জিজ্ঞাসু :– সাধু বা মহাত্মা চেনা যায় কি করে ?
গুরুমহারাজ :– প্রকৃত মহাত্মা যদি তোমাকে না চেনা দেন, তাহলে তুমি তাঁকে কখনোই চিনতে পারবে না। পোশাক-আভরণ-ক্রিয়াকান্ড অথবা অবয়ব ইত্যাদি দেখে সাধু চেনা যায় না। অবশ্য কিছু কিছু লক্ষণ দেখে অনেকটাই বোঝা যায়, যেমন__ সাধু হবে ত্যাগব্রতী, অহংশুন্য, সদা-সন্তুষ্ট চিত্ত ! প্রকৃত সাধুর কোনো কিছুতেই কারো কাছে কোনো অভিযোগ থাকে না, কারো প্রতি মনে বিদ্বেষ পোষণ করে না, কারো মনঃকষ্টের কারণ হয় না। অপরপক্ষে সাদা কাপড় পড়ে অথবা রঙিন কাপড় বা গেরুয়া কাপড় পড়ে এবং নিয়ম মেনে পুজো-আচ্চা করে বা ধ্যান-জপ করেও যদি কেউ অসন্তুষ্ট চিত্ত হয়, আশ্রমে থেকেও মনোকষ্টে ভোগে – তাহলে জানবে সে সাধুর জীবন যাপন করলেও এখনও সে প্রকৃত অর্থে ‘সাধু’ হয়ে উঠতে পারেনি।
তবে, এটা বলা যায় যে, হয়তো সে চেষ্টা করছে –যদি তার মধ্যে মুমুক্ষুতা থাকে হয়তো একদিন না একদিন সে ‘প্রকৃত সাধু’ হয়ে উঠতে পারবে । মুমুক্ষু অবস্থার মানুষ__তা সে যে আশ্রমেই থাকুক না কেন, সে ঈশ্বরলাভের পথেই যাবে। বৈষ্ণবদের কথায় আছে না “নামে রুচি, জীবে দয়া বা জীবসেবা”, এইরূপ ঈশ্বরে রুচি যার হয়েছে – সে অন্য পথে যাবে কি করে ? একটি সিংহকে যদি এক ঝুড়ি ঘাস দাও – সে কি খাবে ?– না, খাবে না ৷ একটি গরুকে এক তাল মাংস দিলে সে কি খাবে ?_না, তাও খাবে না। দ্যাখো, যার যে খাদ্যে রুচি সে তো সেই ধরনের খাদ্যই খাবে। এখানেও সেরূপই হয়।
যাই হোক, তোমার জিজ্ঞাসা ছিল__ সাধু-মহাত্মাকে চেনার ব্যাপারে ? কিন্তু ঐ যে বললাম_প্রকৃত সাধু তুমি চিনতে পারবে কি করে ? তবে, প্রকৃত সাধুর সংস্পর্শে যদি কখনো আসো__তাহলে তোমার জীবনের ধারা-ই বদলে যাবে। কিছুদিন সাধুসঙ্গ করলেই দেখবে তোমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কিছুদিনের মধ্যেই তোমাকে বলতে শুরু করবে – “তুই আর আগের মতো নাই, এখন যেন কেমন হয়ে গেছিস !”
মানুষের জীবনের পরিবর্তন করতে পারে একমাত্র সদগুরু অর্থাৎ প্রকৃত সাধু। পিতা পুত্রকে স্নেহ দেয়, শাসন করে এবং শিক্ষাদান‌ও করে কিন্তু এখানে পিতার বৌদ্ধিক জগৎ ক্রিয়াশীল। পিতা তার অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত শিক্ষা সন্তানকে দেয়। শিক্ষাগুরুরাও তাই –তারা হয়তো moral বা নৈতিক শিক্ষা দেয়, কিছু example তুলে ধরে –ইত্যাদি। এখানেও কিন্তু বুদ্ধিই কার্যকরী । ভালো অর্থাৎ বিবেকবান, আদর্শ শিক্ষক হোলে ছাত্র কিছুটা বিবেকের স্পর্শ পায়!
এবার মায়ের শিক্ষাদানের কথা বলছি__গর্ভধারিনী মা যখন সন্তানকে শেখান, সেই শিক্ষা হয় হৃদয় দিয়ে ! যেমন ধরো__মা যখন বলেন “তুই পড়াশোনা না করলে, আমি খুব কষ্ট পাবো,” অথবা “তুই না খেলে, আমারও খাওয়া হবে না “– এই ধরণের কথায় ছেলে-মেয়েদের হৃদয় দ্রবীভূত হয়। তাই মায়ের এই শিক্ষা অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়!
