জিজ্ঞাসু :– আচ্ছা গুরু মহারাজ__শীতঘুম কি শুধু সাপের-ই হয় ?
গুরুমহারাজ :– না – না, শুধু সাপ কেন – যে কোনো শীতল রক্তের প্রাণীরাই শীতঘুমে যায়। ব্যাঙেদেরও শীতঘুম হয়। আবার গ্রীষ্মঘুম‌ও রয়েছে। অনেক প্রানী-ই রয়েছে, যাদের গ্রীষ্মঘুমে যেতে হয়। তবে শুধু সাপ-ব্যাঙ বা শীতল রক্তের প্রাণীরাই নয়, মেরু প্রদেশে ভল্লুকরাও শীতঘুমে যেতে বাধ্য হয়। মেরু প্রদেশে শীতকালে ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু হয়ে বরফ জমে। বড় বড় গাছও চাপা পড়ে যায়৷ আমি নরওয়ের উত্তর প্রান্তে গিয়ে এসব দেখেছি। তবে মজার ব্যাপার কি জানো – ওখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা আগে থেকে জানতে পারে যে সেইবছর শীতকালে কতটা বরফ জমবে। ওখানে এক ধরনের ছত্রাক আছে যারা গাছে জন্মায়। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এক এক বছর ওই ছত্রাকগুলি গাছের একটি নির্দিষ্ট height পর্যন্ত জন্মায়। আর ওই height দেখেই স্থানীয় অধিবাসীরা বুঝতে পারে_সেই বছরে কতোটা বরফ পড়বে।
যাইহোক, এতোটা উঁচু হয়ে বরফ জমায় অনেক সময় মেরু ভল্লুকরাও চাপা পড়ে যায় – এবং বাধ্য হয়ে বা প্রাকৃতিকভাবেই ওরা hibernation (শীতঘুম)-এ চলে যায়। বেশ কিছুদিন ওরা বরফচাপা অবস্থায় পড়ে থাকে। তারপর যখন বরফ গলতে থাকে, তখন একটু একটু করে ওদের শরীর বাইরে বেরিয়ে আসে৷ এতদিন বরফের নিচে চাপা পড়ে থাকা সত্ত্বেও ওরা বেঁচে থাকে এবং ওদের শরীরও ঠিক থাকে। কিন্তু ওদের শরীরের ভিতরে intestine-এ,চাপা পড়ার আগে যে মল ছিল – সেগুলি শুকিয়ে শক্ত শক্ত কাঠির মতো হয়ে যায়। ফলে, বরফ সড়িয়ে ঝেরেমেরে যখনই সে উঠে দাঁড়ায়__ তখনই তার পেটে প্রচন্ড যন্ত্রণার বোধ হয়। আর ওরা জানে যে, ঐ শুকনো মলগুলি শরীর থেকে তাড়াতাড়ি বের করতে না পারলে হয়তো ওরা মারাই পড়বে। সেইজন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই কাঠির মতো শক্ত পায়খানা বাইরে বের করার জন্য ওই ভল্লুকেরা সচেষ্ট হয়। কি সাংঘাতিক প্রকৃতির balance_দ্যাখো !
জানো, ঐসব অঞ্চলে বিভিন্ন বেরী গাছ বা অন্যান্য গাছ রয়েছে, শীতকালে বরফ পড়তে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে, যাদের সব পাতা ঝরে যায়। কিন্তু যেই বরফ গলতে শুরু করে, অমনি গাছগুলির যতটা অংশ বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকে, ঠিক ততটা অংশে ফুলের কলি বা ফুল ধরতে শুরু হয়ে যায়। সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে গাছগুলি ফুলে ফুলে ভরে যায়।
ওখানকার ভল্লুকেরা hibernation-এ যাবার আগে এই ধরনের কোনো না কোনো গাছের গোড়াকে তার শীতঘুমের স্থান হিসাবে নির্বাচন করে। ফলে ঐসব গাছের গোড়া পর্যন্ত বরফ গলতে গলতে অর্থাৎ ভল্লুকের ঘুম ভাঙার আগে থাকতেই এই গাছগুলির উপরের অংশে ফুল ভর্তি হয়ে যায়।
ঘুম ভাঙতেই ভল্লুক ওই গাছগুলি থেকে মুঠো মুঠো ফুল তুলতে থাকে এবং পাগলের মতো খেতে থাকে। এই ফুলগুলি সাধারণভাবে ওদের খাদ্য নয়, কিন্তু ওই সময় ওদের অন্য কিছু খাবারও থাকে না। তাই হয়তো বাধ্য হয়েই খায়__অথবা পরম্পরাগতভাবে বা জেনেটিকভাবে এরা নিজেদেরকে বাঁচাতেই হোলো এইগুলি খায়। কিন্তু মজাটা এই যে, ওই ফুলগুলি ভীষণ purgative বা বিরেচক। ফলে ঐগুলি খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভল্লুকের diarreha-র মতো পায়খানা হতে থাকে – আর ফটাস্ – ফটাস্ করে ছিটকে ছিটকে ওই কাঠির মতো শক্ত কালো কালো সমস্ত মল তাদের শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এইভাবে ঐসব শক্ত মলগুলি বেরিয়ে যাবার পর ভল্লুকের intestine পরিষ্কার হয়ে যায়।
প্রকৃতিতে এইভাবে কত সুন্দরভাবে অভিযোজন হয়ে চলেছে__সে সবকিছুর খবর রাখা, সাধারণ মানুষের পক্ষে কি কখনোই সম্ভব ?_কখনোই না ! এইরকম আর একটা ঘটনার উল্লেখ করছি শোনো!
