জিজ্ঞাসু :– আচ্ছা গুরুজী_ ত্রিপিটক কি তিনটি পৃথক পৃথক গ্রন্থ ?
আর একটা জিজ্ঞাসা করছি__আপনার কাছেই একবার শুনেছিলাম, ভগবান বুদ্ধ একবার দান গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন ! এই কথা শুনে –ভগবান বুদ্ধের সবচাইতে প্রিয় পদ্মফুল দেবার জন্য রাজা-মহারাজার মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় – এরকমটাই শুনেছিলাম ! ঘটনাটি যদি একটু বিস্তারিত বলেন ?
গুরুমহারাজ(ঐ ব্যক্তির জিজ্ঞাসার ধরণ দেখে গুরুজী একটু হাসলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন…) :– হ্যাঁ, ত্রিপিটক হোলো তিনটি পিটক(‘পিটক’ কথার অর্থ হোলো_কোনোকিছু সংরক্ষণ করার স্থান বা পাত্র) – বিনয়পিটক, সূত্রপিটক এবং অভিধর্মপিটক ! শুধুমাত্র সন্ন্যাসীদের গ্রহণযোগ্য যে সমস্ত শিক্ষা, বুদ্ধশিষ্য উপালি-র দ্বারা সংকলিত হয়েছিল তাই ‘বিনয়পিটক’ ! বৌদ্ধধর্মের শিক্ষার সারভাগগুলি সূত্রাকারে সংকলন করেছিলেন বুদ্ধশিষ্য সারিপুত্ত – তাই ওই অংশের নাম হোলো ‘সূত্রপিটক’। ভগবান বুদ্ধের শিক্ষার ব্যাখ্যা বা বৌদ্ধদর্শন সংকলন করেছিলেন মহাকশ্যপ – এটির নাম হোলো ‘অভিধর্মপিটক’। বুদ্ধের নির্দেশেই এই সংকলন করা হয়েছিল। এই তিনটি সংকলন একত্র করে ‘ত্রি-পিটক’, যা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ !
তবে, তুমি ভগবান বুদ্ধের বিশেষ দান-গ্রহণের কথা যেটা বলছো এবং যেটির কথা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে __ সেটি ঘটেছিল সারনাথে। ভগবান বুদ্ধ সাদা পদ্ম খুব ভালবাসতেন। তাই বুদ্ধের ভক্তরা সুযোগ সুবিধা পেলে ভগবান বুদ্ধকে পদ্মফুল পায়ে দিয়ে প্রণাম করতো। কোন এক সময় (অবন্তী বা শ্রাবস্তী?) একস্থানে ভগবান অবস্থান করছিলেন। সেদিন যে কোনো কারণে বাজারে ফুল বিক্রেতাদের মধ্যে, একজনের কাছে একটিই মাত্র পদ্মফুল ছিল। তাই সেই ফুলটি কিনে ভগবানকে দেবার জন্য তখন ধনী-শ্রেষ্ঠীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল ! সবার দর ডাকাডাকিতে ওই একটি ফুলের অনেক দাম উঠে যায় ! নগরের ধনী ব্যক্তিদের এইরকম কারবার দেখে অবাক হয়ে ঐ ফুল-বিক্রেতা তখন ঐ ফুলটি নিয়ে, ঝেড়ে-মেরে উঠে পড়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেছিল– “এই ফুল আমি কাউকে বিক্রি করবো না। এতগুলি ধনীলোক সহস্র স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে_এই ফুলটি দিয়ে, যাঁকে খুশি করতে চাইছে – নিশ্চয়ই এরা তার বিনিময়ে ওনার কাছ থেকে আরও বেশি কিছু পাবে ! তাহলে আমি-ই তাঁকে এই ফুল দেবো – যাতে আমি-ই আরো বেশি কিছু পাই !” __এই বলে ঐ ব্যক্তি নিজেই গিয়ে ভগবান বুদ্ধকে বাজারের একমাত্র পদ্ম-টি বুদ্ধের চরণে অর্পণ করেছিল। আর বলাই বাহুল্য – ভগবান বুদ্ধ ওই ব্যক্তির (সুমালী) প্রতি খুবই প্রসন্ন হয়েছিলেন !
তবে, ঐ ব্যাপারটা কিন্তু বুদ্ধের জীবনে
শ্রেষ্ঠ দান গ্রহণের ঘটনা ছিল না ! ঐ ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন ! বুদ্ধের জীবদ্দশায় একবারই মহাসংগতি হয়েছিল এবং সেটা হয়েছিল সারনাথে। সেদিন উনি চুপচাপ সারনাথের আম্রকুঞ্জে বসেছিলেন – কারোর সাথে কোনো কথাই বলছিলেন না, শিষ্যেরা সবাই উৎকণ্ঠায় ছিল__ কি হয় ! কি হয় ! হঠাৎ ভগবান বুদ্ধ উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন – ” এখন ধর্মবিজয়ের সময় হয়েছে ! তাই এবার আমি আমার ভক্তদের মধ্যে থেকে একজনের দান গ্রহণ করবো _যে লাশটি হবে সর্বশ্রেষ্ঠ দান ! যতক্ষণ না এই ‘শ্রেষ্ঠ দান’ আসছে – ততক্ষণ আমি এই আসন ছেড়ে উঠব না !” এই বলে তিনি চুপচাপ আসন গ্রহণ করলেন।
ভগবান বুদ্ধের এইকথা মুহূর্তের মধ্যে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। নগরের শ্রেষ্ঠীরা ঘড়া ঘড়া ধন-রত্ন নিয়ে এসে হাজির হোতে শুরু করলো, রাজা-মহারাজারা খবর পেয়ে নিয়ে এলো ধনরত্নসহ হাতি-ঘোড়া এবং আরো অনেক কিছু ! কিন্তু ভগবান বুদ্ধ কারো কোনো দানের দিকে ফিরেও তাকালেন না, গ্রহণ করা তো দূরের কথা ! তিনি যেমন ছিলেন, তেমনই চুপচাপ বসে র‌ইলেন। আনন্দ, সারিপুত্ত আদি অন্যান্য ভক্তরাও খুবই চিন্তায় ছিল– কিভাবে ‘শ্রেষ্ঠ দান’ জোগাড় করা যায় !
এদিকে হয়েছে কি__ঐ শহরে একজন অতি বৃদ্ধা, গরীব-ভিখারিনী ছিল, যার পরনের একটা গোটা কাপড়ও ছিল না। একটা কাপড় আধখানা করে ছিঁড়ে সে দুবেলায় আলাদা আলাদা করে পড়তো !
সেই ভিখারিনী বৃদ্ধা যখন শুনলো_ ‘ভগবান বুদ্ধ আজ নিজের মুখে ