(“কর্ম অনুসারে মানুষের বুদ্ধি ক্রিয়া করে”__এই জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েছেন গুরু মহারাজ। আজ শেষাংশ…)
……… এবার হয়তো বলতে পারো – ঈশ্বর কিসে প্রীত হ’ন ? তার উত্তরে বলতে হয় – জ্ঞানে, প্রেমে আর সেবায় ! বাইরে কোথাও যেতে হবে না – অন্তরেই অন্তর্যামীরূপে তিনি রয়েছেন, কাজেই তাঁর নজর এড়িয়ে কিছুই হবার যো টি নেই। এইজন্যই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন – ” তিনি পিঁপড়ের চরণের নুপুরধ্বনি শুনতে পান।” সুতরাং জ্ঞান, প্রেম বা সেবা এই তিনটির যে কোনো একটির যদি ঠিক ঠিক উপযোগ হয় – তাহলে ঐ ব্যক্তি(সাধক) ঠিকই চিহ্নিত হয়ে যাবে।সে তখন ঈশ্বরের নজরে এসে যাবে এবং সে বিভিন্ন source থেকে নানারকম help-ও পাবে ! যদিও বাইরের দিক থেকে দেখলে হয়তো মনে হবে যে, সেই ব্যক্তি নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ! এই অবস্থা যেন ভক্ত-ভগবানের পরীক্ষার অবস্থা ‌। এই অবস্থায় প্রমাণ হয়ে যায় যে, সেই ভক্ত বা সাধক__ ঠিকঠিক অগ্রগতি চাইছে কি না ! যদি চায় – তাহলে এই অবস্থায় সে ঈশ্বরের দিকে একপা আগালে, ঈশ্বর তার দিকে দশ পা নয় এক’শ পা এগিয়ে আসবেন। এর আগের আগের মহাপুরুষগণ ‘দশ পা এগিয়ে আসা’-র কথা বলেছিলেন, আমি আরও দশগুণ বাড়িয়ে দিলাম ! সত্যি সত্যিই যদি তোমরা ঈশ্বরের দিকে এক’পা আগাও, তাহলে স্পষ্ট বুঝতে পারবে যে, ঈশ্বর তোমার দিকে এক’শ-পা আগিয়ে এসেছেন। এটা যুগপ্রভাব – এ যুগে এই নিয়ম-টাই চলবে।
তবে মুশকিলটা কোথায় হয় জানো – ধর্মজগতে প্রথম প্রথম যারা আসে, তাদের এতো emotion – যে মনে হয় বুঝি খুব ভক্ত ! কথায় কথায় ভাব হয়, চোখে জল আসে, ঘন ঘন ধ্যানে বসে যায়, ঈশ্বরীয় কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা কইতে চায় না ! কিন্তু কিছুদিন পর__যখন‌ই তার লোকমান্যতা আসে, তখন থেকে দেখা যায় –তার মধ্যে ওই ভাবগুলি আর থাকে না ! সেইজন্যেই আমি তোমাদেরকে বারবার বলি__emotion নয় devotion দরকার ! প্রথম অবস্থায় একটু-আধটু emotion কাজে লাগে ঠিকই__ কিন্তু জেনে রাখবে এটি ক্ষণস্থায়ী, জোয়ারের জলের মতো। হয়তো বেশ খানিকটা স্থলভাগ ডুবিয়ে দিলো, অনেককিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল – কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আর কোনো জল নাই – একেবারে শুষ্ক !
devotional ব্যক্তিরা কিন্তু এমন হয় না – তাদের অগ্রগতি কেমন হয় জানো__ slow but steady ! এখানকার অনেক emotional ভক্তকে দেখছি তো – এমন ভাব দেখাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে যেন__ কি না কি করে ফেলবে ! তারপর যেই কোনো শক্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হোচ্ছে আর টিকতে পারছে না ! এই ব্যাপারটা কেমন জানো তো – যেমন দুর্বল মূলবিশিষ্ট কোনো গাছ মাথায় বড় বা লম্বা হয়ে উঠে পড়েছে, কিন্তু যেই ঝড়ঝাপটা এলো, আর টিকতে পারলো না – মূল সমেত উপড়ে পড়ে গেল !! কিন্তু ছোট গাছ‌ও যদি দৃঢ়মূলবিশিষ্ট হয়, তাহলে দিব্যি ঝড়ঝাপটা সামলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে !
জানো বাবা__ আধ্যাত্মিক জগতের বিচিত্র বিধান ! এইজন্যই যাঁরা উচ্চকোটির মহাত্মা-মহাপুরুষ, তাঁদেরকে ঘিরে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমালেও দেখা যায় মাত্র অল্প কয়েকজনই তাঁর inner-circle-এ ঢুকতে সক্ষম হয়েছেন – বাকিরা গেছে-এসেছে, বসেছে-কথা বলেছে, দীর্ঘদিন মেলামেশাও হয়তো করেছে__কিন্তু তাও তারা ওই স্থানটা(inner-circle) স্পর্শ‌ও করতে পারেনি !
সমস্ত ব্যাপারটা এইসব কারণেই হয় ! বেশ-ভূষা, বাহ্যিক আচার-আচরণ দেখে অনেককেই মনে হয়_ বোধহয় ইনি একজন বিরাট ভক্ত বা মহাসাধক! কিন্তু আদপে তা নাও হোতে পারে। আবার উলঙ্গ হয়ে থাকা অথবা নিতান্ত সাধারণ ভাবে থাকা কোনো ব্যক্তিই হয়তো প্রকৃত মহাপুরুষ। এটা বিচার করা সাধারণের পক্ষে খুবই মুস্কিল ! তবে জানো, একটু মেলামেশা করলেই বোঝা যায়_ কে প্রকৃত সাধু, আর কে সেজেছে ! কারণ, সাজা-সাধু সব সময়েই ধনী-মানী-বিদ্বান ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেবে ! কিন্তু দেখা যায় প্রকৃত মহাত্মা-মহাপুরুষদের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, তিনি হয়তো অতি সাধারন দেখতে, নগন্য কোনো ব্যক্তিকে অধিক পাত্তা দিচ্ছেন ! এর কারণ হোলো, তিনি তো জানেন যে – এই ব্যক্তির বাহ্য আড়ম্বরের প্রকাশ না থাকলেও, সে অন্তর্জগতে মহাধনী !
এইভাবেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সময় অশিক্ষিত, বোকাসোকা বিহারী চাকর লাটু বা লেটো, মহাসাধক স্বামী অদ্ভুতানন্দ রূপে বা বলা চলে__ ঠাকুরের দ্বাদশ সন্ন্যাসীর অন্যতম এক বিস্ময়রূপে প্রকাশিত হয়ে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন ! ভারতীয় বিভিন্ন পরম্পরার ইতিহাস ঘাঁটলে এইরকম উদাহরণ তুমি শত শত পাবে।।