জিজ্ঞাসু :– কমিউনিস্টরা বলে_ “ধর্ম হোলো আফিং-এর নেশা” ! আচ্ছা গুরু মহারাজ__সত্যি সত্যিই কি এই কথার কোনো সত্যতা আছে ?
গুরুমহারাজ :– দ্যাখো, সত্য – সত্যই ! এটা সত্য – ওটা সত্য নয়, এমনটা নয়। ব্রহ্ম-ই সত্য – যা শাশ্বত, নিত্য ও সনাতন। ব্রহ্মকে সচ্চিদানন্দ বলা হয়েছে। সৎ অর্থে “অস্তি” অর্থাৎ যা আছে। এরপর ‘চিৎ’-অর্থে “ভাতি” অর্থাৎ তিনি প্রকাশমান। ‘সত্য’ যখন ‘প্রকাশিত’, তখন সেই প্রকাশকে নিয়েই তো আনন্দের আস্বাদন – এই আনন্দময় অবস্থাকেই বেদ বলেছে “প্রিয়”।
এইবার কথা হোচ্ছে, দ্যাখো__ কমিউনিস্টরা কি বললো অর্থাৎ তারা যে দর্শনে বিশ্বাসী, তাই দিয়ে কি মহাবিশ্ব চলে__নাকি সেই মতবাদের দ্বারা মহাবিশ্ব প্রকৃতির শাশ্বত নিয়ম বদলে যাবে ? মহাবিশ্বের মহা-নিয়মের অনুকূলে যদি কেউ কিছু বলে, সেটা তাও কালের বুকে কিছুদিন স্থায়ী হয় –তা যদি না হয়, তাহলে ‘কাল’ সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
দ্যাখো বাবা, পৃথিবীতে এইরকম কত মতবাদ এসেছে_ কিছুদিন স্থায়ী হয়েছে, আবার কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে ! আচ্ছা, বলো তো ধর্মের সংজ্ঞা কি ? ঠিক আছে, আমি বলছি, শোনো__ ‘যা এই মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুকে ধারণ করে আছে।’ তাহলে তুমি যাকে বা যাদের কমিউনিস্ট বলছো – তাকে কে ধারণ করে আছে ?– ধর্মই তো তাদেরকেও ধারণ করে আছে_তাই না ! সুতরাং ধর্মের বাইরে তো কেউই নাই – সবাই ধর্মের ভিতরেই রয়েছে।
আর ‘আফিং’ কথাটা ব্যবহার হয়েছে কেন বলোতো– কারণ আফিং খেলে নেশা হয়, তাই এরা বলে যে, ‘ধর্মাচরণ’ এই ব্যাপারটাও একটা নেশার মতোই ! কিন্তু জানো__ আফিং থেকেই পাওয়া যায় হেরোইন এবং তার নেশা আরও ভয়ঙ্কর এবং জীবনঘাতী ! তোমাকে যে এই কথাগুলো বলেছে__তাকে বলবে, কমিউনিস্ট রাজনীতির যে নেশা__তা যেন হেরোইনের নেশা। একবার এই রাজনীতি মাথায় ঢুকলে_ আর বেরোনো মুস্কিল, মৃত্যুকাল পর্যন্ত যেতে চায় না!
পশ্চিমবাংলায় কমিউনিস্টদেরকে দেখছি তো (তখন ১৯৯২/৯৩-সাল, বাংলায় তখন কমিউনিস্ট পার্টির শাসন ছিল), এই পার্টির followers-দের শুধু ‘দাও-দাও’ অর্থাৎ শুধুই চাহিদা, কিন্তু তাদের যেন কোনো দায়িত্ববোধের বালাই নাই। মাইনে দাও, সুযোগ দাও, বোনাস দাও, ছুটি দাও__ কিন্তু কাজের দায়িত্ব দিও না ! ‘সঠিকভাবে কাজ করবো’, ‘মানুষের সেবা করবো’, ‘কাজে ফাঁকি দেবো না’, ‘ঘুঁস নেবো না বা বিনা উৎকোচে মানুষকে পরিসেবা দেবো’ – এসব কেউই বলছে না ! শুধু দাও – দাও !!
কমিউনিস্ট দর্শন দিয়ে কি মানুষকে কর্তব্যবোধ শেখানো যায় ? চিন-রাশিয়া ইত্যাদি দেশে তো দীর্ঘদিন ধরে কমিউনিস্ট শাসন চলছে, ওখানে তো এতো বছরেও দায়িত্বশীল-কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক তৈরি করা যায় নি ! সবাই না হোক, বেশিরভাগের তো হ‌ওয়া উচিৎ ছিল ! Red-army আর কঠিন অনুশাসনের দ্বারা সাধারণ মানুষকে দিয়ে কাজ করাতে হয়!
