জিজ্ঞাসু :– পণ্ডিত ব্যক্তির কি ধর্ম হয় না ?
গুরুমহারাজ :– তুমি বোধহয় জিজ্ঞাসা করতে চাইছো__ পণ্ডিত ব্যক্তিরা আধ্যাত্মিক হয় কি-না এই তো ? দ্যাখো, ‘পণ্ড'(জ্ঞান/বিদ্যা) থেকে পণ্ডিত কথাটি এসেছে । এইজন্যেই এখানে দেখবে অনেক পরিবারের টাইটেল আছে_পন্ডিত,পান্ডা,পন্ডা ! আবার অবাঙালীদের ভিতরে রয়েছে __ পান্ডেজী, পাঁড়েজী ইত্যাদি। তার মানে বহু পূর্বে ঐ সব পরিবার বিদ্যাচর্চা নিয়ে থাকতো এবং ঐ সব পরিবারে অনেক স্কলার সদস্য জন্মেছিল। তাই এইরূপ নামকরণ হয়েছে। তবে বাংলায় ‘পন্ড’ শব্দটা অন্য অর্থেও ব্যবহার হয়। এইজন্যেই লোকে পন্ডিতদেরকে জড়িয়ে ‘পন্ড’ শব্দ নিয়ে মজা করে । তবে এটা সত্যি যে, অনেক পন্ডিত এক জায়গায় জড়ো হোলে প্রায়শঃই দেখা যায় সেই সভা পন্ড হয়ে যায়।
প্রচলিত পদ্ধতিতে লেখাপড়া শিখে, অনেকগুলো ডিগ্রী গ্রহণ করলে কি হয় জানো – সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা পাণ্ডিত্যাভিমান এসে যায়। তারা আর ত্যাগ-বৈরাগ্য-সাধনার দ্বারা আধ্যাত্মিক হয়ে উঠতে পারে না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন__’একবোঝা শোলা পিঠে বেঁধে জলে ডুব দেওয়া যায় না।’ গর্ব-অহংকার-অভিমান ঐরূপ ‘পিঠে শোলা বাঁধা’-র মতো! কুলগর্ব-ধনগর্ব-যৌবনগর্ব-বিদ্যার গর্ব ইত্যাদি থাকলে সাধনার গভীরে ডোবা যায় না।
কিন্তু তাই বলে সবার কি হয় না ?__তা হয় ব‍ই কি ! ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। পন্ডিত ব্যক্তির যদি অহং না থাকে অর্থাৎ পাণ্ডিত্যাভিমান না থাকে__ তাহলে তিনি অবশ্যই আধ্যাত্মিক হবেন। বই পড়ে বেদ-বেদান্ত, শাস্ত্রাদি মুখস্থ করা যায়, তার ব্যাখ্যা করা যায়,– কিন্তু তত্ত্বের ধারণা হয় কি ? ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের পদপ্রান্তে বসে নিষ্ঠা সহকারে শ্রবণ করলে__ তবেই ব্রহ্মের ধারণা হয় ৷ তাই বলা হয়_একটা জ্বলন্ত প্রদীপ-ই অন্য একটা প্রদীপ-কে ‘জ্বালাতে’ পারে। সুতরাং চরিত্রবানের সংস্পর্শে চরিত্রের বিকাশ হয়, বিবেকবানের সংস্পর্শে বিবেকের জাগরণ হয়, আর আধ্যাত্মিক মানুষের সংস্পর্শেই মানুষের আধ্যাত্মিকতা জাগরণ ঘটে৷
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে যখন বিদ্যাসাগরের সাক্ষাৎ হোলো, তখন ঠাকুর বলেছিলেন – ” শুকনো পণ্ডিত হওয়া ভালো নয়, তারা হয় শকুনির ন্যায় অর্থাৎ অনেক উঁচুতে উঠে কিন্তু নজর থাকে ভাগাড়ের দিকে।” বিদ্যাসাগরের মতো মহাপণ্ডিত-কে উনি বলেছিলেন সিদ্ধ । সিদ্ধ কথার অন্য অর্থ নরম, তাই বলেছিলেন_ ‘তুমি দরকচা মারা পন্ডিত ন‌ও’। দ্যাখো, মানুষের পাণ্ডিত্য যেন অলংকার_ আর তার সাথে তিনি যদি অহং-মুক্ত বা অভিমান-মুক্ত হ’ন, তাহলে তা যেন হয় সেই অলংকারে হীরে বসানো ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ‌ও এমনটাকে বোঝাতে বলেছিলেন – ” হাতির দাঁত – তাতে সোনা বাঁধানো।”