বানরের পেট পরিষ্কার হয় বানরলাঠি গাছের ফল খেয়ে। এই গাছের ফলগুলো লাঠির মতো লম্বা লম্বা হয়ে ঝোলে। ঐ শক্ত ফলগুলিকে ফাটালে যে বীচিগুলো থাকে ওগুলো খেতে একটু টক-মিষ্টি। বানরেরা প্রথমে একটা বানরলাঠি ভেঙে ভিতরের দু-একটা বীচি খায় – আর খেতে ভালো লাগে ব’লে আরও দু-চারটে খেয়ে নেয়।
ওরা কিন্তু জানে__ এই জিনিসটা খেলে শরীরের গন্ডগোল হোতে পারে, কিন্তু খেতে ভালো লাগে ব’লে লোভ সামলাতে পারেনা! এইভাবে একটা করে লাঠি ভাঙ্গে আর বীচি খায়, অথচ ভাবে “আর খাবো না” ! কিন্ত যেই অনেকটা ঐ ফলের বীচি খেয়ে ফেলে__ অমনি তার পেট গুড়গুড়ানি শুরু হয়ে যায়! আর শুরু হয় পিচকারী’ দিয়ে পায়খানা! তখন সে কিচিরমিচির করে, আর এডাল-ওডাল লাফিয়ে বেড়ায়। কিচিরমিচিরের মাধ্যমে সে যেন বলতে চায়__ “ওই গাছে আর যাবো না, বানরলাঠি আর খাবো না!”__ কিন্তু আবার খায়।
বেশিরভাগ মানুষও ঠিক এমনই জানো – মানুষও এইরকমই জ্ঞান-পাপী। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ__ সমস্তটাই মানুষ জানে! কি করলে তার মঙ্গল হবে তাও জানে – কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আচরণে অন্য কিছু করে বসে!
বানরলাঠির মতো টক-মিষ্টি স্বাদ পাবার লোভে মানুষ___ ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয়রস গ্রহণ করে বসে – আর ফেঁসে যায়। সাধারণত মানুষ ভোগ-বাসনার তাগিদে লোভে পড়ে, মোহাবিষ্ট হয়_এইভাবে তারা রূপ-রসাদিতে আকৃষ্ট হয় ! আর এতে একটু একটু taste-ও পায় ! ব্যস্ _ অমনি সে ভেবে বসে_ এটাই বোধহয় তার জীবনের সার বস্তু !
এটাকে উপনিষদ বলেছে – “যথা নিম্বফলম্”। নিমের ফল পাকা অবস্থায় খোসা ছাড়ালে ভিতরে শাঁস থাকে, যার উপরটা একটু মিষ্টি কিন্তু চাপ দিলেই তেঁতো।৷
সংসারের ভোগ-ও এইরকম-ই। প্রথম প্রথম একটু মিষ্টি লাগে, ভালো লাগে, কিন্তু কিছুদিন পরেই ঐ ভোগ পরিণত হয় ভোগান্তিতে, অর্থাৎ এর থেকে তাকে ক্লেশ পেতে হয়। শাশ্ত্র বলেছে ত্রিবিধ ক্লেশের কথা – শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক।
তবে এইসব ক্লেশের হাত থেকে মুক্তির উপায়ও আছে। আর সেই উপায় হল সদ্গুরুর শরণাপন্ন হওয়া, তাঁর কাছে শরণাগত হওয়া! একবার শরণাগত হোতে পারলে_ তখন ভক্তের যা কিছু করার দরকার, তা তিনি নীজেই করিয়ে নেন_ভক্ত তখন যেন গর্ভস্থ শিশুটি ! গর্ভস্থ শিশুর সব দায়িত্ব মায়ের__ঠিক ঠিক শরণাগত ভক্তের‌ও ভার নেন সদ্গুরু।। তোমরাও গুরুর প্রতি শরণাগত হ‌ও_তোমাদের ভার‌ও গুরু নেবেন ব‌ই কি !!