[‘ধর্ম আফিং-এর নেশার ন্যায়’_এই জিজ্ঞাসার উত্তরে গুরু মহারাজ কথা বলেছিলেন। আলোচনার মাঝামাঝি অংশে উনি জগতের বিচিত্রতা এবং ভিন্ন ভিন্ন মানুষের বিচিত্রতা নিয়ে আলোচনা করছিলেন…..! আজ তার পরবর্ত্তী অংশ।]
……. এখানে(এই সমাজে) দেখি কোনো তরুণ যুবক খুব ঘটা করে, জাঁকজমক সহকারে অর্থাৎ সমাজের সকলকে দেখিয়ে, শুনিয়ে,জানিয়ে বিয়ে-সাদি করে সংসার জীবনে প্রবেশ করছে। আবার দেখি কোনো তরুণ যুবক সংসারের ভোগ-লালসার মাথায় লাথি মেরে ত্যাগের পথ, সংযমের পথ, কষ্টের পথকে বরণ করে নিচ্ছে_ ব্রহ্মচর্য ব্রত গ্রহণ করছে অথবা সন্ন্যাসী হোচ্ছে__ “আত্মনোমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ” জীবন উৎসর্গ করছে। অনেকে গৃহে থেকেও ঘর-সংসার, পুত্র-কলত্র-পরিজন, বিষয়-আশয় ইত্যাদি থেকে নিজেকে সড়িয়ে নিয়ে_ ঈশ্বরমুখী হয়ে জীবন কাটাচ্ছে ! এইজন্যেই শাশ্ত্র বলেছে__”সংসারচিত্রম্ অতীব বিচিত্রম্” !
এখানে আমি কাউকে ছোটো-বড় করছি না – জগতের চিত্র যা তাই বলছি। সংসার আশ্রমে প্রবেশ করে যদি কেউ সুখী হয়, আনন্দে থাকে__ তাহলে তো ঠিকই আছে। তার দ্বারাও সমাজের মঙ্গল হবে। কারন যে সুখী সেই পারে অপরকে সুখ দিতে, যে আনন্দে রয়েছে সেই পারে অপরকে আনন্দ দিতে। আবার সন্ন্যাস আশ্রমে কেউ রয়েছে কিন্তু মনে শান্তি নাই, একে অপরের দোষ ধরে, সামান্য বিষয় নিয়ে অন্য ব্রহ্মচারী বা সন্ন্যাসীর সাথে কলহ করে, নিরানন্দে রয়েছে – তারমানেই তার মধ্যে অতৃপ্তি রয়েছে, এখনও তার মধ্যে কিছু ভোগবাসনা রয়েছে। ফলে তাকে আবার শরীর গ্রহণ করে সংসারী হয়ে ভোগ-বাসনা মিটিয়ে আসতে হবে। এইটাই জগতের বা জীবনের রহস্য !!
উভয় আশ্রম(সন্ন্যাস আশ্রম ও গার্হস্থ্য আশ্রম)-ই একে অপরের পরিপূরক। কেউ ছোটো-বড় ভাবছে – তার মানে তার এ ব্যাপারে ধারণা পাকা হয়নি, তাকে আবার শরীর গ্রহণ করে ঐ অপূর্ণতাকে, ঐ অতৃপ্তিকে মিটিয়ে নিতে হবে। তবে পূর্বের শরীরের সাধন-ভজন যেটুকু হোচ্ছে, তা কিন্তু ব্যাহত হবে না – তার ফলটা রয়েই যাবে। ঐ যে ভগবান বলেছেন__’যোগক্ষেম বহাম্যহম্’!
তবে আমি যেহেতু সংসার আশ্রমের মানুষদের মাঝে রয়েছি – আমার এখানে সবরকম লোক-ই আসে। তবে দেখি কি জানো__ সংসার আশ্রমে যারা রয়েছে_ তাদের বেশিরভাগই নানান সমস্যায়, নানান অশান্তিতে রয়েছে। এককথায় বলা যায় বিভিন্ন জ্বালায় তারা জ্বলে মরছে। অনেকে এসে আমাকে তাদের সমস্যার কথা বলে_ তখন আমি এটাই দেখি যে,যাদেরকে নিয়ে এরা বেশি আদিখ্যেতা করছে –পরবর্তীতে তারাই এই জ্বালার কারণ হোচ্ছে। আধুনিক ছেলে-মেয়েরা নিজেদের বৃদ্ধ পিতামাতাকে অগ্রাহ্য করে আর তার নিজের সন্তানকে সবচাইতে দামী খাবার– দামী পোশাক কিনে দেয়, নামী স্কুলে ভর্তি করে ! খুব আদর-যত্ন সহকারে তাকে বড় করে তোলে, কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায় ঐ সন্তান-ই পিতা-মাতার মনঃকষ্টের প্রধান কারণ হয় ! এরা ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে পারে না, শিশুটি কোনো কিছু চাহিদা করার সাথে সাথে তা পূরণ করতে গিয়ে__ আধুনিক বাবা-মা সন্তানকে প্রকৃত ভালোবাসা না দিয়ে, আদিখ্যেতাপ্রবণ হয়ে পড়ে। পাশাপাশি পড়শীর কাছে অথবা socity-তে নিজের মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য ঐসব করে__শিশুটির কিসে ভালো হব–সেইটা বিচার করে না ! ফলে পরে কষ্ট পায়!!
সন্তানকে ঠিকমতো মানুষ করতে গেলে তাকে কষ্টের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে হবে – জীবনটা তো সংগ্রামের জন্যই তৈরি, তাই তাদের জীবন-সংগ্রামে অভ্যস্ত হোতে সুযোগ করে দিতে হবে। প্রাচীনকালে রাজা-মহারাজারা তাদের পুত্রদের অরণ্যে পাঠাতো– গুরুগৃহে। সেখানে রাজার ছেলে, বা মন্ত্রী-সেনাপতির ছেলেদের কত কষ্ট সহ্য করতে হোতো।
দ্যাখো, এতে কি হয় বলোতো –মানুষের জীবন তো একভাবে কাটে না, রাজার রাজত্বও চলে যেতে পারে। যে কোনো মানুষই অবস্থার পরিবর্তনে কেউ দরিদ্রাবস্থা থেকে ধনবান হোভে পারে, আবার কেউ ধনী থেকে দরিদ্র হয়ে যেতে পারে,। এরকম হোলে ওই ছেলে-মেয়ে যেহেতু ছোটবেলায় কষ্ট করা অভ্যাস করেছে __তাই সে অনায়াসে জীবন সংগ্রামে ব্রতী হোতে পারে এবং সে এই সংগ্রামে জয়ীও হোতে পারে। কিন্তু যদি শিশুদেরকে শুধুই বিলাস-ব্যসনের মধ্যে মানুষ করা হয় – তাহলে সেইসব ছেলে মেয়ের জীবনে বিপর্যয় নেমে এলে _ তারা একেবারে ভেঙে পড়বে, মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারবে না।
সুতরাং তোমরা যারা এসব কথা শুনছো – তোমরা অন্ততঃ চেষ্টা কোরো তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের ছোটো থেকেই জীবনসংগ্রাম শেখাতে – যাতে তারা জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে adjust করে নিতে পারে ! দ্যাখো, এটাকেই তো বিজ্ঞানের ভাষায় ‘অভিযোজন’ ক্ষমতা বলে। আর জানোতো_যে মানুষ যত বেশি আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত,তার অভিযোজন ক্ষমতা তত বেশি!!