জিজ্ঞাসু :– আপনার কাছে যে সমস্ত সাধু-মহাত্মাদের কথা শুনি – তাতে করে মনে হয় সাধু-মহাত্মারা বেশিরভাগ হিমালয়েই থাকে। কারণ আপনি হিমালয়ের কথা খুবই বলেন। হিমালয়ের কি এমন আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে_বেশিরভাগ সাধুসন্তরা ওখানেই থাকে ? আমরা গিয়ে তো দেখেছি – দুর্গম, বিপদসংকুল, অত্যাধিক ঠান্ডা, মনুষ্যবাসের উপযুক্ত নয় – তাহলে Why Himalaya ?
গুরুমহারাজ :– তুই একটা পাগল ! সাধু-মহাত্মারা কি তোর মতো বা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো ? সাধারন মানুষ যে জীবন পথে যে রাস্তায় হাঁটে, সাধু-মহাত্মার জীবনচর্যা তো তার বিপরীত – তাই নয় কি ? সাধারন মানুষের জীবন-যাত্রা বলতে___ যেমন তুই তোর কথাই ধর না – তুই ছোট থেকে যখন বড় হলি, তখন কি চেয়েছিলি ? স্বাস্থ্য, সম্পদ, ভোগ-ঐশ্বর্য ইত্যাদি ! কিন্তু একজন সাধু-মহাত্মা কি ধরণের জীবনচর্য্যায় বড় হ’ন – ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংযম, সাধনা ! সাধারন মানুষ যখন অনিত্য সংসারকে নিয়ে মশগুল তখন সাধু-মহাত্মারা সত্যের সন্ধানে, ব্রহ্মজ্ঞান লাভের প্রচেষ্টায় আত্মমগ্ন !
সুতরাং তোর মতো যারা সংসারের ভোগ-ঐশ্বর্যকে ভালোবেসে, মায়া-মোহের জগতে আবদ্ধ হয়ে যেতে ভালোবেসেছে__ তাদের জন্য নগর-সভ্যতার প্রয়োজন হয়, শহরের সুরক্ষা, ভোগ-ঐশ্বর্য্যের উপকরণ প্রয়োজন হয়। আর যারা এই প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে হাঁটেন তাদের জন্য প্রয়োজন হয় নির্জনতা, নীরবতা, প্রকৃতির আনুকূল্য। বনজঙ্গল, দূর্গমতা, লোকজনহীনতা এগুলি সাধু-সন্তদের প্রতিকূল নয় বরং অনুকূল ! বেশিরভাগ মহাত্মার জীবন-ই কেটে যায় এই ধরনের জনহীন অঞ্চলে, বনে-জঙ্গলে, শ্মশানে-কবরস্থানে ! সারা দিন-রাত অন্ধকারে পাহাড়-পর্বতের গুহায়, অথবা অরণ্যের কুঠীরে কেটেছে কতশত সাধুর জীবন – কিন্তু বল্ তো, কজন সাধু বাঘের কবলে পড়েছে বা সাপে কেটে মারা গেছে ? এমন কতগুলো record দেখাতে পারবি ? বরং তুই অনেক এমন কাহিনী শুনতে পাবি – যেখানে কোনো সাধুবাবা সাপেদের সাথে বাস করেন, কোনো সাধুবাবা বা মহাত্মার কোলে বাঘ শুয়ে ঘুমাচ্ছিল ইত্যাদি।
আমার জানা একজনের কথা বলছি – ওর নাম ছিল “রামতীরথ্”৷ উত্তরপ্রদেশের টিহরী অর্থাৎ এখন যেখানে বিরাট বাঁধ করার কাজ চলছে (১৯৯১-৯২), তীরথ্জী ঠিক তার উপরে একটা গুহামতো জায়গায় থেকে সাধন-ভজন করতো। ওই অঞ্চলে মাঝে মাঝেই বাঘের দেখা মেলে ! একদিন রামতীরথ্ সন্ধ্যার সময় গুহায় ধ্যান-জপে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল – এমন সময় এক বাঘ এসে হাজির ওর গুহার মুখে। সেইদিন বা হয়তো ২/৩ দিন ধরে তীরথ্জীর কোনো আহারাদি জোটেনি – ফলে ও খুবই ক্ষুধার্ত বোধ করছিল। এদিকে বাঘ বাবাজীও ক্ষুধার্ত – কারণ খাদ্যের সন্ধানে সে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে ওই গুহায় এসে হাজির হয়েছে ! যাইহোক রামতীরথ্ গুহার মুখে বাঘকে দেখেই বলে উঠলেন, “রে বাঘ ! তুইও ক্ষুধার্ত – আমিও ক্ষুধার্ত ! কিন্তু যেহেতু তুই আমার খাদ্য হোতে পারিস না, অতএব আজকে তুই আমাকেই খাদ্য কর।” – এই বলে ও যেই বাঘের দিকে একটু এগিয়েছে অমনি বাঘটা পালিয়ে গেল!
