জিজ্ঞাসু(একজন হিন্দিভাষী ভক্ত) :– “কথনী আউর করনী”- মে যো ফর্ক, ইহ সবকোই কো হোতা হ্যায় ক্যায়া ? (কথায় এবং কাজে যে পার্থক্য – এটা কি সবার হয় ?)
গুরু মহারাজ :– তা কেন হবে ? সবার কেন হবে ? আমজনতা বা সাধারণ মানুষের এমনটা হয় –আর এটা থেকে উঠে আসার(আধ্যাত্মিক উন্নতি) জন্যই তো সাধনা ! সাধনায় সিদ্ধ হোলে এই ‘ফর্ক'(ফারাক্) আর থাকে না। অবতার পুরুষ বা যুগপুরুষদের তো কখনোই এমনটা হয় না, মহাত্মা মহাপুরুষদেরও হয় না। কোনো কোনো মহাসাধক বা মহাপুরুষ অনেক সময় এমন আচরণ করেন যা দেখে মনে হয় – উনি বোধহয় আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই ! অবশ্য সত্যি সত্যিই তাঁদের চালচলন, আচার-আচরণ সাধারণ মানুষের মতোই হয়। কিন্তু জানবে __ওইরূপ আচরণের নিশ্চয়ই কোনো প্রয়োজন ছিল, তাই তাঁরা এমনটা করেছেন। কিন্তু তাঁদের কথায় ও কাজে সবসময় সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য পাবে ৷
আমি একবার হিমালয়ে তীর্থযাত্রার পথে এক মন্দিরে দেখেছিলাম কয়েকজন সাধু সন্ধ্যার সময় ধুনি জ্বালিয়ে বসে সাধন-ভজন এবং ধর্মালোচনা করছিলেন। তারপর ঐ আগুনেই ওনারা কিছু রুটি বানাতে শুরু করলেন। ওনাদের কথা শুনে বুঝলাম__ ওনারা কাছাকাছি কোনো গ্রাম থেকে ময়দা ভিক্ষা করে এনেছিলেন এবং তা দিয়েই ঐ রুটি তৈরি হোচ্ছিলো । এইবার একটু ‘লসুন কা চাটনি’ দিয়ে দু-চারটি পোড়া রুটি আনন্দের সঙ্গে খেয়ে সারারাত ভগবৎ চর্চা বা ধ্যান করে মন্দিরের বাইরে গাছতলাতেই কাটিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
এরপর কি হোলো জানো__ হঠাৎ দেখলাম কিছু তীর্থযাত্রী ঐ পথ ধরেই আসছিল, কয়েকজন সাধুবাবা ধুনির সামনে বসে আছেন দেখে_তারা সাধুবাবাদের মুখ থেকে কিছু শোনার উদ্দেশ্যে তাদের দিকে আসতে শুরু করলো। এরপর হোলো কি __ সাধুরা যেই ঐ লোকগুলিকে ওদের দিকে আসতে দেখলো – অমনি তৎক্ষনাৎ ওরা রুটি ভাগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-গন্ডগোল, এমনকি মারামারি শুরু করে দিল !
তীর্থযাত্রী যে লোকগুলি আসছিল – তারা সাধুদের এইসব করা দেখে, নিজেদের মধ্যে হাসি-মশকরা করতে করতে ফিরে গেল। আমি শুনতে পেলাম, তারা বলতে বলতে যাচ্ছিলো – ” ইয়ে সব পেটুক লোগ্__ ক্যায়সে সাধু বন্ গিয়া ?”
লোকগুলো চলে যেতেই সাধুরা আবার ধুনির সামনে বসে খাওয়া সেরে ধ্যানে বসার তোড়জোড় শুরু করলো। আমি ওখানেই ছিলাম, পুরো ঘটনাটা দেখছিলাম – ওনাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম – “এটা কি হোলো ?” ওনারা বললেন – ” ক্যায়া করেগা ! ইস কিসম কা আদমীলোক ইঁহা ধরম্ কে লিয়ে নেহি আতা ! উন্ লোগো বক্ওয়াস করেগা, হমারা ওয়াক্ত বরবাদ করেগা ! ইসি লিয়ে ভগা দিয়া !”। দ্যাখো, এখানে কিন্তু ওনাদের ‘কথনী আউর করনী’র মধ্যে ‘ফর্ক’ রয়েছে ! কিন্তু সেটা করা হোলো একটা মহান উদ্দেশ্যে !
আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি শোনো – কালনার ভগবানদাস বাবাজীর আশ্রমে যেদিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গিয়েছিলেন, সেদিন প্রথমটায় ভগবানদাস বাবাজী আরো দশজন ভক্তদের সাথে, মাথায় ঘোমটা দেওয়া গুটিসুটি মেরে বসে থাকা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে চিনতে পারেন নি, কিন্তু ভগবানের গায়ের গন্ধ (মধু, চন্দন, পদ্ম ইত্যাদির মিলিত অপার্থিব সুগন্ধ) পাচ্ছিলেন ! তখন ভগবান দাসজী ছলনার আশ্রয় নিলেন। হঠাৎ করে উপস্থিত ভক্তজনদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি নিজেকে জাহির করতে শুরু করে দিলেন। আর যায় কোথায় ! ঠাকুর মাথায় ঢাকা দেওয়া চাদর খুলে ঝেড়ে-মেরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং ভগবানদাসকে উদ্দেশ্য করে ভগবানসুলভ নির্দেশ দিতে থাকলেন !
এইভাবেই একটু চালাকির আশ্রয় নিয়ে সেদিন একজন ভগবদ্ ভক্ত পেয়ে গিয়েছিল তার আরাধ্য ভগবানের দর্শন ! তাহলে এক্ষেত্রে ভগবানদাসের সাময়িক এই “কথনী আউর করণী”র ফর্ক দেখে কি বিচার করবে – বলো ?
শ্রীল প্রভুপাদ অভয়চরণের জীবনে আবার ‘য্যায়সা কথনী,ওইসা করনী’ ! উনি সকলকে যা সবসময় বলতেন _সেটাই জীবনে করে দেখিয়েছিলেন। উনি একটা অফিসে চাকুরী করতেন – কিন্তু ওনার জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল গীতার মাহাত্ম্য প্রচার, বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও প্রসার ! এই কথা উনি কিন্তু ওনার চারপাশের মানুষদের প্রায়ই বলতেন – কিন্তু তারা বিশ্বাস তো করতোই না বরং ওনাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো !
উনি চাকুরীরত অবস্থাতেই একটু একটু করে গীতার ইংরেজি অনুবাদ করে রেখেছিলেন। এবার চাকুরীর শেষে যে টাকাটা পেলেন – সেই টাকায় ওই অনুবাদটি কয়েক হাজার কপি ছাপিয়ে নিয়ে চলে গেলেন সোজা আমেরিকায় অর্থাৎ USA-তে। প্রথমাবস্থায় ওখানে একটা মাথাগোঁজার ভালো ঠাঁই শুদ্ধ ওনার ছিল না ! একটা হাতে-ঠেলা ট্রলিতে গীতার ইংরেজি অনুবাদের কপি, মহাপ্রভুর কিছু বাণীর ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে –ঠেলাটা ঠেলতে ঠেলতে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। আর যেখানে কিছু লোকজন রয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে খঞ্জনি বাজিয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং আগ্রহী লোকজনদের ডেকে ডেকে বিনামুল্যে গীতার একটি করে কপি (ইংরেজি অনুবাদ) দিয়ে দিতেন। এইভাবে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা, এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরে ঘুরে উনি গীতার মহিমা, কৃষ্ণনাম, বৈষ্ণব-দর্শন প্রচার করেছিলেন। আর তারই ফলস্বরূপ আজকের ‘ইসকন’, যা আজ গোটা পৃথিবীতে হরিনামের প্লাবন বইয়ে দিচ্ছে ! ভারতবর্ষের গৌড়িয় বৈষ্ণব দর্শনকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।।
তাহলে বুঝতে পারলে তো – আপাতত মনে হোলেও, প্রকৃতপক্ষে মহাত্মা-মহাপুরুষদের কথা আর কাজের মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না !