কোনো কাজের জন্য মাইনে দিয়ে লোক appointment করলে –তারা কাজ করতে যাবার সময় বলে__ “duty যাচ্ছি”। duty-র বাংলা মানে কর্তব্য বা দায়িত্ব। কিন্তু ‘যে কাজের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে_ যার জন্য আমাকে বেতন দেওয়া হোচ্ছে এবং যে বেতনে আমার পরিবার প্রতিপালন হোচ্ছে সেটাকে প্রাণপণে আমাকে করতেই হবে,’__ এই যে মানসিকতা, এটাকে বলা হয় service বা সেবা। এটাই একজন দায়িত্বশীল,কর্তব্যপরায়ণ নাগরিকের কাজ।
যাইহোক, এসব কথা থাক্। আমি তোমাকে বলছি__তুমি যেন রাজনীতির শিকার হোতে যেয়ো না। এটা কেন বলছি জানো__এখন আর ভদ্রলোকেদের রাজনীতি করার মতো পরিস্থিতিই নাই। বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দলই আর ঠিক নাই, অর্থাৎ তারা আর ঠিক ঠিক আদর্শ নিয়ে চলে না। সব দলেই হয়তো দু-চারজন ভালো লোক, আদর্শবান লোক থাকে, কিন্তু সে ঐ দু-চারজন‌ই ! দ্যাখো, এখন রাজনৈতিক ক্ষমতা ধীরে ধীরে দুষ্কৃতীদের হাতে চলে যাচ্ছে, এটা ভারতবর্ষের রাজনীতির পক্ষে খুবই খারাপ লক্ষণ !
তাহলে এখন তোমরা বলতেই পারো যে__ “তাহলে আমরা কিভাবে চলবো?” এইজন্যেই তো বলা হয়েছে__ “অন্তরে সাক্ষীপরায়ণ হও, ব্যবহারে ঈশ্বরপরায়ণ হও, কর্মে সেবাপরায়ণ হও”৷
অন্তরে অন্তর্যামী সদা-সর্বদা সাক্ষীরূপেই রয়েছে – কিন্তু তোমার সেই বোধ নাই ! এই বোধ-টা অর্জন করতে হবে এবং সর্বদা এইটিকে খেয়াল রাখতে হবে_ তাহলেই বিবেকের জাগরণ হবে । আর জাগ্রত বিবেকের প্রহরায় থাকলে, সেই মানবের দ্বারা কখনোই এমন কোনো কাজ হবে না – যার দ্বারা মানবসমাজের অকল্যাণ হয় !
এবার__ ‘ব্যবহারে ঈশ্বরপরায়ণ’_ হওয়া মানে হোচ্ছে সকল জীবকে ঈশ্বরবৎ দেখা! তখনই যথার্থ ‘হাতি-ও নারায়ণ’ এবং ‘মাহুত-ও নারায়ণ’__এরূপ বোধ হয়।
আর ‘কর্মে সেবাপরায়ণ’– অর্থাৎ নিঃস্বার্থ সেবা । নিঃস্বার্থ সেবা__ সেই করতে পারে, যে পূর্ণজ্ঞানী ও পূর্ণপ্রেমী, অর্থাৎ যার মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে।
যাই হোক, তোমার কথার উত্তর হিসাবে এবং তোমাদের কিসে মঙ্গল হবে__এই ব্যাপারে আমি অনেক কথাই তো বললাম ! কিন্তু আমি বলছি বলেই কি তোমরা, তোমাদের স্বভাব পাল্টাবে ? চেষ্টা হয়তো করছো, কিন্তু পাল্টাতে আর পারছো কই ? কতো মহাপুরুষ-মহামানবেরা তো পৃথিবীতে শরীর নিয়ে এই চেষ্টাই করে গেল – তবু মানবপ্রজাতির আধ্যাত্মিক অগ্রগতির হার খুবই সামান্য ! জানো, এই জগতের গতিপ্রকৃতি বড়‌ই বিচিত্র ! আর তার মধ্যে পৃথিবীর মনুষ্যচরিত্র আরও বিচিত্র ! আমি বসে বসে এইসব মজা দেখি – আর এগুলির মধ্যে থেকে মজা গ্রহণ করতে থাকি। [ক্রমশঃ]
(পরবর্ত্তী অংশ পরের দিন)