জিজ্ঞাসু :– দেখুন গুরুজী, ঐসব শেষের দিনের কথা শুনতে আমাদের ভালো লাগে না ! তার চেয়ে বরং আপনি আপনার প্রথম বনগ্রামে আসার ঘটনাটাকে আরো বিস্তারিত বলুন !!
গুরুমহারাজ :– (জিজ্ঞাসুর ঐ কথা শুনে গুরু মহারাজ হেসে ফেললেন, তারপর আবার কথা শুরু করলেন…)
দ্যাখো, পৃথিবীতে সত্যের মুখোমুখি হ‌ওয়ার, সত্য কথা শোনার সৎসাহস খুব কম জনেরই থাকে । তাই সত্যকথা শুনতে তোমার‌ও ভালো লাগলো না ! যাই হোক, তুমি যা শুনতে চাইছো__সেটাই বলি ! হ্যাঁ, ওই প্রথম দিনেই ✓রী-মা আমাকে এই স্থানের ব্যাপারে সবকিছুই দেখিয়ে দিয়েছিলেন । তবে ওখানে যারা প্রথম আমাকে দেখেছিল, তারা প্রায় সবাই আমার ঐরকম ভাবস্থ অবস্থা দেখে একদম ঘাবড়ে গেছিল – বিশেষত বাড়ির মায়েরা তো খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ৷ তখন দুই বাড়িতেই দুজন বৃদ্ধা মা (মুখার্জি এবং গাঙ্গুলীর বাড়ি, দু’জনকেই গুরুজী ‘বুড়োমা’ বলতেন) ছিলেন । তাঁরা দুজনেই খুব বেশি কাতর হয়ে পড়েছিলেন ৷ কিন্তু সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ থাকায় সুবিধা হয়েছিল, কারণ ভাবস্থ অবস্থা থেকে কিভাবে সাধারণ অবস্থায় আনতে হয়, তার কায়দা তৃষাণ-দেবেন্দ্রনাথ এরা জানতো ।
সেদিন রাত্রে একটু গানের আসর বসেছিল, আসলে দেবেন্দ্রনাথ বাড়ির লোকেদের বলেছিল যে, রবীনদা(তখন সবাই গুরুজীকে ‘রবীনদা’ বলেই ডাকতো) গান শুনতে খুব ভালোবাসে। এই কথা শুনে বাড়ির লোকজনেরা গানের সরঞ্জাম যোগাড় করে গানের আসর বসিয়েছিল ! সেদিন অনেকের সাথে ন’কাকাও গান গেয়েছিলেন, উনি শ্যামাসঙ্গীত গেয়েছিলেন ৷ সেদিন ওখানে মায়ের নাম এবং হরিনামও হয়েছিল ৷
প্রথমবারে বনগ্রাম গিয়ে আমি কয়েকদিন মাত্র ছিলাম ! আর ওই সময়ে বনগ্রামেই যে আমার কর্মক্ষেত্র হবে বা ওখানেই নতুন করে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে হবে, divine plan-এর এইসব ব্যাপারগুলির প্রায় সবটাই মা জগদম্বা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন । ‘প্রায়’ বললাম কারণ__ কেন জানি না, আমার মনে হচ্ছিলো– ✓রী-মা যেন তৎক্ষণাৎ কিছু করার ব্যাপারে ঠিকমতো অনুমতি দিচ্ছিলেন না ! তবু ন’কাকা, তৃষাণ, এবং গ্রামের অন্যান্য কিছু ভালো মানুষেরা মিলে– গ্রাম থেকে একটু দূরে (অর্থাৎ বর্তমানে যেখানে আশ্রম তৈরি হয়েছে) পরিত্যক্ত একটা জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায়–যেখানে লোকে মরা গরু-ছাগল ফেলতো অর্থাৎ গ্রামের ভাগাড়, ওখানেই একটা ছোট কুঁড়েঘর করার কথা স্থির করেছিল ।
গ্রামের স্বপন খুড়োর মা এবং পরে ভাণ্ডুলের একজন মা__আশ্রমের জন্য এক টুকরো করে জায়গা দান করতে রাজি হয়েছিল ৷
সকলের আলোচনা-মতোই, ওখানে একটা ছোট্ট কুঠিয়া তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তখনও আমি ✓রী মায়ের কাছে কোনো পাকাপাকি নির্দেশ পাচ্ছিলাম না ! সেইজন্য আমি তখন বিভিন্ন কাজে এদিক ওদিক ঘুরছিলাম । কিছুদিনের মধ্যেই বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেল, ফলে আমার ঘর তৈরী হয়ে হোলেও আমার আসা হয় নি !
কিন্তু আশ্বিন মাসের প্রথমদিকেই শুরু হোলো প্রলয়ঙ্করী বন্যা (১৯৭৮ সালের ২৭-২৮শে সেপ্টেম্বর) ! পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ জেলাতেই বন্যার প্রকোপে মানুষের সে কি দুর্দশা ! আমি তখন দামোদরের ধারের গ্রাম চক্ষনযাদীতে অর্থাৎ টগরদের বাড়িতে। ওই গ্রামে তখন পাকা স্কুলবাড়ি ছাড়া, আর মাত্র দু-একটাই পাকা বাড়ি ছিল ! প্রবল বন্যার প্রকোপে তখন বাকি সব কাঁচা বাড়ি একেবারে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছিলো ৷ গ্রামের মানুষজন, তাদের গবাদিপশু যেগুলো তখনো বেঁচে ছিল, সেগুলিকে নিয়ে কোনো উঁচু জায়গায় অথবা নদীর বাঁধে এসে আশ্রয় নিয়েছিল ৷ আর প্রচুর মানুষ হয় ওই গ্রামের পাকা স্কুল বিল্ডিং-এ অথবা টগরদের বাড়িতে এসে উঠেছিল। টগরদের পরিবার সহ আমিও তখন টগরদের ঐ বিল্ডিংয়েই ছিলাম। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়লে মানুষের যে কি করুণ অসহায় অবস্থা হয়, তা আমি সেইসময় নিজের চোখে দেখেছিলাম !