গুরু মহারাজ :– তা কেন হবে ? সবার কেন হবে ? আমজনতা বা সাধারণ মানুষের এমনটা হয় –আর এটা থেকে উঠে আসার(আধ্যাত্মিক উন্নতি) জন্যই তো সাধনা ! সাধনায় সিদ্ধ হোলে এই ‘ফর্ক'(ফারাক্) আর থাকে না। অবতার পুরুষ বা যুগপুরুষদের তো কখনোই এমনটা হয় না, মহাত্মা মহাপুরুষদেরও হয় না। কোনো কোনো মহাসাধক বা মহাপুরুষ অনেক সময় এমন আচরণ করেন যা দেখে মনে হয় – উনি বোধহয় আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই ! অবশ্য সত্যি সত্যিই তাঁদের চালচলন, আচার-আচরণ সাধারণ মানুষের মতোই হয়। কিন্তু জানবে __ওইরূপ আচরণের নিশ্চয়ই কোনো প্রয়োজন ছিল, তাই তাঁরা এমনটা করেছেন। কিন্তু তাঁদের কথায় ও কাজে সবসময় সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য পাবে ৷
আমি একবার হিমালয়ে তীর্থযাত্রার পথে এক মন্দিরে দেখেছিলাম কয়েকজন সাধু সন্ধ্যার সময় ধুনি জ্বালিয়ে বসে সাধন-ভজন এবং ধর্মালোচনা করছিলেন। তারপর ঐ আগুনেই ওনারা কিছু রুটি বানাতে শুরু করলেন। ওনাদের কথা শুনে বুঝলাম__ ওনারা কাছাকাছি কোনো গ্রাম থেকে ময়দা ভিক্ষা করে এনেছিলেন এবং তা দিয়েই ঐ রুটি তৈরি হোচ্ছিলো । এইবার একটু ‘লসুন কা চাটনি’ দিয়ে দু-চারটি পোড়া রুটি আনন্দের সঙ্গে খেয়ে সারারাত ভগবৎ চর্চা বা ধ্যান করে মন্দিরের বাইরে গাছতলাতেই কাটিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
এরপর কি হোলো জানো__ হঠাৎ দেখলাম কিছু তীর্থযাত্রী ঐ পথ ধরেই আসছিল, কয়েকজন সাধুবাবা ধুনির সামনে বসে আছেন দেখে_তারা সাধুবাবাদের মুখ থেকে কিছু শোনার উদ্দেশ্যে তাদের দিকে আসতে শুরু করলো। এরপর হোলো কি __ সাধুরা যেই ঐ লোকগুলিকে ওদের দিকে আসতে দেখলো – অমনি তৎক্ষনাৎ ওরা রুটি ভাগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-গন্ডগোল, এমনকি মারামারি শুরু করে দিল !
তীর্থযাত্রী যে লোকগুলি আসছিল – তারা সাধুদের এইসব করা দেখে, নিজেদের মধ্যে হাসি-মশকরা করতে করতে ফিরে গেল। আমি শুনতে পেলাম, তারা বলতে বলতে যাচ্ছিলো – ” ইয়ে সব পেটুক লোগ্__ ক্যায়সে সাধু বন্ গিয়া ?”
লোকগুলো চলে যেতেই সাধুরা আবার ধুনির সামনে বসে খাওয়া সেরে ধ্যানে বসার তোড়জোড় শুরু করলো। আমি ওখানেই ছিলাম, পুরো ঘটনাটা দেখছিলাম – ওনাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম – “এটা কি হোলো ?” ওনারা বললেন – ” ক্যায়া করেগা ! ইস কিসম কা আদমীলোক ইঁহা ধরম্ কে লিয়ে নেহি আতা ! উন্ লোগো বক্ওয়াস করেগা, হমারা ওয়াক্ত বরবাদ করেগা ! ইসি লিয়ে ভগা দিয়া !”। দ্যাখো, এখানে কিন্তু ওনাদের ‘কথনী আউর করনী’র মধ্যে ‘ফর্ক’ রয়েছে ! কিন্তু সেটা করা হোলো একটা মহান উদ্দেশ্যে !
আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি শোনো – কালনার ভগবানদাস বাবাজীর আশ্রমে যেদিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গিয়েছিলেন, সেদিন প্রথমটায় ভগবানদাস বাবাজী আরো দশজন ভক্তদের সাথে, মাথায় ঘোমটা দেওয়া গুটিসুটি মেরে বসে থাকা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে চিনতে পারেন নি, কিন্তু ভগবানের গায়ের গন্ধ (মধু, চন্দন, পদ্ম ইত্যাদির মিলিত অপার্থিব সুগন্ধ) পাচ্ছিলেন ! তখন ভগবান দাসজী ছলনার আশ্রয় নিলেন। হঠাৎ করে উপস্থিত ভক্তজনদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি নিজেকে জাহির করতে শুরু করে দিলেন। আর যায় কোথায় ! ঠাকুর মাথায় ঢাকা দেওয়া চাদর খুলে ঝেড়ে-মেরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং ভগবানদাসকে উদ্দেশ্য করে ভগবানসুলভ নির্দেশ দিতে থাকলেন !
এইভাবেই একটু চালাকির আশ্রয় নিয়ে সেদিন একজন ভগবদ্ ভক্ত পেয়ে গিয়েছিল তার আরাধ্য ভগবানের দর্শন ! তাহলে এক্ষেত্রে ভগবানদাসের সাময়িক এই “কথনী আউর করণী”র ফর্ক দেখে কি বিচার করবে – বলো ?
শ্রীল প্রভুপাদ অভয়চরণের জীবনে আবার ‘য্যায়সা কথনী,ওইসা করনী’ ! উনি সকলকে যা সবসময় বলতেন _সেটাই জীবনে করে দেখিয়েছিলেন। উনি একটা অফিসে চাকুরী করতেন – কিন্তু ওনার জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল গীতার মাহাত্ম্য প্রচার, বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও প্রসার ! এই কথা উনি কিন্তু ওনার চারপাশের মানুষদের প্রায়ই বলতেন – কিন্তু তারা বিশ্বাস তো করতোই না বরং ওনাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো !
উনি চাকুরীরত অবস্থাতেই একটু একটু করে গীতার ইংরেজি অনুবাদ করে রেখেছিলেন। এবার চাকুরীর শেষে যে টাকাটা পেলেন – সেই টাকায় ওই অনুবাদটি কয়েক হাজার কপি ছাপিয়ে নিয়ে চলে গেলেন সোজা আমেরিকায় অর্থাৎ USA-তে। প্রথমাবস্থায় ওখানে একটা মাথাগোঁজার ভালো ঠাঁই শুদ্ধ ওনার ছিল না ! একটা হাতে-ঠেলা ট্রলিতে গীতার ইংরেজি অনুবাদের কপি, মহাপ্রভুর কিছু বাণীর ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে –ঠেলাটা ঠেলতে ঠেলতে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। আর যেখানে কিছু লোকজন রয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে খঞ্জনি বাজিয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং আগ্রহী লোকজনদের ডেকে ডেকে বিনামুল্যে গীতার একটি করে কপি (ইংরেজি অনুবাদ) দিয়ে দিতেন। এইভাবে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা, এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরে ঘুরে উনি গীতার মহিমা, কৃষ্ণনাম, বৈষ্ণব-দর্শন প্রচার করেছিলেন। আর তারই ফলস্বরূপ আজকের ‘ইসকন’, যা আজ গোটা পৃথিবীতে হরিনামের প্লাবন বইয়ে দিচ্ছে ! ভারতবর্ষের গৌড়িয় বৈষ্ণব দর্শনকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।।
তাহলে বুঝতে পারলে তো – আপাতত মনে হোলেও, প্রকৃতপক্ষে মহাত্মা-মহাপুরুষদের কথা আর কাজের মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না !