কিন্তু জানিস, আমার সাথে যখন বাঘের দেখা হোলো, তখন কিন্তু আমি লাফিয়ে বরফগলা জলে নেমে পড়লাম – আর সারারাত সেখানেই ঐ অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল আমাকে।
ঘটনাটা বলছি শোন্__উত্তরকাশীতে সেইসময় আমি বেশ কিছুদিন একটানা ওখানে ছিলাম । ওখান থেকে দূরে হরিপাহাড় দেখা যেতো – সাধুরা বলাবলি করতো ওখানে পাহাড়ের চূড়ায় সরোবর আছে। জ্যোৎস্নালোকিত রাতে ওখানকার পরিবেশ মায়াময় হয়ে যায় – আর গন্ধর্ব, অপ্সরা, দেব-দেবীরা ওখানে স্নান করতে বা জলবিহার করতে আসে ! এইসব কথা শুনে আমার প্রায়ই মনে হোতো ওই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে একবার দেখে এলে বেশ হয়। অনেককেই এ ব্যাপারে বলেছিলাম – কিন্তু দেখলাম কেউ আমার সঙ্গে যেতে রাজি হোলো না। সাধু সমাজে একটা কথা প্রচার ছিল যে, যেহেতু ওটা দেব-দেবী, গন্ধর্ব, অপ্সরাদের স্থান – তাই ওখানে গেলে কোনো মানুষ আর ফেরে না !
তবে আমার জীবনদর্শন তো আলাদা__ আর সেটা সবার সাথে কখনোই মিলতো না। তাই পূর্ণিমা তিথি দেখে একদিন সবার কাছে বিদায় নিয়ে খুব ভোরে বেড়িয়ে আমি হরিপাহাড়ের দিকে হাঁটা লাগালাম৷ সারাদিন হাঁটার পর ওখানে পৌঁছালাম। আমরা যে আশ্রমে থাকতাম, সেখান থেকে দেখে মনে হোতো__হরিপাহাড় বোধহয় কাছাকাছি, কিন্তু হাঁটতে গিয়ে বুঝতে পারলাম পার্বত্যপথে ওই দূরত্ব প্রায় ২৫/৩০ কিলোমিটার হবে ! এইবার শুরু হোলো পাহাড়ের মাথায় চড়া ! ঝোপঝাড় ধরে ধরে উপরে ওঠা, সে বড় কষ্টের ব্যাপার। তবে পশুদের চলার পথও অনেক সময় পাওয়া যায় – সেই পথ ধরে গেলে একটু সহজে ওঠা যায়। পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে উঠতেই প্রায় মধ্যরাত্রি হয়ে গেল। উপরে তীব্র ঠান্ডা ! কিন্তু উঠে দেখলাম সত্যিই একটা জলাশয় রয়েছে ! চারিদিকে বরফ জমেছে আর মাঝখানে স্বচ্ছ নীল জল ! চাঁদের আলোতেই জলভাগের নীচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো !
আর ওই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রালোকিত চারিপাশের উপত্যাকার যে কি অপূর্ব সৌন্দর্য_ তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারা যাবে না। অতো কষ্ট করে যাবার পরেও মনে হচ্ছিলো আনন্দে খানিক নৃত্য করি – করেছিলামও ! তারপর বুঝলাম কেন সাধুরা বলে এই স্থান দেবদেবী বা গন্ধর্ব-অপ্সরাদের স্থান ! এত সৌন্দর্যপূর্ণ স্থানের কথাই তো স্বর্গভূমি কল্পনায় বর্ণিত রয়েছে ! আর স্বর্গ দেব-দেবীর স্থান হিসাবেই নির্দিষ্ট করা রয়েছে শাস্ত্রগ্রন্থে !
এরপরে ওখানেই বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম দেবদেবীরা কখন আসে–কখন আসে !! কিন্তু মনে মনে জানতাম কেউ আসবে না। হঠাৎ দেখি গোটাকয়েক গোল গোল চোখ চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে – সর্বনাশ ! এ যে বাঘ ! লাফিয়ে বরফ গলা জলে নেমে পড়লাম – বাঘগুলো জল খাবার জন্য এখানে এসেছিল। এখন বুঝতে পারলাম কেন সাধুরা আসতে চায়নি – আর কেনই বা প্রবাদ রয়েছে যে হরিপাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রালোকিত রাত্রে কেউ যেতে পারে না বা গেলেও আর ফেরে না !!