বন্যার সময় চারিদিকে শুধু জল,জল আর জল ! নদীর বাঁধ ভেঙে গলগল্ করে জল ঢুকছে গ্রামের ভিতরে, আর মাটির বাড়িগুলো ধড়াস্ ধড়াস্ করে পড়ছে ! সে কি মর্মান্তিক দৃশ্য ! কত যে গবাদিপশু চাপা পড়ে মারা গেছিলো তার ইয়ত্তা ছিল না, ঐ অঞ্চলের মানুষজনও কিছু মারা গেছিলো ! যারা বেঁচে ছিল তাদেরও কি নিদারুন অবস্থা ! ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ স্থান দেখে চলে এসেছে ঠিকই__কিন্তু কারো কাছে খাবার নাই, পানীয় জল নাই, শৌচ করার জায়গা নাই – এক জায়গায় প্রচুর মানুষ কোনোরকমে সময় কাটাচ্ছিলো ! অবস্থাটা কি তোমরা ধারণা করতে পারছো ?
টগরের মা ঘরের চাল-আটা সব বের করে দিয়েছিলেন ! ওনার মাতৃহৃদয় সবার জন্য কেঁদে উঠেছিল। চাল শেষ হয়ে যাবার পর, ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে যাইহোক কিছু তুলে দেবার জন্য আমি__টগরসহ কয়েকজন যুবককে নিয়ে রুটি বানাতে শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল distribution-এর সময়! এতো বেশি সংখ্যক লোক আর অল্প খাবার। ফলে খাদ্যের Rationing করতে হোলো। বাচ্ছা এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দুটো করে রুটি আগে দেওয়া হবে, তারপরে দেওয়া হবে__ যুবক-যুবতীদের।
কিন্তু ক্ষুধা(প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ) যে কি মারাত্মক জিনিস__ সেই সময় আমি দেখেছিলাম। শিশুর জন্য বরাদ্দ দু’খানা রুটি মায়ের হাতে দেওয়া মাত্রই, একখানা রুটি মা নিজেই হাঁউহাঁউ করে খেয়ে নিচ্ছিলো ! সেইদিনেই ✓রী-মা জগদম্বা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, মানুষ নিজেকেই সবচাইতে বেশি ভালোবাসে । মা, সন্তানের জন্য নিজের জীবন দিতে পারে ঠিকই__কিন্তু ঐ সংকটকালে দেখেছিলাম, আপন প্রাণ বাঁচাতে মায়ের অপত্য স্নেহ‌ও হার মেনে যায় !
ওখানকার মানুষগুলি ঐ অবস্থায় চরম দুর্গতির মধ্যে বেশ কয়েকদিন থাকতে বাধ্য হয়েছিল । সরকারি বা বেসরকারি relief আসতে অনেকটাই দেরী হয়েছিল৷ যতদিন না সরকারি সাহায্য এসেছে, ততদিন আমরাই গ্রামের যুবকদের নিয়ে relief-work এর কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম ।
এদিকে বনগ্রামে ওরা (ন’কাকা বা গ্রামের অন্যরা) যে মাটির ছিটেবেড়ার কুঁড়েঘরটি বানিয়েছিল, সেটি বন্যায় এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিতে আবার পড়ে যাবার মতো অবস্থা হয়েছিল। ওই বন্যায় তৃষান(স্বামী পরমেশ্বরানন্দ), খোকন(স্বামী আত্মানন্দ), মিহির(স্বামী প্রজ্ঞানন্দ) – ওরাও একে একে চক্ষনযাদীতে গিয়ে হাজির হয়েছিল এবং ওরাও আমাদের সঙ্গে ওখানকার মানুষদের সেবার কাজে হাত লাগিয়েছিল! তবে, ওদের সবার বক্তব্য ছিল– ‘এখানে তো সবাই একে একে নিজের নিজের ভিটেতে (যদিও ভিটে বলে তখন কিছুই ছিল না, গ্রামবাসী সকলকেই নতুন করে সাময়িকভাবে চালাঘর তৈরি করে নিতে হয়েছিল) ফিরে যাচ্ছে, অতএব আমার‌ও এইবার বনগ্রামে ফিরে যাওয়া উচিৎ’।
আমি ওদের আশ্বাস দিয়েছিলাম – “ঠিক আছে, তবে এক্ষুনি নয় ! তোমরা ফিরে যাও, নির্দিষ্ট সময়ে আমি ঠিকই চলে যাবো।” আমার কথায় ওরা চলে গেল__তবে আমার কাজ মেটাতে আরো কিছুদিন লেগে গেল। এরমধ্যে বনগ্রামে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে ন’কাকা আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। …. [ক্রমশঃ]