[গুরু মহারাজ, ওনার বনগ্রামে প্রথম আসা এবং আশ্রম প্রতিষ্ঠার কথা বলছিলেন। আজ পরবর্ত্তী অংশ]
পাকাপাকিভাবে যেদিন বনগ্রামে আসার কথা__ তার আগে আমি রায়নায় জগাদার(জগন্নাথ দত্ত) বাড়িতে। তৃষাণ(স্বামী পরমেশ্বরানন্দ) বর্ধমান গেছিলো আমাকে আনার জন্য, কিন্তু কোনো কারণে সেদিন আমার আসা হয়নি ৷ তৃষান বর্ধমান বাসস্ট্যান্ডে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফিরে এসেছিল । আমি পরের দিন এসেছিলাম । বন্যা হয়েছিল দূর্গাপূজার আগে অমাবস্যার (মহালয়া) সময়কালীন, আর আমি বনগ্রামে এলাম কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার আগের দিন ৷ ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা আমি মুখার্জি বাড়িতে এসে উঠেছিলাম । ইতিমধ্যে বনগ্রামের ন’কাকারা আমার জন্য নির্দিষ্ট ঘরটি আবার কাদা লেপে ঠিক করে দিয়েছিল ৷
আমি এসে দেখলাম ঘরের সবকিছুই একেবারে ভিজে । দেওয়ালও ভিজে, মেঝেও ভিজে ! যাইহোক সেই রাত্রিটা আমার ন’কাকাদের বাড়িতে এবং কালীমন্দিরেই কেটে গেল । পরদিন সকালে ন’কাকাদের বাড়ির পিছনে যে ডোবাপুকুর রয়েছে (জরুলী) সেখানে স্নান করে, একটা ঘটে (ন’কাকাদের বাড়ি থেকে দেওয়া) জল ভরে তাতে একটা আমের শাখা দিয়ে, ভিজে কাপড়ে প্রথমে করূণাময়ী কালীমন্দিরে পূজা-প্রণাম সেরে, সোজা আশ্রমে সেই কুঁড়েঘরে ঘট প্রতিষ্ঠা করা হোলো ৷ মুখার্জি বাড়ির অনেকে, গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এবং আমার বন্ধুরা(যাঁরা পরে ব্রহ্মচারী হয়েছিলেন) সাথে সাথে এসেছিল । মেয়েরা শাঁখ বাজাচ্ছিল, উলু-ধ্বনি দিচ্ছিলো । এইভাবে আশ্রমের ঘট প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বনগ্রামে আশ্রম প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো !
কিন্তু ঘরের অবস্থা দেখে সবাই ঠিক করলো যে, এই ভিজে ঘরের মেঝেতে রাত্রে শুয়ে কাটালে তো নিউমোনিয়া রোগ হয়ে যাবে ! তাই গ্রাম থেকে একটা দড়ির খাটিয়া আনা হোলো__ রাত্রের বিশ্রামের জন্য । এইভাবে এখন যেখানে আশ্রম তখন সেটি ছিল___ গ্রাম থেকে দূরে অবস্থিত বন-জঙ্গলাকীর্ণ একটা স্থান ! যেটা মজে যাওয়া একটা পুকুরের পাড়ে, মাঠে জল যাওয়া একটা বড় কাঁচা ড্রেনের ধারে, মরা পশু ফেলা ভাগাড়ের উপর অবস্থিত ছিল ! আর মা জগদম্বার নির্দেশে ঐ স্থানেই আমার পাকাপাকিভাবে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ।
পরে ✓রী-মা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ঐ স্থানটি আশ্রম হবার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল – তাই দীর্ঘদিন ধরে স্থানটিকে ঐরকম পরিত্যক্ত, নোংরা, অবসবাসযোগ্য করে রাখা হয়েছিল ৷ যখন উপযুক্ত সময় উপস্থিত হোলো এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তির আগমন ঘটলো–তখন ই স্থানটির রূপের পরিবর্তন ঘটে গেল ৷
আজ এই স্থানটিকে দেখে, সেদিনের অবস্থার কথা কেউ কি ভাবতে পারবে ? কখনোই পারবে না ! তবে জেনে রাখবে যে, পৃথিবীতে সব কিছুই পূর্বনির্দিষ্ট — কালের বুকে সব চিত্রিত হয়ে রয়েছে ! উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্র উপস্থিত হোলে__ যা অদৃশ্য ছিল, তা দৃশ্যমান হয় ! যা অপ্রকাশিত ছিল, তা প্রকাশমান হয় ! যে স্থান দুর্গম্য ছিল, তা সুগম হয় আর কাল সুপ্রসন্ন হওয়ার সাথে সাথে সেখানেই লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম ঘটে যায় ।
এই যে কথাগুলো বললাম__এগুলো সত্য জানবে, সর্বকালে সর্বযুগেই সত্য । এখন মা জগদম্বার ইচ্ছায় বনগ্রাম আশ্রম সেজে উঠছে, পরবর্তীতে আরো বিশালভাবে সাজবে !অপরদিকে, আরও পরবর্তীতে যে সবস্থানে মায়ের কাজ হবে – সেই স্থান এখন হয়তো ‘পরিত্যক্ত জায়গা’ হিসাবে কোথাও পড়ে রয়েছে এবং আগামীতে সেজে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে !
যাইহোক যা বলছিলাম__ এইভাবে বনগ্রামে আশ্রম তো প্রতিষ্ঠা হোলো, কিন্তু আশ্রমের নাম কি দেওয়া যায় ? তখন আমার মধ্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব খুব প্রকট ছিল, তাই আশ্রমের নাম দেওয়া হোলো “ঠাকুরদাস আশ্রম”৷ পরে (১৯৮০/৮১ সালে) যখন উত্তরকাশীর রামানন্দ অবধূতের কাছে আমার সন্ন্যাস হোলো, তখন অবধূতজী আমাকে বলে দিলেন তোমার নাম হোলো “স্বামী পরমানন্দ”, আর তোমার আশ্রমের নাম হবে “পরমানন্দ মিশন”।
আশ্রম প্রতিষ্ঠা হবার পর, এবার প্রয়োজন হয়ে পড়লো আরো জায়গা-জমির ! কারণ এবারে আমার যা project তাতে অনেক জায়গার দরকার ৷ সুতরাং তারপর আমাদেরকে কুঠিয়ার চারিপাশের জায়গা-জমি কিভাবে পাওয়া যায়__ সেই ব্যাপারে সচেষ্ট হোতে হোলো । এই যে পুকুরটা দেখছো –এই পুকুর এবং এর পাড়, তাছাড়া কিছু জমি জায়গা__ এগুলো সব ছিল কলকাতার সুকুমার বাবুর(সুকুমার দাস) শশুরবাড়ির সম্পত্তি । দীর্ঘদিন ধরে ওনারা এখান থেকে বিশেষ কিছুই পাচ্ছিলেন না । ঐ সম্পত্তিটা আমাদের আশ্রম থেকে কিনে নেওয়া হোলো ৷ অত বেশি পরিমাণ সম্পত্তির ন্যায্য মূল্য অনেক, কিন্তু ধর্মপরায়ণ ওই পরিবার আশ্রমের কাছে খুব বেশি অর্থ নেয়নি ৷ এই বিষয় সম্পত্তির দেখভাল করতো যারা, তারা প্রাথমিকভাবে এই সম্পত্তি কিনে নেওয়ায় আশ্রমের প্রতি একটু অসন্তুষ্ট হয়েছিল ! কিন্তু দ্যাখো, বৃহত্তর স্বার্থে মানবকল্যাণের নিমিত্ত এই কাজ, আর এই সম্পত্তিও দেবসেবা এবং নিঃস্বার্থ মানবসেবার জন্যই নির্দিষ্ট হয়ে ছিল __ফলে উপযুক্ত সময়ে তার উপযোগ তো হবেই । কালের নিয়ম কে খণ্ডাতে পারে ! কিন্তু মানুষেরও দোষ দেওয়া যায় না, কারণ সাধারণ মানুষ তো মহাকালের বুকে কি লেখা রয়েছে তা পড়তে পারে না – তাই ঈশ্বরীয় কাজে বিরোধ করে বসে ৷
কিন্তু জেনে রাখবে, ঈশ্বরের কাজের জন্য যা নির্দিষ্ট –যতদিন সেটা সেই কাজে না লাগছে, ততদিন অন্যভাবে ব্যবহারকারী ব্যক্তির নানান অনিষ্ট ঘটবে – সে নানা অশান্তি ভোগ করতে থাকবে ৷ কিন্তু যেইমাত্র__ যে কাজের জন্য স্থানটি নির্দিষ্ট সেখানেই ফিরিয়ে দেওয়া হোলো – ব্যস্, সঙ্গে সঙ্গে ঐ সংসারে শান্তি ফিরে আসবে, তার সবকিছু ঠিকঠাক চলবে । … [ক্রমশঃ]
পাকাপাকিভাবে যেদিন বনগ্রামে আসার কথা__ তার আগে আমি রায়নায় জগাদার(জগন্নাথ দত্ত) বাড়িতে। তৃষাণ(স্বামী পরমেশ্বরানন্দ) বর্ধমান গেছিলো আমাকে আনার জন্য, কিন্তু কোনো কারণে সেদিন আমার আসা হয়নি ৷ তৃষান বর্ধমান বাসস্ট্যান্ডে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফিরে এসেছিল । আমি পরের দিন এসেছিলাম । বন্যা হয়েছিল দূর্গাপূজার আগে অমাবস্যার (মহালয়া) সময়কালীন, আর আমি বনগ্রামে এলাম কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার আগের দিন ৷ ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা আমি মুখার্জি বাড়িতে এসে উঠেছিলাম । ইতিমধ্যে বনগ্রামের ন’কাকারা আমার জন্য নির্দিষ্ট ঘরটি আবার কাদা লেপে ঠিক করে দিয়েছিল ৷
