জিজ্ঞাসু :– বৈষ্ণবদের ‘দাস’ভাবটা খুবই ভালো – এই মতের লোকেরা দীনহীন হয়ে থাকে – তাই ঝগড়া, মারামারি ইত্যাদির সম্ভাবনা কম – তাই নয় কি মহারাজ?
গুরুমহারাজ :– এই রকমটা হোলে তো খুবই ভালো হোতো বাবা_ কিন্তু বাস্তবে কি তা হয় ? তথাকথিত বৈষ্ণব-গোঁসাইরা মুখে নিজেদেরকে বলে ‘দাস’ , কিন্তু ‘প্রভু’ না বললে রেগে যাবে ! কালনার ভগবানদাস বাবাজীকে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘দাস-আমি’ ভাব নিয়ে চলতে ! নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরম্পরাতেও এটাই বলা হয়৷ কিন্তু যদি কোনো বৈষ্ণব আশ্রমে যাও তো দেখবে, যিনি মন্ডলেশ্বর অর্থাৎ মঠ-মিশনের যিনি Head – তাকে ‘প্রভু’ বলেই সম্বোধন করতে হয়।
আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা বলছি শোনো। একবার দক্ষিণভারতে গোদাবরীর তীরে যেখানে রায় রামানন্দের সাথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দেখা হয়েছিল – সেখানে গেছিলাম। আমার সাথে ছিল দেবেন্দ্রনাথ আর মুরতি-নামে অন্য একটি দক্ষিণভারতের ছেলে। ওখানে পরবর্তীতে মহাপ্রভু ও রামানন্দের স্মৃতি রক্ষার নিমিত্ত গৌড়ীয় মঠ স্থাপিত হয়েছে। দেখলাম বেশ বড়সড় মঠ – অনেক লোকজন রয়েছে। ওখানকার মঠাধ্যক্ষ একজন বাঙালি। আমি গোদাবরীর তীরে একাই বসেছিলাম(খুব সম্ভবতঃ মহাপ্রভু এবং রায় রামানন্দের সাক্ষাতের স্থানেই), দেবেন্দ্রনাথ ভিতরে গিয়ে ঐ মঠাধীশকে ডেকে নিয়ে এলো। উনি আসতেই ওনার পরনে গেরুয়া দেখে আমি উঠে দাঁড়িয়ে “ওঁ নমো নারায়ণঃ”- বলে সাধু পরম্পরায় প্রচলিত সম্বােধন করলাম। কিন্তু এটা করতেই – ওই ভদ্রলোক(মন্ডলেশ্বর) রেগে গেল ! আমি জিজ্ঞাসা ওনাকে করলাম– আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন ? নারায়ণ তো ভগবান বিষ্ণুর নাম – তাহলে রাগের কি কারণ ? তখন উনি বললেন – “কোনো মানুষকে ‘নারায়ন’ বলা উচিত নয় ! ‘নমো নারায়ণঃ’ একমাত্র নারায়ণের বিগ্রহকেই বলা যায় বা এই মন্ত্রে প্রণাম করা যায়।”
আমিই বা ছাড়বো কেন – আমি বললাম, “কিন্তু আপনি তো জানেন যে__ মনুষ্য শরীরেই ‘নারায়ণ’ প্রথম প্রকট হয়েছিলেন পৃথিবীতে – আর সেইটা স্মরণ করেই তো একজন সন্ন্যাসী অন্য সন্ন্যাসীকে বলেন ‘নমো নারায়ণঃ’! ”
এই রকম নানাভাবে বোঝানো সত্ত্বেও ওই সাধুজী কিছুতেই আমার কথা মানতে চাইলেন না – উনি ওনার নিজের মতেই stick করে থাকলেন!
