জিজ্ঞাসু :– আমাদের জেলার নাম বর্ধমান, জেলা শহরও রয়েছে বর্ধমান। কিন্তু সব জেলা শহরের নামে সেই জেলাটি নয় – এরূপ হবার কারন কি ?
গুরুমহারাজ :– কি যে সব জিজ্ঞাসা করিস্ বাবা ! এই নামগুলি কি কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে স্থির করেছিল নাকি – যে আমি তার কারণ বলে দেব ? কোনো স্থানের নামকরণ যে কিভাবে হয় – আর অনেক সময় কিভাবে তা বিকৃত হোতে হোতে কোথায় এসে দাঁড়ায় – এটা কি কেউ বলতে পারে ? এখানেই দ্যাখো না – বনগ্রাম বনগাঁ-য় রূপ নিয়েছে, মধ্যমগ্রাম হয়েছে মাঝের গাঁ। সাতগেছিয়ার কাছাকাছি একটা গ্রামের প্রকৃত নাম ঘনশ্যামপুর, লোকে বলে “ঘেঁচো” – ভবোতো !! কোনো মিল পাবে ? এইরকম কতো উদাহরণ পাবে। আর district town বা জেলাশহর এগুলি বেশিরভাগ-ই তো ইংরেজ আমলের সময় থেকেই চলে আসছে। পরবর্তীতে জেলা ভেঙেছে – নতুন জেলা তৈরি হয়েছে, ফলে সদর পাল্টেছে । এছাড়া হয়তো অন্য কারণেও দু-একটা জেলার নামের পরিবর্তন হয়েছে !
যাই হোক, সেইসময় থেকেই যে যে শহরগুলিতে উল্লেখযোগ্য সরকারি দপ্তরগুলি ছিল সেটাই district town ! এবার সেই শহরের নামেই জেলার নামকরণ হোতেও পারে –আবার নাও হোতে পারে ! যেমন ধরো হুগলি জেলা – এখানে ‘হুগলি’ নামেও একটি স্থান রয়েছে, কিন্তু সেটি ছোটো জায়গা, এটি কিন্তু সদর শহর নয়__ এই জেলার সদর চূঁচুড়া বা চিনসুরা। দার্জিলিং জেলায় ‘দার্জিলিং’ একটি important শৈলশহর। এটি পর্যটন কেন্দ্রও বটে ! কিন্তু বিভিন্ন সরকারি দপ্তর রয়েছে শিলিগুড়িতে। যাতায়াতের সুবিধা অর্থাৎ সড়ক, রেল, আকাশপথে যানবাহনের সুবিধা যেহেতু শিলিগুড়িতেই রয়েছে – তাই এই ব্যবস্থা। এইরকম নানান criteria রয়েছে কোন্ জেলার সদর শহর কোনটি হবে – এই ব্যাপারে। আবার দেখো, ‘নদীয়া জেলা’-য় ‘নদীয়া’ বলে কোন শহর বা স্থানই নাই। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর যেহেতু নবদ্বীপে জন্মস্থান, হয়তো নবদ্বীপ-এই শব্দটাই অপভ্রংশ হয়ে পরবর্তীতে ‘নদীয়া’ হয়েছে। কিন্তু এখানকার সদর শহর কৃষ্ণনগর।
আমাদের এখানকার জেলার নাম বর্ধমান। বর্ধমান কথাটার অর্থ ‘যা বাড়ছে’৷ কিন্তু কথিত আছে, জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর জৈনের প্রকৃত নাম ছিল ‘বর্ধমান’। মহাবীর বর্ধমান ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে যখন বাংলায় এসেছিলেন তখন উনি এখন যেটি বর্ধমান (তখন নামকরণ অন্য ছিল)– সেই স্থানে এসে উঠেছিলেন এবং ছাউনি মতো করে কিছুদিন ছিলেন। বহু মানুষ সেই সময় এই মহাপুরুষের প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলেন, তাঁর শিক্ষা গ্রহণ‌ও করতে শুরু করেছিলেন। কিছুদিন থাকার পর উনি যখন স্থানত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন –তখন স্থানীয় মানুষের মুখে শুধু ঐ মহাপুরুষের নাম‌ই বারবার উঠে আসতো ! এইভাবেই লোখমুখে স্থানটির নাম মহাবীরের নাম অনুসারে ‘বর্ধমান’ হয়ে যায়। মহাবীরের আগমন খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ বছর আগের কথা – সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এই জনপদটি খুবই প্রাচীন।
মহাবীর জৈন ওই অঞ্চল থেকে বেরিয়ে উত্তর রাঢ়ের দিকে যখন আসেন – তখন কিন্তু তাঁকে নানান প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই সময় বীরভূম, মল্লভূম, সিংভূম – এইসব নামে জনপদ ছিল বাংলায়। নামকরণ দেখেই বোঝা যায় যে এরা শক্তি-উপাসক ছিল এবং বেশ শক্তিশালী জনগোষ্ঠী এইসব স্থানে বসবাস কোরতো। মহাবীর জৈন অহিংসার বাণী প্রচার করার জন্য এইসব জনপদে এসেছিলেন কিন্তু এখানকার মানুষ শক্তি উপাসক, পাঁঠাবলি দেওয়া লোক ! ফলে, এখানকার মানুষ ওনার নীতি-কে গ্রহণ করতে পারে নি। শোনা যায় যে, মানুষজন ওনার বিরুদ্ধে কুকুর-বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিলেন। বিরক্ত হয়ে মহাবীর বর্ধমান এই স্থান ত্যাগ করে চলে যান। এরফলে ওনার ভক্তরা বহুদিন পর্যন্ত রাঢ় অঞ্চলকে ‘কুকুরের দেশ’- বলেই ডাকতো !
প্রাচীনকালে সাধারণত নদীর তীরবর্তী অঞ্চলেই শহর, নগর বা জনপদ গড়ে উঠতো। কারণ জলপথ ধরেই পণ্য একস্থান থেকে অন্যস্থানে সরবরাহ করা সুবিধাজনক ছিল। স্থলপথের যানবাহন বলতে গরু বা মোষের টানা গাড়ি – এছাড়া ঘোড়ার পিঠে বা গাধার পিঠে মাল চাপিয়ে মানুষ যাতায়াত করতো। কিন্তু স্থলপথে রাস্তাই বা তখন কোথায় ? যাও বা ছিল সেগুলি ছিল বিপদসংকুল, জঙ্গলাকীর্ণ। তুলনায় জলপথে যাতায়াত অনেক সুবিধাজনক ছিল। তাছাড়া তখন সাধারণ মানুষের তো ম্যাপ বা মানচিত্রের জ্ঞান ছিল না। ফলে নদীর গতিপথ ধরে গেলে দিকনির্দেশ বা পথনির্দেশের কোনো অসুবিধা হোতো না।
দামোদরের তীরবর্তী হওয়ায় “বর্ধমান”-ও বহু প্রাচীনকাল থেকেই একটি বিশেষ জনপদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এইতো বাবা তোমাদের সদর শহরের ইতিহাস।।