জিজ্ঞাসু :– আপনি একদিন বলছিলেন__ পূর্ব পূর্ব জীবনের সংস্কার অনুযায়ী জাতকের জন্ম হয় । কিন্তু আমরা দেখছি__ এমন অনেক পৌরাণিক great man-এরা রয়েছেন, যাঁরা অবৈধভাবে জন্মেছেন-আবার কেউ কেউ বেশ্যার গর্ভে জাত হয়েছিলেন । তাহলে এর ব্যাখা কি হবে ?
গুরুমহারাজ :– এইগুলি সাধারণ ঘটনা নয়। এগুলি হোলো দৃষ্টান্ত ! সমাজের যে কোনো স্তরের মানুষ‌ই যেন হীনমন্যতায় না ভোগে__তাই এইরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন ! দ্যাখো, এই যে জগৎ-টা দেখছো, এটা ✓-রী মায়ের জগৎ –ফলে মা ঘটন-অঘটন সবই করতে পারেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে রয়েছে যে, ” ঈশ্বর এখন সুচের ছিদ্র দিয়ে উট ঢোকানোর ব্যবস্থা করছেন”, অর্থাৎ যাঁর জগৎ_তিনি তো আপন খেয়ালে এমন অনেক কিছুই করতে পারেন, যা প্রচলিত চিন্তাধারায় মেলে না। বুঝতে পারলে ব্যাপারটা !!
তুমি যেটা বলছো পূর্বসংস্কার অনুযায়ী শরীর ধারণ – এটা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ঠিকই কিন্তু সবকিছুর‌ই ব্যতিক্রমও রয়েছে! যাঁদের কথা তুমি বলতে চাইছিলে, অর্থাৎ মহামুনি ব্যাসদেব, ঋষি ভরদ্বাজ, জাবাল-সত্যকাম ইত্যাদিরা ব্যতিক্রম। ব্যাসদেব ছিলেন ঋষি পরাশর আর মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর অবৈধ সন্তান । কিন্তু উনি মায়ের দ্বারা পরিত্যক্ত হ‌ওয়ায় শিশু অবস্থা থেকেই ঋষি আশ্রমে বেদবতী মাতার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হয়েছিলেন । যেহেতু বেদবতী মাতা সদাসর্বদা কাজ করতে করতেই বেদ পাঠ করতেন, তাই ছোটবেলাতেই তিনিও শুনে শুনে সমগ্র বেদ মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। এই ব্যাসদেব বড় হয়ে মহামুনি হিসাবে পরিচিত হোলেন, বেদের বিভাজন করলেন, অষ্টাদশ পুরাণ রচনা করলেন__ এসব ঘটনা তো ইতিহাস !
ভরদ্বাজও তাঁর মাতার স্বামীর সন্তান নন, পিতৃব্যের দ্বারা ওনার মা বলাৎকৃত হয়েছিলেন এবং এর ফলেই ওই সন্তানের জন্ম হয়। মা – এই অবৈধ সন্তানকে বিসর্জন দিতে মনস্থ করেছিলেন এবং সেইমতো কাজ করতে যাবেন – এমন সময় সেখানে তখন কয়েকজন ঋষি হাজির হয়েছিলেন। তাঁরা মা-কে এই মহাপাপ করা থেকে বিরত করেন এবং মা-য়ের কাছে সন্তানকে চেয়ে নেন ৷ “ভরণ করব দাও”–এই কথা বলেছিলেন বলেই তাঁর নাম হয়েছিল “ভরদ্বাজ”। ঋষিদের সংস্পর্শে ছোটো থেকেই অতিবাহিত করায় ওনারও সংস্কার পরিবর্তন হয়ে গেল এবং উনি পরবর্তীতে ঋষিত্ব অর্জন করলেন।
জানো তো__ বাংলায় একটা কথা আছে, “জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো”। সাধারণ মানুষের যেখানে জন্ম হয়ে থাকে, সেখানকার জল-হাওয়া অর্থাৎ আবহাওয়ার সঙ্গে তার দেহ-মন সবকিছু adopt হয়ে যায় । তাই যেকোনো জাতকের সেই স্থানটিই তার পরিপূর্ণতা আনার পক্ষে সব চাইতে সহায়ক ।
কিন্তু সবসময় তো মানুষের কর্মজগৎ জন্মস্থান-কেন্দ্রীক হয় না। মানুষ অভাবে পড়ে, উপার্জনের নিমিত্ত জন্মস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে বাধ্য হয়। আবার সমাজে যেহেতু নানান বাধা তাই সাধু-সন্ত-দেরকেও সংসার ত্যাগ করে দূরবর্তী স্থানে যেতে হয়। সুতরাং সবসময় প্রচলিত সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী-ই যে সব কাজ হয়_ এমনটা নয় ! প্রকৃতি সবসময়েই বৈচিত্র্যময়। এখানে বিভিন্নতা রয়েছে, রয়েছে বৈচিত্র্য। মানুষ এগুলো বুঝতে পারে না, কারণ মানুষ যে মায়াবদ্ধ জীব !
রামায়ণের ঘটনা দিয়েও মানুষের জীবনকে ব্যাখা করা যায়। ‘লক্ষণের গন্ডীবদ্ধ সীতা’– যেন মায়ামুক্ত জীবের প্রতীক–সেখানে সে স্বাধীন, নির্ভয়। ‘লক্ষণের গন্ডী’_ হোলো জীবের অনিত্যের প্রতি নিরাসক্তি এবং গুরুতে আত্যন্তিক শ্রদ্ধা, জাগ্রত বিবেকের প্রহরায় থাকা। মানুষ অনিত্য বিষয়ে আসক্ত হোলে বা গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা হারালেই সে মায়ার কবলে(রাবনের খপ্পরে) পড়ে যায়। সদগুরুর সান্নিধ্য লাভ করেনি এমন ব্যক্তির জীবনের ক্ষেত্রে কি হয় জানো__তার বিবেক সুপ্ত থাকে। উচ্চ বংশ, উচ্চ শিক্ষা, ভালো পরিবেশ ইত্যাদি লাভ করা সত্ত্বেও ওই ব্যক্তিরা জাগতিক প্রলোভনকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। ফলে, জীবনে চলার পথে নানান অন্যায়, অপরাধ করে বসে – এটাই ‘সীতার রাবণের কবলে চলে যাওয়া’।
এইভাবে সাধারণ মানুষের জীবনের তাল কেটে যায় – সুর ও ছন্দ নষ্ট হয়ে যায়। এখানে “রাবণ” হোলো অসুর – অর্থাৎ যার জীবনের চলার পথ ছন্দে নাই– সুরে নাই, এইজন্যেই শাশ্ত্রকাররা এই ধরনের ব্যক্তিদেরকে বলেছেন “অসুর”!