আমি জানতাম গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা পরস্পর পরস্পরকে “হরেকৃষ্ণ”, “জয় রাধে”, “জয় নিতাই”- ইত্যাদি বলে সম্মোধন করে। তাই এবার আমি জোড়হাত করে তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম “হরেকৃষ্ণ”! এটাতে ও আরও রেগে গেল ! ও বলে উঠলো – ” আমার সাথে মজা করছো ?” এছাড়া আর দু-চারটে কড়া কথাও বললো।
ওই আশ্রমে মঠাধীশ-ই বাঙালী ছিল, বাকি যারা সাদা কাপড়ের লোক ছিল (ব্রহ্মচারী বা কর্মী) তারা সবাই তেলেগুভাষী ছিল। আমি একদম শান্ত, ধীর স্থির অবস্থায় আমার যুক্তি বা বক্তব্য সাধুটিকে বলছিলাম – কিন্তু সাধুটি সবেতেই রেগে যাচ্ছিলো ! ফলে ওরা সাধুটির মোটা মোটা চোখ বা মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারছিল – কিছু একটা ঘটছে ! ওখানে উপস্থিত ছিল দেবেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ তেলেগু এবং বাংলা দুটো ভাষাই জানতো, ও সবই বুঝতে পারছিল। ওখানকার লোকগুলোর সাথে ও তেলেগু ভাষাতেই কথা বলেছিল – তাই ওখানকার আশ্রমের লোকেরা দেবেন্দ্রর কাছেই জানতে চাইলো – “ব্যাপারটা কি হোচ্ছে”, দেবেন্দ্র দেখল কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হোতে পারে – তাই ও বুদ্ধি খাটিয়ে বলে দিল “ভগবানের বিষয়ে-ই চর্চা হোচ্ছে !” এই কথা শুনে অন্যান্যরা আপন আপন কাজে চলে গেল।
এবার ঐ সাধুটি (মঠাধীশ) আমাকে আমার পরম্পরা, পরম্পরার আদর্শ এইসব সম্বন্ধে জানতে চাইলো। আমি আমার পরম্পরার কথা বললাম, আর বললাম “আমার আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ” – ব্যস্, মন্ডলেশ্বর আবার রেগে গেল ! জানো তো __স্বামী বিবেকানন্দের নামে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের খুব এলার্জি ! বাঙলা থেকে অত দূরে (পশ্চিমবাঙলা থেকে) থাকা সত্ত্বেও বোষ্টম-centiment কতটা প্রবল ! ওই যে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কালীপূজা করতেন আর বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য, স্বামীজীর খাওয়া-দাওয়ার বাছ-বিচার ছিল না – ইত্যাদি আরও নানান কারণে স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি এদের খুবই অনীহা !
কিন্তু দ্যাখো – এ যুগের যুবসম্প্রদায়ের আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ ! আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি মেনে নিয়েছে – আর আমাদের দেশের এরা সেটা কিছুতেই মানতে পারছে না !!
গুরুমহারাজ :– এই রকমটা হোলে তো খুবই ভালো হোতো বাবা_ কিন্তু বাস্তবে কি তা হয় ? তথাকথিত বৈষ্ণব-গোঁসাইরা মুখে নিজেদেরকে বলে ‘দাস’ , কিন্তু ‘প্রভু’ না বললে রেগে যাবে ! কালনার ভগবানদাস বাবাজীকে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘দাস-আমি’ ভাব নিয়ে চলতে ! নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরম্পরাতেও এটাই বলা হয়৷ কিন্তু যদি কোনো বৈষ্ণব আশ্রমে যাও তো দেখবে, যিনি মন্ডলেশ্বর অর্থাৎ মঠ-মিশনের যিনি Head – তাকে ‘প্রভু’ বলেই সম্বোধন করতে হয়।
আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা বলছি শোনো। একবার দক্ষিণভারতে গোদাবরীর তীরে যেখানে রায় রামানন্দের সাথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দেখা হয়েছিল – সেখানে গেছিলাম। আমার সাথে ছিল দেবেন্দ্রনাথ আর মুরতি-নামে অন্য একটি দক্ষিণভারতের ছেলে। ওখানে পরবর্তীতে মহাপ্রভু ও রামানন্দের স্মৃতি রক্ষার নিমিত্ত গৌড়ীয় মঠ স্থাপিত হয়েছে। দেখলাম বেশ বড়সড় মঠ – অনেক লোকজন রয়েছে। ওখানকার মঠাধ্যক্ষ একজন বাঙালি। আমি গোদাবরীর তীরে একাই বসেছিলাম(খুব সম্ভবতঃ মহাপ্রভু এবং রায় রামানন্দের সাক্ষাতের স্থানেই), দেবেন্দ্রনাথ ভিতরে গিয়ে ঐ মঠাধীশকে ডেকে নিয়ে এলো। উনি আসতেই ওনার পরনে গেরুয়া দেখে আমি উঠে দাঁড়িয়ে “ওঁ নমো নারায়ণঃ”- বলে সাধু পরম্পরায় প্রচলিত সম্বােধন করলাম। কিন্তু এটা করতেই – ওই ভদ্রলোক(মন্ডলেশ্বর) রেগে গেল ! আমি জিজ্ঞাসা ওনাকে করলাম– আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন ? নারায়ণ তো ভগবান বিষ্ণুর নাম – তাহলে রাগের কি কারণ ? তখন উনি বললেন – “কোনো মানুষকে ‘নারায়ন’ বলা উচিত নয় ! ‘নমো নারায়ণঃ’ একমাত্র নারায়ণের বিগ্রহকেই বলা যায় বা এই মন্ত্রে প্রণাম করা যায়।”
আমিই বা ছাড়বো কেন – আমি বললাম, “কিন্তু আপনি তো জানেন যে__ মনুষ্য শরীরেই ‘নারায়ণ’ প্রথম প্রকট হয়েছিলেন পৃথিবীতে – আর সেইটা স্মরণ করেই তো একজন সন্ন্যাসী অন্য সন্ন্যাসীকে বলেন ‘নমো নারায়ণঃ’! ”
এই রকম নানাভাবে বোঝানো সত্ত্বেও ওই সাধুজী কিছুতেই আমার কথা মানতে চাইলেন না – উনি ওনার নিজের মতেই stick করে থাকলেন!
আমি জানতাম গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা পরস্পর পরস্পরকে “হরেকৃষ্ণ”, “জয় রাধে”, “জয় নিতাই”- ইত্যাদি বলে সম্মোধন করে। তাই এবার আমি জোড়হাত করে তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম “হরেকৃষ্ণ”! এটাতে ও আরও রেগে গেল ! ও বলে উঠলো – ” আমার সাথে মজা করছো ?” এছাড়া আর দু-চারটে কড়া কথাও বললো।
ওই আশ্রমে মঠাধীশ-ই বাঙালী ছিল, বাকি যারা সাদা কাপড়ের লোক ছিল (ব্রহ্মচারী বা কর্মী) তারা সবাই তেলেগুভাষী ছিল। আমি একদম শান্ত, ধীর স্থির অবস্থায় আমার যুক্তি বা বক্তব্য সাধুটিকে বলছিলাম – কিন্তু সাধুটি সবেতেই রেগে যাচ্ছিলো ! ফলে ওরা সাধুটির মোটা মোটা চোখ বা মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারছিল – কিছু একটা ঘটছে ! ওখানে উপস্থিত ছিল দেবেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ তেলেগু এবং বাংলা দুটো ভাষাই জানতো, ও সবই বুঝতে পারছিল। ওখানকার লোকগুলোর সাথে ও তেলেগু ভাষাতেই কথা বলেছিল – তাই ওখানকার আশ্রমের লোকেরা দেবেন্দ্রর কাছেই জানতে চাইলো – “ব্যাপারটা কি হোচ্ছে”, দেবেন্দ্র দেখল কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হোতে পারে – তাই ও বুদ্ধি খাটিয়ে বলে দিল “ভগবানের বিষয়ে-ই চর্চা হোচ্ছে !” এই কথা শুনে অন্যান্যরা আপন আপন কাজে চলে গেল।
এবার ঐ সাধুটি (মঠাধীশ) আমাকে আমার পরম্পরা, পরম্পরার আদর্শ এইসব সম্বন্ধে জানতে চাইলো। আমি আমার পরম্পরার কথা বললাম, আর বললাম “আমার আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ” – ব্যস্, মন্ডলেশ্বর আবার রেগে গেল ! জানো তো __স্বামী বিবেকানন্দের নামে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের খুব এলার্জি ! বাঙলা থেকে অত দূরে (পশ্চিমবাঙলা থেকে) থাকা সত্ত্বেও বোষ্টম-centiment কতটা প্রবল ! ওই যে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কালীপূজা করতেন আর বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য, স্বামীজীর খাওয়া-দাওয়ার বাছ-বিচার ছিল না – ইত্যাদি আরও নানান কারণে স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি এদের খুবই অনীহা !
কিন্তু দ্যাখো – এ যুগের যুবসম্প্রদায়ের আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ ! আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি মেনে নিয়েছে – আর আমাদের দেশের এরা সেটা কিছুতেই মানতে পারছে না !!