জিজ্ঞাসা :– প্রতিটি মানুষ___ উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, দেশী-বিদেশী নির্বিশেষে__জীবনে এতো কষ্ট পায় কেন ?
গুরুমহারাজ :– দ্যাখো, সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়__বেশিরভাগ মানুষ তার অন্তঃকরণকে মলিন করে ফেলেই এতো কষ্ট পায় ! আচ্ছা বলো তো__ মানুষ যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সঙ্গে করে কি নিয়ে আসে ? __নিয়ে আসে তার অন্তঃকরণ! আবার মানুষ যখন মারা যায় তখন তার সূক্ষ্ম সত্তার সঙ্গে কি যায় ? – যায় সেই অন্তঃকরণ ! টাকা-পয়সা, বিষয়-আশয়, রূপ-সৌন্দর্য এসব কিছুই সঙ্গে যায় না – যায় তুমি যেটা এনেছিলে সেটাই !
জানো__ প্রকৃতপক্ষে ওটাই তোমার, বাকি যা কিছু__সে সবকিছুই তোমার কারো না কারো কাছ থেকে পাওয়া। সেগুলি সব‌ই তুমি কারো না কারো কাছ থেকে নিয়েছো__ সেই অর্থে তুমি অনেকের কাছে ঋণী ! এইজন্যই ভারতীয় শাস্ত্রাদিতে বিভিন্ন ঋণের কথা বলা হয়েছে, যেমন__ মাতৃঋণ, পিতৃঋণ, দেবঋণ, মহাবিশ্ব-প্রকৃতির কাছে ঋণ ইত্যাদি। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝাচ্ছি__বোঝার চেষ্টা করো ! যেমন ধরো তোমার শরীর – এটা তো তোমার পিতা-মাতা এবং প্রকৃতির দেওয়া ! শরীর গ্রহণে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ণরূপে তোমার ইচ্ছা কাজ করেছিল ঠিকই কিন্তু প্রাপ্ত শরীরটি তো একেবারে প্রথমাবস্থায় তোমার পিতা-মাতার‌ দান_তাই নয় কি ! তারপর থেকে শরীরের পুষ্টি বা বৃদ্ধি গর্ভধারিনী মা এবং প্রকৃতি মায়ের দেওয়া ! প্রকৃতির আলো, বাতাস, জল, শস্যাদি থেকেই মানবের দেহের পুষ্টি সাধন হয় – তাই মানব প্রকৃতির কাছেও ঋণী। এরপর শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-ব্যবহার, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বাকি অনেক কিছুর জন্য তুমি সমাজের কাছে ঋণী!
এইভাবে বিচার করে দ্যাখো তো__ ‘তাহলে তোমার কি ?’ তোমার নিজস্ব যা__তা হোলো একমাত্র তোমার অন্তঃকরণ। মানুষের ক্রিয়মান কর্ম যত ভালো হয়, কল্যাণমুখী হয়, পবিত্র হয় – তত অন্তঃকরণ স্বচ্ছ হয়। আর এগুলির বিপরীত কর্মাদিতে অন্তঃকরণ মলিন হয়ে পড়ে !
সুতরাং অপকর্ম করে বা কর্ম খারাপ করে অন্তঃকরণকে মলিন করে কি লাভ বলো ? বিচার করো, বিচারের ধারাকে ছোট করো না – সংকীর্ণ করো না – তাহলে কিন্তু আমার কথার মর্মার্থ ধরতে পারবে না !
একটা ঘটনা বলছি শোনো –এটি ভগবান বুদ্ধের জীবনীতে পাওয়া যায়।
ভগবান বুদ্ধ একবার মগধের সন্নিকটে কোনো এক আমবনে অবস্থান করছিলেন। সেই সময় ওই নগরের একজন ধনবান লোক ধনাশ্রেষ্ঠী তার বালিকা কন্যা পটচারা-কে নিয়ে ভগবানের কাছে এসেছিল। ধনা – ধনী ব্যক্তি, তাই ভগবান বুদ্ধের জন্য খুবই দামি দামি কিছু উপহার সাথে করে নিয়ে এসেছিল। বালিকা পটচারা-র কিন্তু বাবার এইসব উপহার কেনাটাকে অপব্যয় বলে মনে হয়েছিল – হয়তো তার পূর্বসংস্কার কাজ করছিল ! যাইহোক, ভগবান বুদ্ধের সামনেই সেই বালিকা পিতার সাথে ঝগড়া বাধিয়ে বসলো এবং পিতাকে নানা কথা শোনাতে লাগলো – “কেন এতসব খরচা করা হোলো”, “এখানে আসারই বা কি প্রয়োজন”– ইত্যাদি কথার অবতারণা করলো ওই বালিকা পটচারা। ভগবান বুদ্ধ সব শুনে শান্তকণ্ঠে বালিকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন – ” তুমিও একদিন আসবে মা ! তবে তুমি সেইদিন আসবে – যখন তোমার এখানে আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না ! এখন তোমার সামনে অনেক বিকল্প রয়েছে__ তাই বুঝতে পারছো না_মা!”
ধনাশ্রেষ্ঠী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খুবই লজ্জা পেলো, মেয়েকে খুবই বকাবকিও করলো__ কিন্তু মেয়ে(পটচারা) তার নিজের জিদ্ থেকে একচুলও সরলো না। …… (ক্রমশঃ)