[গুরু মহারাজ, “মেরা ভারত মহান”_ এই সংক্রান্ত জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন…] …… আমি ছোটবেলা থেকেই পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক – এইসব নিয়ে অনেক কথা শুনেছিলাম ! পরে বিচার করে কি দেখলাম জানো— ‘পাপ’ ভাবাটাই পাপ ! ‘পাপ’ এই কথাটা মুখে বলাই পাপ। আর পুণ্য-ও তাই ! সুতরাং ‘পুণ্য’-‘পুণ্য’ বলাই ভালো।
ভারতীয়দের স্বর্গ যেমন কল্পনা – তেমনই semitic-দের রয়েছে “জেন্নত” বা heven ৷ ভারতীয়দের স্বর্গে দেবতারা থাকে, সবাই অমর, সবাই রূপবান-রূপবতী, সেখানে শুধুই ভোগ আর ঐশ্বর্য্য ! সবসময় সুন্দরীরা গান-বাজনা-নাচ করছে ইত্যাদি। জেন্নতে-ও তাই – সেখানেও সুরা, মধু, দুধ আর জলের নদী রয়েছে, বুলবুল পাখি গাছে বসে গান গায়, সবুজ গাছে ফুল ফুটে আছে আর সেই ফুল খুবই সুগন্ধী ! আর এগুলি সবই চিরস্থায়ী অর্থাৎ পাখির গান বন্ধ হবে না – নদীর প্রবাহ বন্ধ হবে না, ফুলের সৌরভ থেকেই যাবে, সবসময়েই পূর্ণিমার চাঁদ বিরাজমান থাকবেইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দ্যাখো, এইসব স্বর্গ কল্পনায় যা কিছু রয়েছে সবই মানুষের ভোগের সামগ্রী ! কিন্তু পৃথিবীতে তো দুটো জগত রয়েছেভোগের জগত এবং ত্যাগের জগত। ভোগপ্রবণ মানুষকে এগুলি আকর্ষণ করতে পারবে কিন্তু ত্যাগপ্রবণ ব্যক্তির কাছে এগুলির কি মূল্য আছে ? দ্যাখো না স্বামী বিবেকানন্দ যখন আমেরিকায় ছিলেন, তখন ওনাকে আমেরিকান ভক্তরা বিশেষতঃ মহিলা ভক্তরা যে সব স্থানে থাকার ব্যবস্থা করতো, তা তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার বিচারে ‘স্বর্গসুখে রাখা’ বলা চলে ! কিন্তু কই উনি তো তাতে মজে গেলেন না ! আর শুধু ‘মজে গেলেন না’ তাই নয় –ঐ সব ভোগ-ঐশ্বর্য জনিত সুখকে গ্রাহ্যই করলেন না! উনি নিজের লক্ষ্যে এবং আদর্শে অবিচল রইলেন। শয্যা-পালঙ্ক ছেড়ে মাটিতে শুয়ে রাতের পর রাত কাটাতেন।।
তবু দ্যাখো, ঐ ত্যাগব্রতী সন্ন্যাসীর ত্যাগ-আদর্শ প্রদর্শনের ফল কি হোলো – ঐ সব আমেরিকান ধনীর দুলালীরা স্বামীজীর পিছু পিছু তৎকালীন পরাধীন, অর্থনীতি -সমাজনীতিতে পিছিয়ে থাকা, হতদরিদ্র দেশ এই ভারতবর্ষে চলে এলো !
এইজন্যই তো সাধু সন্তদেরকে বলা হয় মহারাজ !! প্রকৃতঅর্থে যাঁরা সাধু, তাঁরা কখনও জাগতিক সুখ-সমৃদ্ধি, ধন-সম্পদের পিছনে দৌড়ান না। এইগুলিই প্রকৃত ত্যাগী-সন্ন্যাসীর পিছন পিছন ঘোরে !