তবে, মহাপুরুষ-মহাত্মাগণের সংস্পর্শে আসার পর, তাঁরা মানুষের স্বভাব বা বৈশিষ্ট্যকেই পরিবর্তন করে দেন। এই ব্যাপারটাকেই একটু আগে বলা হচ্ছিলো__ হীরকের খনিতে হীরার আলোয় কালো কয়লার আলোকময় বা উজ্জ্বল হয়ে ওঠা ! কয়লা জড়পদার্থ আর মানুষ সজীব – জীবন্ত বিগ্রহ। তাই এখানে হীরার আলোয় কয়লার উজ্জ্বল হয়ে ওঠার উদাহরণ অবশ্য যথাযথ নয়। কারণ কয়লার কাছ থেকে আলো সড়ালে কয়লা আবার কালো হয়ে যাবে। কিন্তু জীবনের সাথে মহাজীবনের যোগ হোলে – সাধারণ জীবন-ই ‘মহাজীবনে’ রূপান্তরিত হয় ! মহাজনের পদে রয়েছে_ “তেরি বনত বনত বনি যাই”।
মহাপুরুষ চিনতে গেলে আর একটি লক্ষণের কথা বলে দিচ্ছি শোনো–সেটা হোলো অসাধারণ “adaptibility”! যে কোনো সময়, যে কোনো পরিবেশে, যে কোনো অবস্থায় নিজেকে সুন্দরভাবে adjust করে নেবেন – কারো কোনো অসুবিধা হোতে দেবেন না তিনি।
জানো, এবার আমার এই শরীরটাকে দিয়েও মা জগদম্বা অনেক কিছু সহ্য করতে শিখিয়েছেন, জীবনে চলার পথে বহুজনের সাথে আমাকে চরমভাবে adjust করতে হয়েছে।
আমার ইউরোপে ঘোরার সময়কালীন একটা ঘটনা তোমাদের বলছি শোনো। ইউরোপের ভক্তদের সাথে যখন নরওয়ে থেকে ইতালি যাচ্ছিলাম, তখন যাবার সময় আমরা জাহাজে কেবিন বা উচ্চশ্রেণীর টিকিট পাইনি।আমার সাথীরা যেহেতু ইউরোপিয়ান, তাই তারা সুবিধা পেয়ে গেল_কিন্তু আমি পেলাম না। ফলে আমাকে নিচে বসে বসে পুরো যাত্রাপথটা travel করতে হোলো। খালাসিদের সঙ্গেই কথা বলে, মেলামেশা করে আমি কটা দিন দিব্যি কাটিয়ে দিলাম এবং আরামসে ইতালি পৌঁছে গেলাম।
বেয়ন ছিল আমার সঙ্গে__আনন্দের সাথে আমার এইভাবে ঐ কদিন কাটানো দেখে বেয়ন বলেছিল – ” পরমানন্দ ! তুমি যদি চাঁদেও যাও – সেখানেও তুমি থাকার একটা ভালোমতোই ব্যবস্থা করে নেবে।”
যাইহোক, যা কথা হচ্ছিলো__ সেখানেই ফিরি ! আচ্ছা, তুমি হটাৎ করে সাধু-মহাত্মা-মহাপুরুষ চিনতেই বা চাইছো কেন ? অন্যেরা যে যা করে করুক__তোমার এসবের কোনো দরকার নেই ! তুমি যে কাজটা করছো__সেইটা ঠিকমতো করে যাও ! তাহলেই হবে ! প্রকৃত সাধু বা মহাত্মা ঠিক তোমাকেই খুঁজে নেবেন। এই যে তুমি এখানে এসেছো –আধ্যাত্মিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছো_ এগুলো তো খুঁজে নেওয়াই ! না হোলে পৃথিবীর লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি মানুষের সবাই এখানে আসছে না তো ? তোমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে বলে দেখোতো – কজন আসে ? তাই সবকিছু সবার জন্য নয়। ওই যে বলছিলাম না ‘রুচি’-র কথা ! রুচিভেদ_এই ব্যাপারটা রয়েছে। যার যে বিষয়ে রুচি_ সে সেইটাই গ্রহণ করবে, সেই ব্যাপারে বেশি সময় দেবে – বুঝতে পারছো ?
তবে, তোমরা যারা গৃহস্থাশ্রমে আছো__ তোমাদেরও আদর্শ গৃহী হয়ে উঠতে হবে। বাড়িতে পিতা-মাতার সেবা করবে, দেবসেবা-অতিথিসেবা-সাধুসেবা করবে ৷ সাধ্যানুযায়ী needy person-দেরকে অন্নদান, বস্ত্রদান, শিক্ষাদান করবে। এইসব শিক্ষা মেনে চললেই গৃহ-ও গৃহস্থাশ্রম হয়ে উঠবে। সাধু-আশ্রমের ন্যায় সেই গৃহেও high vibration-যুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবে। ফলে সেই গৃহে যারা থাকবে তাদের সকলেরই আধ্যাত্মিক উত্তরণ হবে।
তবে, সাধারণ মানুষ__কোনো সাধু-মহাত্মা-মহাপুরুষকে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে চেনা তো দুর-অস্ত, ঠিকমতো বিশ্বাস করতেই পারে না ! মানুষের বিশ্বাসেরই বা কি দাম আছে ? মানুষের এই বিশ্বাস – তো এই শংসয় ! এইজন্যেই তো বাউলে বলেছে__ “পুড়বে সাধু উড়বে ছাই, তবে সাধুর গুণ গাই।”
প্রকৃত সাধুর জীবন__ নিঃষ্কলঙ্ক জীবন ৷ ত্যাগ, বৈরাগ্য ও সাধনার মহিমায় উদ্ভাসিত। বক এবং রাজহাঁস দুজনেই জলচর জীব। জলে থাকার সময় বকের পাখা ভেজে, জল-কাদা লাগে। কিন্তু রাজহাঁসের পাখায় জল-কাদা ধরে না, পাঁক লাগে না। সাধু হোলো রাজহাঁস! সাধুর জীবন – নিষ্কলঙ্ক জীবন।৷