জিজ্ঞাসু :– শাস্ত্র বলেছে ‘কর্ম অনুসারে বুদ্ধির ক্রিয়া সংঘটিত হয়’– কিন্তু সাধারণভাবে আমরা তো দেখি মানুষ তার নিজের বুদ্ধি অনুযায়ীই কর্ম করে থাকে৷ তাহলে শাস্ত্র (গীতা) এরূপ বলেছে কেন ?
গুরুমহারাজ :– দেখুন – কর্মই প্রধান। যেমন রথ আর তার চাকা, তেমনি জীবন রথের_ কর্মচক্র। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন ! কর্মচক্র-ই জীবন রথকে সামনের দিকে অর্থাৎ পূর্ণতার দিকে টেনে নিয়ে যায়। চাকা যেদিকে যায় – রথও সেইদিকেই যায়। জীবের জীবন কর্মময়,কারো জীবনে যখন কোনো স্থুলকর্ম থাকে না – তখন নিশ্চিত জানবেন সেখানে ‘জীবন‌’-ও থাকে না। স্থূলদেহ বা স্থূলশরীর তখন বিনষ্ট হয়ে যায়! অবশ্য সূক্ষ্মশরীর থাকে এবং সেখানেও কর্ম থাকে, কিন্তু সেটা অন্যরকম কর্ম !
একমাত্র সাধনার দ্বারা সাধকের কর্মক্ষয় হয় এবং নির্বিকল্প সমাধিতে কর্ম শেষ হয়। কিন্তু মহাপুরুষদের জগতকল্যাণের জন্য আবার সেই কর্ম-ই পুনরায় করতে হয়। তবে নির্বিকল্পের আগের কর্মের সাথে পরের কর্মের ভেদ রয়েছে। আগের কর্মের কর্মফল সেই ব্যক্তির নিজের উপর বর্তায় – আর নির্বিকল্পের পরে ‘নিজ’ বলতে কিছুই থাকে না – ফলে এই অবস্থায় থাকা মহাপুরুষদের কর্মফল জগৎব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। তবে যেহেতু তাঁদের এই কর্মফলের সবটাই শুভ – তাই পৃথিবীর সকলেরই মঙ্গল হয়। আর যারা এইরূপ মহাপুরুষদের কাছাকাছি থাকে, তাদের মঙ্গল অধিক হয় এবং তাঁরা যাদের উপর প্রসন্ন থাকেন – তাদের কয়েকজন্মের সাধনার ফল একজন্মেই লাভ হয়ে যায়।
যাই হোক, কথা হচ্ছিলো মানুষের কর্ম নিয়ে –দেখুন, কোনো মানুষই কর্মহীন নয়। ওই যে বললাম – কর্ম না থাকলে স্থূলদেহে জীবন থাকে না৷ নিদ্রার সময় শরীরের বাহ্যিক rest হয় বটে, কিন্তু শরীরের অভ্যন্তরস্থ যন্ত্রাদি heart, lung ইত্যাদিরা কাজ করেই চলে – সকল অঙ্গের rest মানেই তো মৃত্যু ! নির্বিকল্প সমাধির সময় স্থূলশরীর জড়বৎ হয়ে যায়। অনেকসময় এমন‌ও হয়েছে যে, ডাক্তারেরাও পরীক্ষা করে শরীরের কোনো স্পন্দন পায়নি – কিন্তু সেই সাধক বেঁচে রয়েছেন, পরে ধীরে ধীরে ঐ শরীর ক্রিয়াশীলও হয়েছে, তিনি সমাজে হয়তো এরপরে কিছুকাল কাজও করেছেন__ভারতীয় যোগীদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে।
এই জন্যই বলা হচ্ছিলো সবাই কর্মচাক্রে রয়েছে ! সবাই বলতে জড়, চেতন (উদ্ভিদ বা প্রাণী) সকলকেই বোঝানো হোচ্ছে। কর্মচক্রের ‘কর্ম’ বলতে কর্ম, বিকর্ম, সুকর্ম সবকিছুকেই বোঝানো হোচ্ছে ! ‘বিকর্ম’ কথাটার অর্থ বোধহয় বুঝিয়ে বলা দরকার – বিকর্ম হোচ্ছে কর্মের বিকল্প, যে কর্ম করলে ক্লেশ ভোগ করতে হয়। আর ‘সুকর্ম’ বলতে যে কর্ম করলে মানবের জীবনে সুখলাভ হয়।
এইভাবেই কর্ম থেকে সৃষ্টি হয় কর্মফল, প্রারব্ধ, সংস্কার বা স্বভাব। পরের জীবনে আবার এই প্রারব্ধকর্মবশতঃই সংস্কার বা স্বভাব অনুয়ায়ী নতুন শরীর – আবার নতুন করে কর্ম শুরু।
তাহলে বুঝতে পারলেন তো – মন-বুদ্ধির যে ক্রিয়া, তার সবকিছুই কর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হোচ্ছে। এখন কথা হোচ্ছে যে, কীভাবে এই কর্মচক্র থেকে বেরিয়ে আসা যায় ! কর্ম, বিকর্ম, সুকর্ম, অপকর্ম ইত্যাদি যেকোনো কর্মই করো না কেন – সেইসব কর্মের তো কর্মফল রয়েছে। হয় ক্লেশভোগ_ না হয় সুখভোগ, এটাকেই কর্মফলের “ভোগ” বলা হোচ্ছে। স্বর্গ, নরক কল্পনাও এখান থেকেই এসেছে_ব্যাপারটা বুঝলেন!
যাইহোক, তাহলে এই চক্র থেকে নিস্তার বা নিষ্কৃতি কিভাবে মানুষ পাবে ? তখন ভগবান বললেন – ‘ঈশ্বর প্রীত্যর্থে কর্ম করলেই একমাত্র এই কর্মচক্র থেকে বেরোনো সম্ভব’ – অন্যথায় শুধু ঘুরেই মরতে হবে – নিস্তার নাই ! …. (পরবর্তী অংশ পরের দিন)