তাছাড়া এটাও জেনে রাখবে _ এই জগত সংসারের কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। সবসময় সুন্দর বা ভালো ভালো জিনিস, সুস্বাদু খাবার, সুগন্ধি দ্রব্য নিয়ে যদি থাকা হয়_তাহলে দেখা যাবে যে, কিছুদিন পরে আর সেগুলি ভালো লাগবে না ! প্রতিদিনই যদি পূর্ণিমা হয় – তখন আর পূর্ণিমার কদর থাকবে না –সেটা boring হয়ে যাবে ! সুখ ক্ষণিকের – তাই ভালো লাগে। ১৪ দিন ধরে চন্দ্র কলায় কলায় বেড়ে তবেই একদিনের জন্য পূর্নিমা হয় – তাই ভালো লাগে ! Qualitative জিনিস পৃথিবীতে সবসময়ই কম। পর্বতের চূড়া দেখেছো তো – base-টা কত বিরাট আর top কত কম ! দূর থেকে মনে হয় যেন একটা বিন্দু ! ধাতুদের মধ্যে সোনার দাম যে এতো বেশি, কদর এতো বেশি – তার কারণ প্রকৃতিতে এটি খুবই কম পাওয়া যায়। যেখানে লৌহ আকরিক হাজার কেজিতে ৬০০ থেকে ৭০০ কেজি পাওয়া যায়, সেখানে সোনার হাজার কেজি আকরিকে ১৪-গ্রাম মাত্র সোনা পাওয়া যায়। এইরকমই পৃথিবীতে ৫০০ কোটি মানুষের মধ্যে ভালো মানুষের সংখ্যা খুবই কম ! তেমনি ভালো মানুষদের মধ্যে আবার মহাপুরুষের সংখ্যা খুবই সামান্য, হয়তো কোটি কোটি মানুষে দুই-এক জন থাকে। যাইহোক, semitic-দের স্বর্গ কল্পনায় শুধু ভোগের সামগ্রীরই বিবরণ রয়েছে। ওখানে যে হুর বা হুরীরা রয়েছে তাদের চির-যৌবন ! হুরীদের চোখ তৈরি হয়েছে তারা দিয়ে, তাদের চুল তৈরি হয়েছে আকাশ দিয়ে ! আর তাদের সঙ্গ যত খুশি করো – কখনোই ক্লান্তি আসবে না। আর তিনটে সদা প্রবাহিত নদী রয়েছে সেখানে– সুরার নদী, মধুর নদী আর দুধের নদী ! ব্যাপারটা বুঝতে পারছো তো ? এইভাবে কি কিছু হয় ? আরবের মরুভূমিতে জলের আকালতাই পানির নদী, সুরা নেশার দ্রব্যশরীরে স্ফূর্তি আনে, মধুতে ও নেশা হয়তাছাড়া এটি ক্লান্তিনাশক-বলপ্রদ তাই এইগুলির সেখানে প্রাচূর্যের লোভ দেখানো হয়েছে। যা এখানে অপরিমিত, যথেচ্ছ গ্রহণে বাধা, অথচ যেগুলি সুখপ্রদ এবং ভোগের সামগ্রী সেগুলিকে কল্পনায় আনা হয়েছে !
Semitic-দের ধর্মগ্রন্থ লেখা হয়েছে মরুভূমিতে – ওখানে সারাদিনের প্রচণ্ড দাবদাহের পর রাত্রিটাই মানুষের কাছে আরামদায়ক ! এখনও মরুভূমির মানুষ রাত্রেই আনন্দ করে, সবাই খোলা আকাশের নিচে বসে, গান গায়, নাচে। এবার পূর্ণিমার রাত্রিতে মরুভূমি যখন জ্যোৎস্নালোকিত হয়, তখন ওখানকার মানুষের আর আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকেনা ! এইজন্যই ওখানের প্রতীক চাঁদ-তারা—সূর্য নয় ! সূর্য মানেই দাবদাহ, দুর্বিষহ গরম ! মরুভূমিতে তাই রবি এখানকার মতো জীবনদায়ী দেবতার মর্যাদা পায় না। …. (ক্রমশঃ)