথমটায় দেখে ভাবছিলাম _’এটা আবার কি ! একেবারে নতুন কোনো সাধনা নাকি ?’ একটু এগিয়ে গিয়ে ওনার সাথে আলাপ করতে চাইলাম – কিন্তু উনি নিজের কাজে এতো ব্যস্ত, আর ওনার সেই কর্মে এতো নিষ্ঠা_যে আমাকে পাত্তা দেবার কোনো রকম চেষ্টাই করলেন না সেই সাধক ! আমি আর কি করি – চুপ করে বসে বসে ওনার ওই অদ্ভুত ক্রিয়া দেখতে লাগলাম। বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ওনার ঐ ‘মরা গাছে জলসেচন’ ক্রিয়া যখন বন্ধ হলো – তখন আলাপ করলাম। একথা-ওকথার পর জিজ্ঞাসা করলাম – “ওটা কি করছিলেন ?” উনি বললেন – “দেখছিলে না – গাছে জল দিচ্ছিলাম!” আমি বললাম – “ওটা তো একটা শুকনো ডাল, ওতে জল ঢেলে কি হবে ? ওতে কি পাতা-ফুল-ফল কখনো ধরবে ?” উনি বললেন – ” ফলের আশা করি না ! আমার গুরুদেব আমাকে এটাই করতে বলেছেন, তাই নিয়মিত করে যাচ্ছি।”
অবাক হবার মতোই ব্যাপার ! এই ব্যক্তি বলে কি !! গুরুর নির্দেশে একটা অসম্ভব কাজ জেনেও__নিষ্টাভরে প্রতিদিন এই কাজটা করে যাচ্ছে !! গুরুবাক্যে এতো নিষ্ঠা !! আমিও মায়ের কাছে ওনার জন্য প্রার্থনা জানালাম। কিছুদিনের মধ্যে আমার উপস্থিতিতেই ওনার ইষ্টদর্শন হয়েছিল৷
তবে বৃন্দাবনে আমার সবচাইতে ভালো লেগেছিল যাদবানন্দকে। স্বামী যাদবানন্দ তার ঘরে মাটির পুতুলের সাথে এমনভাবে কথা বলছিলো যে, মনে হচ্ছিলো ঘরে বোধহয় জীবন্ত কোনো লোক রয়েছে! পরে যখন ওনার সাথে অন্তরঙ্গতা হোলো – তখন দেখলাম যে, সত্যিই ঐ মহাসাধকের মৃন্ময় মূর্তির সাধনাতেই সিদ্ধিলাভ ঘটেছে এবং সবসময়-ই ইষ্টদর্শন হোচ্ছে ! মানসচক্ষে সবসময় উনি স্থূল রাধারানী বা তার সখীদেরকে দেখতেন – আর তাদের সাথে কথা বলতেন। সবসময় দর্শন হোচ্ছে – তাই সবসময়েই অনাবিল আনন্দে রয়েছেন উনি !
এইজন্যেই একটু আগে বলছিলাম যে ভোগ করাটা অর্থাৎ আনন্দের আস্বাদন করাটাও একটা art ! ওটাও একটা নির্দিষ্ট স্থিতির ব্যাপার ! সাধারণ মানুষ কি করে তার সন্ধান পাবে বলো ! যাইহোক, স্বামী যাদবানন্দ যথার্থই প্রেমিক সাধু ছিলেন। ওনার সংস্পর্শে আমি যতদিন ছিলাম –ততদিন আমার মধ্যেও একটা অপার্থিব আনন্দের স্রোত প্রবাহিত হোতো।