বাঘ বাবাজীরা তো সুন্দরবনের বাঘ নয় – যে জলে নেমে শিকার ধরবে – তাছাড়া বরফগলা জলে হয়তো সুন্দরবনের বাঘও নামবে না। আমার-ই শরীর জমে যাচ্ছিলো ! কিন্তু তিব্বতী যোগী এবং নাঙ্গাসাধুদের কাছ থেকে আমার বিশেষ যোগ-কৌশল জানা ছিল – তাই সেই কায়দা প্রয়োগ করে আমি শরীরটাকে উত্তপ্ত রাখছিলাম।
বাঘগুলো আমাকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বসে থাকলো – তারপর ভোরের আকাশ একটু রাঙা হোতেই ওরা চলে গেল। বাঘেদের দলটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় আট-দশটা বাঘ ছিল। বাঘের দল চলে যেতেই আমি একটু অপেক্ষা করে জল থেকে উঠে এলাম। একটু রোদ উঠতেই শরীর তরতাজা হয়ে গেল।
তখন বাঘেদের গমনপথ follow করে খানিকটা গিয়ে দেখলাম হরিপাহাড়ের যে দিকটায় আমি উঠেছিলাম – সেই দিকটা খাড়া কিন্তু উল্টোদিকটা অর্থাৎ বাঘগুলি যেদিক থেকে এসেছিল, সেই দিকটা জঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত – অল্প ঢাল হয়ে সোজা জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে। ফলে শুধু বাঘই নয় – অন্যান্য পশুরাও ঐ সরোবরে ঐ পথ ধরে জল খেতে আসে । তাদেরও পায়ের বা অন্য নানা রকম চিহ্ন পাওয়া গেল। তারপর আমি দিনের আলোয় পশুদের চলা পথ অনুসরণ করে সহজেই নেমে এসেছিলাম।
ওই পথে প্রচুর দারুচিনির জঙ্গল দেখেছিলাম। উত্তরকাশীতে ফিরে এলে ওখানকার সাধুরা আমার কাছে সব ঘটনা শুনল ! ওরাও আমার জন্য উদ্বিগ্ন ছিল, বলছিল সেদিন না ফিরলে ওরা দলবেঁধে পরদিন খোঁজ নিতে যেতো !
সে যাই হোক, অন্য মহাত্মাদের সাথে বাঘ-ভালুকের যাই সম্পর্ক হোক না কেন__ আমার সাথে হিমালয়ের বাঘের সাক্ষাতের ঘটনাটা ঐরকম ছিল ।।
গুরুমহারাজ :– তুই একটা পাগল ! সাধু-মহাত্মারা কি তোর মতো বা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো ? সাধারন মানুষ যে জীবন পথে যে রাস্তায় হাঁটে, সাধু-মহাত্মার জীবনচর্যা তো তার বিপরীত – তাই নয় কি ? সাধারন মানুষের জীবন-যাত্রা বলতে___ যেমন তুই তোর কথাই ধর না – তুই ছোট থেকে যখন বড় হলি, তখন কি চেয়েছিলি ? স্বাস্থ্য, সম্পদ, ভোগ-ঐশ্বর্য ইত্যাদি ! কিন্তু একজন সাধু-মহাত্মা কি ধরণের জীবনচর্য্যায় বড় হ’ন – ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংযম, সাধনা ! সাধারন মানুষ যখন অনিত্য সংসারকে নিয়ে মশগুল তখন সাধু-মহাত্মারা সত্যের সন্ধানে, ব্রহ্মজ্ঞান লাভের প্রচেষ্টায় আত্মমগ্ন !
