জিজ্ঞাসু :– ‘অর্হত্ব’ কথাটির অর্থ কি ?
গুরুমহারাজ :– ‘অর্হত্ব’– কথাটি এসেছে প্রাচীন পালিভাষা ‘অরিহন্ত’ থেকে। অরি অর্থাৎ শত্রু বা রিপু। জৈন মতে এবং বৌদ্ধ মতেও ‘বাসনা’-কেই বলা হয়েছে শত্রু বা অরি। কারণ, সাধন পথে অগ্রসর হ‌ওয়ার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বাধা ‘বাসনা এবং কামনা’ বলা হোলেও বাসনার অন্ত হোলেই সবকিছুরই অন্ত হয়ে যায় ! তাই ‘বাসনার শেষ’__এই অর্থে অরিহন্ত বা অর্হত্ব ! বৌদ্ধশাস্ত্রে ‘অর্হত্ব’ কথাটির খুবই উল্লেখ রয়েছে। তবে সাধন সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বেদান্তের বিশ্লেষণ আরও নিখুঁত, আরও যথাযথ।
বেদ ও বেদান্তের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী_ যে কোনো ব্যাখ্যাই করা হয়েছে ত্রিবিধভাবে, স্থূল-সূক্ষ্ম-কারণ। বৌদ্ধ বা জৈন মতে বুদ্ধত্ব বা অর্হত্ব-কেই সর্বোচ্চ স্থিতি বলেই সেরে দিয়েছে, কিন্তু বেদান্তের বিশ্লেষণে আসছে উপলব্ধি–অনুভব–বোধ। স্থূল ইন্দ্রিয় দ্বারা যে কোনো বিষয় বা বস্তুর উপলব্ধি হয়, সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয় অতীন্দ্রিয় বা মন দ্বারা কোন কিছুর অনুভব হয়, আর কারণগত বা আধ্যাত্মিক যেটি – সেটি অধীত হলে তাকে বলা হয় ‘বোধ’। এইজন্যেই বলা হয় ‘আত্মবোধ’ বা ‘ব্রহ্মবোধ’।
‘আত্মোপলব্ধি’ বা ‘ব্রহ্মপোলব্ধি’ কথাগুলি মানুষকে বোঝানোর জন্য বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে বটে, কিন্তু মনে রাখতে হবে ব্যাকরণে ‘উপ’ কথাটি উপসর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ‘উপ’ কথাটি কোনো শব্দের আগে বসা মানেই সেই শব্দের মানের তারতম্য ঘটে এবং অবমূল্যায়ন হয়। কিন্তু ‘আত্মা’ বা ‘ব্রহ্ম’ শব্দের কোনো প্রতিশব্দ বা উপশব্দ হয় না। তাই সঠিক অর্থে ‘আত্মবোধ’ বা ‘ব্রহ্মবোধ’। এটিই জীবের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে পৌঁছালে জীব আর জীব থাকে না – সে নিজেই শিব হয়, ঈশ্বরস্বরূপ হয়ে ওঠে। তাঁকে তখন ‘জীবন্ত বিগ্রহ’ বলা হয় ! শাস্ত্র ‘ব্রহ্ম’-কে বর্ণনা করেছে “সচ্চিদানন্দময়” হিসাবে, আত্মা বা ঈশ্বরকে বর্ণনা করেছে “সচ্চিদানন্দঘন” হিসাবে। আর সেই অখন্ড তত্ত্ব যখন খন্ডাকারে, অসীম যখন সীমার মাঝে ধরা দিয়ে ধরার ধুলায় অবতীর্ণ হ’ন, সেই ঈশ্বরের অবতারকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছে “সচ্চিদানন্দঘনবিগ্রহ” । যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ,মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ “সচ্চিদানন্দঘনবিগ্রহ”।।