তবে, এই যে তোমরা নানা ধরনের জিজ্ঞাসা করো, এতো কথা জানতে চাও – এগুলি কিন্তু অজ্ঞানতা থেকে আসে। জ্ঞানী ভক্ত কখনো নানারকম জিজ্ঞাসা করে না – তার এক লক্ষ্য, এক জিজ্ঞাসা__আর সেটা হোলো “অথাথ ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা”। নিজেকে জানার চেষ্টা না করে__ নানান বিষয়,বস্তু বা ব্যক্তি সম্বন্ধে জানার চেষ্টা মানেই অপূর্ণতা, আর “কোহহম্, কিম-ইতি”– অর্থাৎ ‘আমি কে’– তা জানাই পূর্ণতা। আর দ্যাখো, বই পড়া বিদ্যায় কি হয় ? বুদ্ধির চর্চা হয়– লোককে জ্ঞান দেওয়া যায়, নিজের চেতনার উন্নতি তো কিছু হয় না।
পন্ডিতেরা একগাদা পড়াশুনা করে, নানাবিধ বিদ্যার্জন করে__অহংকারী হয়ে ওঠে ! ফলে, তারাই শিক্ষক হয়ে যায়_তারা আর কারো কাছে কিছু শিখতে চায় না ! এরা বড্ড বেশি ritual হয়, নানারকম বিধিনিষেধ, শাসন-বাড়নের মধ্যে নিজেদেরকে বেঁধে ফেলে এবং নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ ধার্মিক হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে।
টলস্টয়ের গল্পে রয়েছে – একদল পাদ্রী জাহাজ নিয়ে বিভিন্ন দ্বীপে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের Baptize করার কাজটা করছিল। সেইরকম ঘুরতে ঘুরতে একটা ছোটো দ্বীপ দেখে সেখানেই জাহাজ ভিড়িয়ে, ডাঙায় নেমে দেখে – সমগ্র দ্বীপটায় মাত্র তিনজন বৃদ্ধ রয়েছে। পাদ্রীরা তাদেরকে__ তাদের আগমনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলল এবং তাদেরকে Baptize করলো ! এই সমস্ত ক্রিয়াকান্ডের জন্য বৃদ্ধরা কোনোই আপত্তি করলো না। এরপর পাদ্রীরা জাহাজ নিয়ে চলে গেল অন্য দ্বীপের উদ্দেশ্যে। গভীর রাত্রিতে পাদ্রীরা অবাক বিস্ময়ে দেখলো যে, সমুদ্রের বুক চিরে তিনটি উজ্জ্বল আলো তাদের জাহাজের দিকে ধেয়ে আসছে। তারপর সেই আলো তিনটি জাহাজের ডেকে এসেই মানুষের রূপ ধারণ করলো। পাদ্রীরা অবাক হয়ে দেখলো___তারা ছিল সেই তিনজন বৃদ্ধ ! বৃদ্ধেরা পাদ্রীদেরকে করজোড়ে নিবেদন করলো যে, তারা যে যে ক্রিয়া-পদ্ধতি তাদেরকে শিখিয়ে এসেছেন, সেগুলি যদি আর একবার শেখান তাহলে ভালো হয়, কারণ সারাদিনের কাজের ফাঁকে তারা ঐ ক্রিয়া-পদ্ধতিগুলি ভুলে গিয়েছে। বৃদ্ধগুলির আলোর রূপ নিয়ে জাহাজে আগমন দেখেই তো পাদ্রীদের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল। তাই পাদ্রীরাই সেই বৃদ্ধদের কাছে জোড়হাতে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলল – ” দেখুন ! আপনারা সাধনার জগতে আমাদের থেকে অনেক উন্নত ! আপনাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদি দিয়ে আমরা যে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছি, তার জন্য আমাদেরকে মাফ করবেন। আপনারা যে সাধনায় রয়েছেন – অবশ্য‌ই তা উৎকৃষ্ট ! আপনারা ঐ ক্রিয়াতেই থাকুন__আমাদের শেখানো নিয়ম-কানুন, আপনাদের পালন করার কোনো প্রয়োজন নাই।”
এই গল্পে ধরে নাও ঐ পাদ্রীগুলি ছিল পন্ডিত ব্যক্তি, আর বৃদ্ধগুলি ছিলেন প্রকৃত আধ্যাত্মিক ব্যক্তি।।