সুতরাং তোর মতো যারা সংসারের ভোগ-ঐশ্বর্যকে ভালোবেসে, মায়া-মোহের জগতে আবদ্ধ হয়ে যেতে ভালোবেসেছে__ তাদের জন্য নগর-সভ্যতার প্রয়োজন হয়, শহরের সুরক্ষা, ভোগ-ঐশ্বর্য্যের উপকরণ প্রয়োজন হয়। আর যারা এই প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে হাঁটেন তাদের জন্য প্রয়োজন হয় নির্জনতা, নীরবতা, প্রকৃতির আনুকূল্য। বনজঙ্গল, দূর্গমতা, লোকজনহীনতা এগুলি সাধু-সন্তদের প্রতিকূল নয় বরং অনুকূল ! বেশিরভাগ মহাত্মার জীবন-ই কেটে যায় এই ধরনের জনহীন অঞ্চলে, বনে-জঙ্গলে, শ্মশানে-কবরস্থানে ! সারা দিন-রাত অন্ধকারে পাহাড়-পর্বতের গুহায়, অথবা অরণ্যের কুঠীরে কেটেছে কতশত সাধুর জীবন – কিন্তু বল্ তো, কজন সাধু বাঘের কবলে পড়েছে বা সাপে কেটে মারা গেছে ? এমন কতগুলো record দেখাতে পারবি ? বরং তুই অনেক এমন কাহিনী শুনতে পাবি – যেখানে কোনো সাধুবাবা সাপেদের সাথে বাস করেন, কোনো সাধুবাবা বা মহাত্মার কোলে বাঘ শুয়ে ঘুমাচ্ছিল ইত্যাদি।
আমার জানা একজনের কথা বলছি – ওর নাম ছিল “রামতীরথ্”৷ উত্তরপ্রদেশের টিহরী অর্থাৎ এখন যেখানে বিরাট বাঁধ করার কাজ চলছে (১৯৯১-৯২), তীরথ্জী ঠিক তার উপরে একটা গুহামতো জায়গায় থেকে সাধন-ভজন করতো। ওই অঞ্চলে মাঝে মাঝেই বাঘের দেখা মেলে ! একদিন রামতীরথ্ সন্ধ্যার সময় গুহায় ধ্যান-জপে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল – এমন সময় এক বাঘ এসে হাজির ওর গুহার মুখে। সেইদিন বা হয়তো ২/৩ দিন ধরে তীরথ্জীর কোনো আহারাদি জোটেনি – ফলে ও খুবই ক্ষুধার্ত বোধ করছিল। এদিকে বাঘ বাবাজীও ক্ষুধার্ত – কারণ খাদ্যের সন্ধানে সে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে ওই গুহায় এসে হাজির হয়েছে ! যাইহোক রামতীরথ্ গুহার মুখে বাঘকে দেখেই বলে উঠলেন, “রে বাঘ ! তুইও ক্ষুধার্ত – আমিও ক্ষুধার্ত ! কিন্তু যেহেতু তুই আমার খাদ্য হোতে পারিস না, অতএব আজকে তুই আমাকেই খাদ্য কর।” – এই বলে ও যেই বাঘের দিকে একটু এগিয়েছে অমনি বাঘটা পালিয়ে গেল!
কিন্তু জানিস, আমার সাথে যখন বাঘের দেখা হোলো, তখন কিন্তু আমি লাফিয়ে বরফগলা জলে নেমে পড়লাম – আর সারারাত সেখানেই ঐ অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল আমাকে।
ঘটনাটা বলছি শোন্__উত্তরকাশীতে সেইসময় আমি বেশ কিছুদিন একটানা ওখানে ছিলাম । ওখান থেকে দূরে হরিপাহাড় দেখা যেতো – সাধুরা বলাবলি করতো ওখানে পাহাড়ের চূড়ায় সরোবর আছে। জ্যোৎস্নালোকিত রাতে ওখানকার পরিবেশ মায়াময় হয়ে যায় – আর গন্ধর্ব, অপ্সরা, দেব-দেবীরা ওখানে স্নান করতে বা জলবিহার করতে আসে ! এইসব কথা শুনে আমার প্রায়ই মনে হোতো ওই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে একবার দেখে এলে বেশ হয়। অনেককেই এ ব্যাপারে বলেছিলাম – কিন্তু দেখলাম কেউ আমার সঙ্গে যেতে রাজি হোলো না। সাধু সমাজে একটা কথা প্রচার ছিল যে, যেহেতু ওটা দেব-দেবী, গন্ধর্ব, অপ্সরাদের স্থান – তাই ওখানে গেলে কোনো মানুষ আর ফেরে না !
তবে আমার জীবনদর্শন তো আলাদা__ আর সেটা সবার সাথে কখনোই মিলতো না। তাই পূর্ণিমা তিথি দেখে একদিন সবার কাছে বিদায় নিয়ে খুব ভোরে বেড়িয়ে আমি হরিপাহাড়ের দিকে হাঁটা লাগালাম৷ সারাদিন হাঁটার পর ওখানে পৌঁছালাম। আমরা যে আশ্রমে থাকতাম, সেখান থেকে দেখে মনে হোতো__হরিপাহাড় বোধহয় কাছাকাছি, কিন্তু হাঁটতে গিয়ে বুঝতে পারলাম পার্বত্যপথে ওই দূরত্ব প্রায় ২৫/৩০ কিলোমিটার হবে ! এইবার শুরু হোলো পাহাড়ের মাথায় চড়া ! ঝোপঝাড় ধরে ধরে উপরে ওঠা, সে বড় কষ্টের ব্যাপার। তবে পশুদের চলার পথও অনেক সময় পাওয়া যায় – সেই পথ ধরে গেলে একটু সহজে ওঠা যায়। পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে উঠতেই প্রায় মধ্যরাত্রি হয়ে গেল। উপরে তীব্র ঠান্ডা ! কিন্তু উঠে দেখলাম সত্যিই একটা জলাশয় রয়েছে ! চারিদিকে বরফ জমেছে আর মাঝখানে স্বচ্ছ নীল জল ! চাঁদের আলোতেই জলভাগের নীচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো !
আর ওই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রালোকিত চারিপাশের উপত্যাকার যে কি অপূর্ব সৌন্দর্য_ তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারা যাবে না। অতো কষ্ট করে যাবার পরেও মনে হচ্ছিলো আনন্দে খানিক নৃত্য করি – করেছিলামও ! তারপর বুঝলাম কেন সাধুরা বলে এই স্থান দেবদেবী বা গন্ধর্ব-অপ্সরাদের স্থান ! এত সৌন্দর্যপূর্ণ স্থানের কথাই তো স্বর্গভূমি কল্পনায় বর্ণিত রয়েছে ! আর স্বর্গ দেব-দেবীর স্থান হিসাবেই নির্দিষ্ট করা রয়েছে শাস্ত্রগ্রন্থে !
এরপরে ওখানেই বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম দেবদেবীরা কখন আসে–কখন আসে !! কিন্তু মনে মনে জানতাম কেউ আসবে না। হঠাৎ দেখি গোটাকয়েক গোল গোল চোখ চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে – সর্বনাশ ! এ যে বাঘ ! লাফিয়ে বরফ গলা জলে নেমে পড়লাম – বাঘগুলো জল খাবার জন্য এখানে এসেছিল। এখন বুঝতে পারলাম কেন সাধুরা আসতে চায়নি – আর কেনই বা প্রবাদ রয়েছে যে হরিপাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রালোকিত রাত্রে কেউ যেতে পারে না বা গেলেও আর ফেরে না !!
বাঘ বাবাজীরা তো সুন্দরবনের বাঘ নয় – যে জলে নেমে শিকার ধরবে – তাছাড়া বরফগলা জলে হয়তো সুন্দরবনের বাঘও নামবে না। আমার-ই শরীর জমে যাচ্ছিলো ! কিন্তু তিব্বতী যোগী এবং নাঙ্গাসাধুদের কাছ থেকে আমার বিশেষ যোগ-কৌশল জানা ছিল – তাই সেই কায়দা প্রয়োগ করে আমি শরীরটাকে উত্তপ্ত রাখছিলাম।
বাঘগুলো আমাকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বসে থাকলো – তারপর ভোরের আকাশ একটু রাঙা হোতেই ওরা চলে গেল। বাঘেদের দলটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় আট-দশটা বাঘ ছিল। বাঘের দল চলে যেতেই আমি একটু অপেক্ষা করে জল থেকে উঠে এলাম। একটু রোদ উঠতেই শরীর তরতাজা হয়ে গেল।
তখন বাঘেদের গমনপথ follow করে খানিকটা গিয়ে দেখলাম হরিপাহাড়ের যে দিকটায় আমি উঠেছিলাম – সেই দিকটা খাড়া কিন্তু উল্টোদিকটা অর্থাৎ বাঘগুলি যেদিক থেকে এসেছিল, সেই দিকটা জঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত – অল্প ঢাল হয়ে সোজা জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে। ফলে শুধু বাঘই নয় – অন্যান্য পশুরাও ঐ সরোবরে ঐ পথ ধরে জল খেতে আসে । তাদেরও পায়ের বা অন্য নানা রকম চিহ্ন পাওয়া গেল। তারপর আমি দিনের আলোয় পশুদের চলা পথ অনুসরণ করে সহজেই নেমে এসেছিলাম।
ওই পথে প্রচুর দারুচিনির জঙ্গল দেখেছিলাম। উত্তরকাশীতে ফিরে এলে ওখানকার সাধুরা আমার কাছে সব ঘটনা শুনল ! ওরাও আমার জন্য উদ্বিগ্ন ছিল, বলছিল সেদিন না ফিরলে ওরা দলবেঁধে পরদিন খোঁজ নিতে যেতো !
সে যাই হোক, অন্য মহাত্মাদের সাথে বাঘ-ভালুকের যাই সম্পর্ক হোক না কেন__ আমার সাথে হিমালয়ের বাঘের সাক্ষাতের ঘটনাটা ঐরকম ছিল ।।