( গুরু মহারাজ একজনের জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে ভগবান বুদ্ধ এবং পটচারার কাহিনী উনি বলছিলেন। তার আজকেই শেষাংশ।)
….. পাগলিনীর মতো পটচারা উদভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক কিছুক্ষণ চিৎকার করতে করতে ছুটে বেড়ালো, তারপর ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় বসে হায়-হায় করতে লাগলো। তারপর পটচারা কখন যে জীর্ণবস্ত্রে, আলুলায়িত অবিন্যস্ত বেশে উন্মাদিনীর ন্যায় লোকালয়ের পথে পথে “লুট গয়া” – “হাম লুট গয়া”– করতে করতে ছুটে বেড়াতে শুরু করেছে – তা সে নিজেই জানে না। পাগলিনীকে দেখে নগরের ছোট ছোট ছেলেরা তার উপর ইঁট-পাটকেল ছুড়েছে, ফলে রক্তাক্ত হয়েছে তার মুখমন্ডল ! এই অবস্থায় কোথায় তার ধনগর্ব, যৌবনগর্ব, কুলগর্ব ! সব তখন ধুলিস্যাৎ ! সৌভাগ্যক্রমে সেই নগরেই তখন ভগবান বুদ্ধ অবস্থান করছিলেন। একজায়গায় ভগবানের সৎসঙ্গ চলছে – এমন সময় ছেলেদের অত্যাচারে বিপন্ন উন্মাদিনী সেখানে এসে হাজির হোলো। বুদ্ধের শিষ্যরা তাকে ছেলেদের হাত থেকে রক্ষা করলো এবং আশ্রয় দিল। ভগবান বুদ্ধ দূর থেকে তাকে দেখেই ভদ্র আনন্দকে পাঠালেন – পাগলিনীকে তার কাছে নিয়ে আসার জন্য ! জীর্ণবস্ত্র পরিহিত, শীর্ণকায়, আহত, উন্মাদিনী পটচারাকে ভগবান বুদ্ধের কাছে যখন নিয়ে আসা হোলো, তখন ভগবান বললেন ” পটচারা ! আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম যে, আমাদের আবার দেখা হবে – তা এখন দেখা হোলো ! কিন্তু তুমি এতো হাহাকার করছ কেন ? কি হারিয়েছে তোমার ? তুমি সঙ্গে করে (জাগতিক বিষয়, বস্তু, ব্যক্তি – ইত্যাদি) কি এনেছিলে__ যে হারাবে ? অন্তঃকরণকে কর্মের দ্বারা মলিন করেছো, তাই এতো জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগ করছো, এত হাহাকার করছো ! এবার আবার অন্তঃকরণকে স্বচ্ছ করে নাও – অন্তরে শান্তি পাবে। মানব জীবনে সুখ সাময়িক এবং সীমায়িত ! সুখভোগ হয়ে গেলেই আবার দুঃখে পড়তে হয়, ক্লেশভোগ করতে হয়। আর এই জ্ঞান হয়ে গেলেই মানুষের সুখের প্রতি আর আস্পৃহা থাকে না৷ সুতরাং হে পটচারা ! তুমি এই জ্ঞান প্রাপ্ত হও, আর অন্তঃকরণে স্বচ্ছ হও ! তারপর দেখবে তোমার জীবনে আর কোনো দুঃখ নাই –তখন দেখবে তোমার জীবনে তখন শুধু শান্তিই শান্তি !” এই কথাগুলি বলে ভগবান বুদ্ধ মেয়েটির মাথা স্পর্শ করে আশীর্বাদ করলেন।
ভগবান বুদ্ধের অমৃতময় বাণী শ্রবণে এবং তাঁর করুণাভরা স্পর্শে স্মৃতি ফিরে পেল পটচারা ! লুটিয়ে পড়ল ভগবান বুদ্ধের শ্রীচরণে –ভগবানের শরণাগত হল সে। কিছুদিনের মধ্যেই এই পটচারা মা গৌতমীর তত্ত্বাবধানে থেকে সাধন-ভজন করে সংঘারামের একজন ভিক্ষুণী হয়ে গেল ! শুধু তাই নয়, ভিক্ষুণীদের বিরচিত যে “থেরীগাথা” গ্রন্থ রয়েছে – যা পাঠ করে লক্ষ লক্ষ বৌদ্ধ ভক্তের প্রাণ জুড়ায়, সেই গ্রন্থের একজন “থেরী” ছিল এই পটচারা !
ভগবান বুদ্ধের শিক্ষা ছিল “আত্মদীপ ভব”৷ এর একটা অর্থ _ ‘নিজে দীপের ন্যায় জ্বলে ওঠো!’ একটা জ্বলন্ত প্রদীপ-ই তো পারে আরো দীপ কে প্রজ্বলিত করতে ! ভগবান বুদ্ধ এই কাজটিই করতেন।
আবার এই কথাটির অন্য ব্যাখাও রয়েছে__আত্মা যেন জ্বলন্ত প্রদীপ ! প্রদীপের যে জ্বলন্ত শিখাটা দেখা যাচ্ছে তা প্রতিনিয়তই বদলে বদলে যাচ্ছে, পলতে দিয়ে তেলের প্রবাহ আসছে আর সেটা প্রতিনিয়ত পুরে জ্বলন্ত শিখা তৈরি করছে – কিন্তু সেটা পুড়ে শেষ হোতে না হোতেই তৈলপ্রবাহ আবার নতুন করে তেল supply দিচ্ছে । এইজন্যেই আমরা শিখাটাকে ভাবছি একটাই শিখা। কিন্তু এটা ভুল ! শিখা কিন্তু সবসময়েই প্রতিটি পল-অনুপলে বদলে বদলে যাচ্ছে। এটাকেই বলা হোচ্ছে – অতীতকে প্রতিনিয়ত খাচ্ছে বর্তমান, আর যা বর্তমান – তা প্রতিনিয়ত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে ! তখন সেই ভবিষ্যতকেই আবার বর্তমান (শিখার জ্বলন্ত রূপ) বলে প্রতীয়মান হোচ্ছে৷ সুতরাং বর্তমান-ই বর্তমান! জ্ঞানীর চোখে অতীত-ভবিষ্যৎ নয়, শুধু বর্তমান-ই রয়েছে– নিত্য বর্তমান !