জিজ্ঞাসু :– ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করলে আর পুনর্জন্ম হয় না__এইরূপ বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা কি ?
গুরুমহারাজ :– ‘ত্রিবেণী’ একটা নয়_ দুটো আছে, যুক্তবেণী ও মুক্তবেণী৷ আজ্ঞাচক্রে মুক্তবেণী এবং মুলাধারে যুক্তবেণী। সাধারণতঃ আজ্ঞাচক্রকেই বলা হয় ত্রিবেণী সঙ্গম।
তবে তুমি যেটা বলতে চাইছো_ উত্তর ভারতে এলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করা__ওটা বাহ্যস্নান ! প্রকৃত ত্রিবেণীসঙ্গমের স্নানের কথা বলছি শোনো__! কোনো সাধক যখন কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে ধীরে ধীরে ষটচক্র (মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা) ভেদ করতে করতে আজ্ঞাচক্রে এসে স্থিত হ’ন__ তখনই তাঁর ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান হয়। ইরা, পিঙ্গলা ও সুষুম্নার মিলনস্থল – তাই ত্রিবেণী।
মূলাধারে এই তিন নাড়ী যুক্ত অবস্থায় থাকে, তাই এটিকে যুক্ত বেণী বলা হয়। আর আজ্ঞাচক্রে এই তিন নাড়ী মুক্ত হোতে পারে_তাই এটি মুক্তবেণী। জীবের মুক্তি দানের স্থান।
তবে সাধকের এরপরে আসল স্নান হয় ব্রহ্মকুন্ডে অর্থাৎ সহস্রারে৷ ত্রিবেণী স্নানে জীব মুক্ত হয়, আর ব্রহ্মকুন্ডের স্নানে জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়!
তবে দ্যাখো, এগুলি যোগের ভাষা – সাধারণের বোধগম্য নয়।
সাধারণ মানুষ ত্রিবেণীর গঙ্গায় স্নান করে আর শ্লোক উচ্চারণ করে “পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে”। কিন্তু প্রকৃত রহস্য জানে না। প্রয়াগে ত্রিবেণী সঙ্গম রয়েছে, গঙ্গা-যমুনা ও সরস্বতী নদীর মিলনস্থল ধরে__ওটাকে ত্রিবেণী বলা হয়। কুম্ভমেলা উপলক্ষে ওখানে লক্ষ লক্ষ পূন্যার্থীর সমাগম হয়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধু-সন্ত সহ সারাদেশের শিশু-বালক-যুবক-যুবতী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা শীতের ভোরে হিমঠাণ্ডায় স্নান করে ! এই সব পুন্যার্থীদের ‘পাগলপণ’–দেখে পশ্চিমী দুনিয়ার মানুষেরা খুবই অবাক হয়! ওরাও অনেকে আসে ডুব দিতে! হয়তো ভাবে__’ভারতবর্ষ এক সুপ্রাচীন ও মহাণ ধর্মের দেশ__এর পিছনে কোনো গূঢ় রহস্য লুকিয়ে থাকতেও পারে!
আমিও এগুলি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। আমি দেখেছি যে, ওতেও কিছুটা কাজ হয় ব‌ই কি! কতো সাধু-মহাত্মারা ওখানে ঐ কুম্ভমেলায় উপস্থিত থাকেন, আর তাছাড়া কতো মানুষের সৎসংকল্প, সৎ-ভাবনা ক্রিয়াশীল ওখানে। লক্ষ লক্ষ এইসব মানুষের সমবেত, একমুখী আর্তিতে ঈশ্বর প্রসন্ন হ’ন – তাই ঐ স্থানে উপস্থিত জনগণের পূণ্যসঞ্চয় হয় ! আর কি হয় জানো__কুম্ভমেলার পুন্যলগ্নে বহু উচ্চ কোটির মহাত্মা মহাপুরুষেরা স্থুলদেহে স্নান করেন। তাঁদের শরীর থেকে শক্তিপ্রবাহ করুনা-ধারারূপে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গের ন্যায় বিচ্ছুরিত হয়ে ঐ সময়ে জলে মিশে যায়। ফলে সমস্ত পুন্যার্থীরাই স্নানকালে পরোক্ষ ভাবে করুনালাভ করে থাকেন।
এইসব কারণেই আজ পর্যন্ত কোনো মহামানব, এইসব অনুষ্ঠানের বিরোধ করেননি বরং তাঁরাও তাঁদের জীবদ্দশায় অন্ততঃ এক-দুবার সেখানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেছেন।
তবে, ঐ যে বলছিলাম আজ্ঞাচক্রে স্নান – ওটাই প্রকৃত স্নান! আজ্ঞাচক্রকে বলা হয়েছে দশমদ্বার। গুরু নানক একেই বলেছিলেন গুরুদ্বার বা গুরুদুয়ারা। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রক‌ত রহস্য ভুলে শিখ সম্প্রদায়ের কাছে বর্তমানে মন্দিরগুলিই গুরুদুয়ারায় পরিণত হয়েছে। তবে, কথা হোচ্ছে যে, সবক্ষেত্রে এমনটাই হয়! যে কোনো পরম্পরায় যিনি মূলে থাকেন, অর্থাৎ যাঁকে কেন্দ্র করে ঐ পরম্পরাটি গড়ে ওঠে__ কয়েক generation পরই উত্তরসূরিরা ঐ পরম্পরার মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। আর বিচ্যুত হোতে হোতে এতটাই দূরে চলে যায় যে, আবার কোনো মহাপুরুষকে আসতে হয়__ তাদেরকে chanalised করার জন্য !
আমি একাধিক স্থানের কুম্ভমেলায় এবং সঙ্গমে স্নান করেছি__ কোথায় কি হয়, তা পরীক্ষা করার জন্য ! কুম্ভমেলার ন্যায় অন্যান্য পুণ্যলগ্নের স্নানের ব্যাপারটায় দেখেছিলাম__ বহু উন্নত মহাত্মার উপস্থিতিতে এবং তাঁদের শরীরের পূণ্য স্পর্শে অর্থাৎ এককথায় স্থান-কাল-পাত্রের মহিমায় সত্যি সত্যিই মানুষের মঙ্গল-সাধন হয়।
তবে আমার কথা যদি বলো, তাহলে বলব – আমি প্রয়াগ, হরিদ্বারে স্নান করে যেরূপ আনন্দ লাভ করি, মুর্শিদাবাদে আমাদের আজিমগঞ্জ আশ্রমের ঘাটে গঙ্গায় স্নান করেও সেই আনন্দ-ই পাই।৷