জিজ্ঞাসু :– হিমালয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা কি বলছিলেন _মহারাজ ?
গুরুমহারাজ :– দ্যাখো, হিমালয় হোচ্ছে পৃথিবীর বিস্ময় ! হিমালয়ের রহস্য সবসময়ই দুর্জ্ঞেয় ! সাধারণ মানুষ কখনোই হিমালয়ের ঐ সব রহস্য জানতে পারবে না। পৃথিবীর আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিমালয়, ওখানে বিভিন্ন মহাত্মারা সংকল্প করে সাধন-ভজন করে চলেছেন_ দীর্ঘকাল ধরে তাঁরা শরীরধারণ করে রয়েছেন, ওঁরাই পৃথিবীর আধ্যাত্মিকতাকে রক্ষা করে চলেছেন ! সাধারণতঃ জগতসংসারের সাধারণ ব্যাপারে_অর্থাৎ সামাজিক বা রাজনৈতিক ইত্যাদি ব্যাপারে এঁরা খুব একটা মাথা ঘামান না। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের যা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা সামরিক পরিস্থিতি, তাতে ওঁরা খুবই বিচলিত ! তাই বর্তমানে ওনারা এই ব্যাপারেও দৃষ্টি দিয়েছেন! ২০০২ সাল থেকে পৃথিবীর মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করবে!
এইসব কারণেই দেখবে_ আগামী দিনে গোটা বিশ্বে আধ্যাত্মিকতার একটা প্লাবন আসবে খুব শিগ্গিরি ! ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ইত্যাদির অনেক কিছুরই অবসান ঘটতে থাকবে। যখনই পৃথিবীর কোনো প্রান্তে খুব প্রয়োজন হয় – এনারাই একঝাঁক আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের পাঠান সেই অঞ্চলে, তাঁরা সমাজের বিভিন্ন শাখায় কাজ করেন এবং সেখানকার মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনে সচেষ্ট হ’ন ! সাধারণ মানুষের চেতনায় চাবুক মেরে তাঁরা তাদেরকে খানিকটা জাগিয়ে দেবার চেষ্টাও করে যান। এই ঘটনাকেই আমরা ‘সেই অঞ্চলের নবজাগরণ’ হিসাবে বর্ণনা করি ! ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এরূপ একঝাঁক মহাপ্রাণের জন্ম হয়েছিল ভারতে ! ইউরোপের নবজাগরণের সময়েও এইরকমই একঝাঁক প্রতিভার জন্ম হয়েছিল ! সারদা মা একবার বলেছিলেন – ” ঠাকুর যখনই আসেন, তখনই সঙ্গে করে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে আসেন। এরা যেন কলমীলতার ঝাঁক – একটায় টান দিলেই পুরোটায় টান পড়ে।”
তবে এইসব রহস্য সাধারণ মানুষ কি করে বুঝবে বলো ? তারা তো নিজের নিজের চেতনার level দিয়েই সবকিছু বিচার করে ! সাধারণ অল্পশিক্ষিতরা হয়তো শ্রদ্ধা-ভক্তিতে আমার কথাগুলি মেনে নিতেও পারে, কিন্তু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এসব শুনলে এক্ষুনি তর্ক-বিতর্ক করতে শুরু করে দেবে !!
যাই হোক, হিমালয়ের আর একটি বিশেষ আকর্ষণ হোলো__এর অসাধারণ সৌন্দর্য !! সমগ্র পৃথিবীতে প্রকৃতির অদ্ভুত সৌন্দর্য দেখার স্থান অনেক রয়েছে। মানুষ সেইসব স্থানে দল বেঁধে যায়ও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ! কিন্তু হিমালয়ের বিভিন্ন point থেকে যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায় – তা এককথায় অনবদ্য, পৃথিবীর অন্য কোথাও এর কণামাত্রও পাওয়া যায় না ! ধবলগিরি থেকে সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য অপূর্ব ! ওটা দেখে কি মনে হয় জানো – মনে হয় যেন মাইলের পর মাইল তরল সোনার বন্যা ! বরফের বাষ্পগুলোর ঢেউ-এ প্রভাত সূর্যের রং লেগে ঢেউ-এর আকারে চলে যায় মাইলের পর মাইল !! আমি নরওয়েতে গিয়ে মেরুপ্রদেশের মেরুজ্যোতি বা অরোরা বেরিয়ালিস দেখেছি – লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য কত খরচ করে ওখানে পাড়ি জমায় ! কিন্তু হিমালয়ের ওই দৃশ্য যদি সৌন্দর্যপিপাসু একবারের জন্য-ও দেখতে পেতো__ তাহলে সত্যিই তাদের জীবন সার্থক হয়ে যেতো ! কিন্তু যোগীপুরুষ ছাড়া ধবলগিরির চূড়ার বিভিন্ন point-এ উঠে ঐ সৌন্দর্য উপভোগ আর কে করবে বল ? পর্বতারোহীরা নির্দিষ্ট স্থানে treking করে – ওরাও ঐসব particular point (যেখান থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য মনোরমভাবে দেখা যায়) গুলোয় যেতে পারে না বা সন্ধান‌ও জানে না !!
নেপালের মৎস্যপূছ থেকে গণ্ডকী নদীর উৎসের দিকে যাওয়া যায় ! ঐ পথ ভীষণ দুর্গম ! মাকড়সার মতো ঝর্ণার ধারার ভিতর দিয়ে পাথরের দেয়াল ধরে ধরে একপা একপা করে অগ্রসর হোতে হয় – বুঝতে পারছো তো ব্যাপারটা ! যে কোনো মুহূর্তে প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা ! কত সাধু-সন্তের প্রাণহানি হয়েছে ওখানে_তার হিসাব নাই। তবু মানুষ ঐ পথ ধরেই বারবার যেতে চায়_কারণ কি অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য ওখানে! ওইসব স্থান থেকে নিচের উপত্যকার দিকে তাকালে মনে হয় সত্যিই যেন কল্পনার স্বর্গরাজ্যে এসে পৌঁছেছি ! ওই দুর্গম পথ ধরে শুধু সাধু-যোগীরাই যায়, স্থানীয় অধিবাসীরাও ঐসব পথের সন্ধান জানে না !
আসলে হিমালয়ের তো বিশাল ব্যাপ্তি ! লম্বায় প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার আর চওড়ায় গড়ে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার ! তাহলে বুঝতে পারছো তো – কত বিশাল ! তাছাড়া অসংখ্য চূড়া আর গভীর বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ! তাছাড়াও রয়েছে প্রচুর ঝরনা, যারা পর্বতের গা বেয়ে তীব্রবেগে নিচে নেমে এসে বিশাল বিশাল খাদ সৃষ্টি করেছে ! হিমালয়ের মধ্যেই রয়েছে শিবস্থান কৈলাস পর্বত, যার ধারে-কাছে_ এখনও পর্যন্ত কোনো মানুষ যেতেই পারেনি !
এইসব নানান কারণে হিমালয় দুর্জ্ঞেয়, রহস্যময় হয়েই রয়ে গেছে ! তাই মানুষের কাছে হিমালয় সব সময়েই কৌতূহলের জায়গা _ কিন্তু সাধুসন্তদের সাধন-ভজনের জায়গা।।