জিজ্ঞাসু :– গুরুজী_ মানুষ তো দেখছি এখন পশুতে পরিণত হয়েছে ! প্রতিদিন খবরের কাগজের নানা ঘটনা পড়ে – তাইতো মনে হয় !
গুরুমহারাজ :– দ্যাখো, মানুষকে পশুর সাথে তুলনা কোরো না ! তুমি যা বলতে চাইছো__মানুষে-মানুষে হিংসা, নারীদের প্রতি লোলুপতা এবং ব্যভিচার, দূর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার–এগুলি তো ? এগুলি মনুষ্যত্ববিহীন মানবের কাজ !
আর পাশবিক প্রবৃত্তি বলতে যা বোঝায়__ সেগুলিকে ‘জৈবিক প্রবৃত্তি’ বলা ভালো। জৈবিক প্রবৃত্তি যেমন – আহার, নিদ্রা, ভয়, বাঁচা এবং বাড়ার তাগিদ ইত্যাদি। কিন্তু কোথাও খুন-ধর্ষণ, প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ, নিষ্ঠুরতার বহিঃপ্রকাশ– এগুলিকে পাশবিক কেন বলা হবে ? এটা বলা মানে তো পশুদেরকে অপমান করা ! পশুরা তো এইসব করে না ! ওরা প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলে – ওরা কখনোই ব্যভিচার করে না। ওদের এক এক প্রজাতির এক একটি নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে – ওরা সেই নিয়ম-কে follow করে। নির্দিষ্ট time ছাড়া ওদের জননক্রিয়া হয় না, খাদ্য-খাদক সম্পর্কেই শক্তিশালী পশু অন্য পশুকে হত্যা করে। সন্তান রক্ষার জন্য, খাদ্যের প্রয়োজন আর বংশরক্ষার তাগিদে ওরা পরস্পরে বা একই প্রজাতির মধ্যে লড়াই করে ! একমাত্র তখন‌ই তারা পরস্পর পরস্পরকে হত্যাও করতে পারে ! কিন্তু এটাও পশু প্রজাতির প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যেই পড়ে।
কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এইরকম কোনো নিয়ম নাই – এখানে বেশিরভাগটাই বেনিয়ম বা অনিয়ম। প্রায় কেউই প্রকৃতির অনুকূলে নেই – সবাই স্বপ্রকৃতির বিরোধ করছে এবং ফলতঃ বিশ্বপ্রকৃতি বা মহাবিশ্বপ্রকৃতির নিয়মকেও violet করছে। আর সেইজন্যই মানুষের সমাজে এত হাহাকার ! মানুষ তার নিজের সহজতা বা প্রাকৃতিক সহজতা অর্থাৎ তার naturality-কে হারিয়ে যেন সর্বস্বান্ত হয়ে কাঁদছে, কষ্ট পাচ্ছে !
শ্রীমদ্ভাগবতে ভগবান কৃষ্ণের ‘গিরি গোবর্দ্ধন ধারণ’-এর একটি কাহিনী রয়েছে। সেখানে বর্ণিত আছে যে, দেবরাজ ইন্দ্র একবার বৃন্দাবনবাসীর উপর খুব রেগে গিয়েছিল । কারণ ওই স্থানে তখন দীর্ঘদিন ধরে ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করার জন্য কোনো হবন হচ্ছিলো না। তাই ইন্দ্র রুষ্ট হয়ে সৃষ্টি করলো ভীষণ ঝড়, ঝঞ্ঝা, প্লাবন ! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বৃন্দাবন বা ব্রজভূমিতে present ! ফলে তিনি সকলকে তাদের গবাদি নিয়ে গিরি গোবর্দ্বনে এসে উপস্থিত হোতে বললেন এবং তিনি গিরি গোবর্দ্ধন এক হাতে তুলে ধরে সকলকে রক্ষা করলেন। এবার কথা হোচ্ছে যে, এই কাহিনীর তাৎপর্য কি ? এখানে ‘ইন্দ্র’ হচ্ছে ইন্দ্রিয়গণ এবং তাদের অধিপতি মন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতিতে বৃন্দাবনে তখন অপ্রাকৃত লীলা চলছিল – ইন্দ্রিয় সেবার বা স্থূল ভোগ-সুখের আস্পৃহা বৃন্দাবনবাসীর আর ছিল না৷ সাধকের ক্ষেত্রে যখন বিবেকের জাগরণ হয়, জাগ্রত বিবেকের প্রহরায় সে সাধন -ভজন করে _ তখন তার দ্বারা আর কোনো স্থূল বিষয়ের ভোগস্পৃহা থাকে না । তখনই ইন্দ্রিয়গণ এবং তাদের অধিপতি মন নানাভাবে সাধককে বিচলিত করে, নানাভাবে তাকে টলাবার চেষ্টা করে। এটা যে কোনো ব্যক্তি, যারা ধ্যান-জপ করে বা যারা ব্রহ্মচর্য পালনের চেষ্টা করে অথবা আধ্যাত্মিক জীবনে সাধন-ভজনের দ্বারা উন্নীত হওয়ার চেষ্টা করছে – তারা সবাই এই সকল ব্যাপার একটু-আধটু জানে।
ভাগবতে রয়েছে _এইরকম অবস্থায় কৃষ্ণ গিরিগোবর্ধন-কে উঁচুতে তুলে ধরলেন ! এর তাৎপর্য হোলো _ সদাসদ্ বিচার, ভালো-মন্দের বিচারের দ্বারা এবং জাগ্রত বিবেকের প্রহরায় সাধককে তার জ্ঞান বিচারের ধারাকে উচ্চে (ঊর্দ্ধে) তুলে ধরে রাখতে হয়। বিচার নিম্নমুখী হোলেই কামনা -বাসনারূপ ভোগের প্লাবনে ভেসে যায় সাধক।
“না–না! জাগতিক ভোগ-ঐশ্বর্য্য আমার জন্য নয়, ওটা অন্যেরা করুক ! আমি সকলের ঊর্ধ্বে – আমার চেতনা ঊর্ধ্বে, আমার দৃষ্টি সর্বদা ঊর্ধ্বে (অধ্যাত্ম) লোকের দিকে “__ এইরূপ ঊর্ধ্বমুখী বিচার-ই সাধককে প্রলোভনের জগৎ, ইন্দ্রিয় সুখের জগৎ থেকে রক্ষা করে। এইটাই হোলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ‘গিরি গোবর্দ্ধন’-ধারণের তাৎপর্য্য !
সে যাই হোক, তোমার কথার উত্তরে অনেক কথা বলে ফেললাম। সাধারণ মানুষের অবস্থা দেখে স্বামী বিবেকানন্দ একবার দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন_”মানুষ কি আর মানুষ আছে রে বাপ!” সত্যিই তো, মনুষ্যত্ববিহীন মানুষের কি “মানুষ”_ এই পরিচয় দেওয়া সাজে ? এদেরকে ‘অমানুষ’ বলা হয়__কিন্তু ‘পশুমানব’ বলা হয় না,–তাই না ! সেই জন্যই তোমাকে বলছিলাম _এদেরকে পশু বোলো না, এরা মানুষের শরীর পেয়েছে ঠিকই কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারে নি।