আমি এসে দেখলাম ঘরের সবকিছুই একেবারে ভিজে । দেওয়ালও ভিজে, মেঝেও ভিজে ! যাইহোক সেই রাত্রিটা আমার ন’কাকাদের বাড়িতে এবং কালীমন্দিরেই কেটে গেল । পরদিন সকালে ন’কাকাদের বাড়ির পিছনে যে ডোবাপুকুর রয়েছে (জরুলী) সেখানে স্নান করে, একটা ঘটে (ন’কাকাদের বাড়ি থেকে দেওয়া) জল ভরে তাতে একটা আমের শাখা দিয়ে, ভিজে কাপড়ে প্রথমে করূণাময়ী কালীমন্দিরে পূজা-প্রণাম সেরে, সোজা আশ্রমে সেই কুঁড়েঘরে ঘট প্রতিষ্ঠা করা হোলো ৷ মুখার্জি বাড়ির অনেকে, গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এবং আমার বন্ধুরা(যাঁরা পরে ব্রহ্মচারী হয়েছিলেন) সাথে সাথে এসেছিল । মেয়েরা শাঁখ বাজাচ্ছিল, উলু-ধ্বনি দিচ্ছিলো । এইভাবে আশ্রমের ঘট প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বনগ্রামে আশ্রম প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো !
কিন্তু ঘরের অবস্থা দেখে সবাই ঠিক করলো যে, এই ভিজে ঘরের মেঝেতে রাত্রে শুয়ে কাটালে তো নিউমোনিয়া রোগ হয়ে যাবে ! তাই গ্রাম থেকে একটা দড়ির খাটিয়া আনা হোলো__ রাত্রের বিশ্রামের জন্য । এইভাবে এখন যেখানে আশ্রম তখন সেটি ছিল___ গ্রাম থেকে দূরে অবস্থিত বন-জঙ্গলাকীর্ণ একটা স্থান ! যেটা মজে যাওয়া একটা পুকুরের পাড়ে, মাঠে জল যাওয়া একটা বড় কাঁচা ড্রেনের ধারে, মরা পশু ফেলা ভাগাড়ের উপর অবস্থিত ছিল ! আর মা জগদম্বার নির্দেশে ঐ স্থানেই আমার পাকাপাকিভাবে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ।
পরে ✓রী-মা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ঐ স্থানটি আশ্রম হবার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল – তাই দীর্ঘদিন ধরে স্থানটিকে ঐরকম পরিত্যক্ত, নোংরা, অবসবাসযোগ্য করে রাখা হয়েছিল ৷ যখন উপযুক্ত সময় উপস্থিত হোলো এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তির আগমন ঘটলো–তখন ই স্থানটির রূপের পরিবর্তন ঘটে গেল ৷
আজ এই স্থানটিকে দেখে, সেদিনের অবস্থার কথা কেউ কি ভাবতে পারবে ? কখনোই পারবে না ! তবে জেনে রাখবে যে, পৃথিবীতে সব কিছুই পূর্বনির্দিষ্ট — কালের বুকে সব চিত্রিত হয়ে রয়েছে ! উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্র উপস্থিত হোলে__ যা অদৃশ্য ছিল, তা দৃশ্যমান হয় ! যা অপ্রকাশিত ছিল, তা প্রকাশমান হয় ! যে স্থান দুর্গম্য ছিল, তা সুগম হয় আর কাল সুপ্রসন্ন হওয়ার সাথে সাথে সেখানেই লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম ঘটে যায় ।
এই যে কথাগুলো বললাম__এগুলো সত্য জানবে, সর্বকালে সর্বযুগেই সত্য । এখন মা জগদম্বার ইচ্ছায় বনগ্রাম আশ্রম সেজে উঠছে, পরবর্তীতে আরো বিশালভাবে সাজবে !অপরদিকে, আরও পরবর্তীতে যে সবস্থানে মায়ের কাজ হবে – সেই স্থান এখন হয়তো ‘পরিত্যক্ত জায়গা’ হিসাবে কোথাও পড়ে রয়েছে এবং আগামীতে সেজে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে !
যাইহোক যা বলছিলাম__ এইভাবে বনগ্রামে আশ্রম তো প্রতিষ্ঠা হোলো, কিন্তু আশ্রমের নাম কি দেওয়া যায় ? তখন আমার মধ্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব খুব প্রকট ছিল, তাই আশ্রমের নাম দেওয়া হোলো “ঠাকুরদাস আশ্রম”৷ পরে (১৯৮০/৮১ সালে) যখন উত্তরকাশীর রামানন্দ অবধূতের কাছে আমার সন্ন্যাস হোলো, তখন অবধূতজী আমাকে বলে দিলেন তোমার নাম হোলো “স্বামী পরমানন্দ”, আর তোমার আশ্রমের নাম হবে “পরমানন্দ মিশন”।
আশ্রম প্রতিষ্ঠা হবার পর, এবার প্রয়োজন হয়ে পড়লো আরো জায়গা-জমির ! কারণ এবারে আমার যা project তাতে অনেক জায়গার দরকার ৷ সুতরাং তারপর আমাদেরকে কুঠিয়ার চারিপাশের জায়গা-জমি কিভাবে পাওয়া যায়__ সেই ব্যাপারে সচেষ্ট হোতে হোলো । এই যে পুকুরটা দেখছো –এই পুকুর এবং এর পাড়, তাছাড়া কিছু জমি জায়গা__ এগুলো সব ছিল কলকাতার সুকুমার বাবুর(সুকুমার দাস) শশুরবাড়ির সম্পত্তি । দীর্ঘদিন ধরে ওনারা এখান থেকে বিশেষ কিছুই পাচ্ছিলেন না । ঐ সম্পত্তিটা আমাদের আশ্রম থেকে কিনে নেওয়া হোলো ৷ অত বেশি পরিমাণ সম্পত্তির ন্যায্য মূল্য অনেক, কিন্তু ধর্মপরায়ণ ওই পরিবার আশ্রমের কাছে খুব বেশি অর্থ নেয়নি ৷ এই বিষয় সম্পত্তির দেখভাল করতো যারা, তারা প্রাথমিকভাবে এই সম্পত্তি কিনে নেওয়ায় আশ্রমের প্রতি একটু অসন্তুষ্ট হয়েছিল ! কিন্তু দ্যাখো, বৃহত্তর স্বার্থে মানবকল্যাণের নিমিত্ত এই কাজ, আর এই সম্পত্তিও দেবসেবা এবং নিঃস্বার্থ মানবসেবার জন্যই নির্দিষ্ট হয়ে ছিল __ফলে উপযুক্ত সময়ে তার উপযোগ তো হবেই । কালের নিয়ম কে খণ্ডাতে পারে ! কিন্তু মানুষেরও দোষ দেওয়া যায় না, কারণ সাধারণ মানুষ তো মহাকালের বুকে কি লেখা রয়েছে তা পড়তে পারে না – তাই ঈশ্বরীয় কাজে বিরোধ করে বসে ৷
কিন্তু জেনে রাখবে, ঈশ্বরের কাজের জন্য যা নির্দিষ্ট –যতদিন সেটা সেই কাজে না লাগছে, ততদিন অন্যভাবে ব্যবহারকারী ব্যক্তির নানান অনিষ্ট ঘটবে – সে নানা অশান্তি ভোগ করতে থাকবে ৷ কিন্তু যেইমাত্র__ যে কাজের জন্য স্থানটি নির্দিষ্ট সেখানেই ফিরিয়ে দেওয়া হোলো – ব্যস্, সঙ্গে সঙ্গে ঐ সংসারে শান্তি ফিরে আসবে, তার সবকিছু ঠিকঠাক চলবে । … [ক্রমশঃ]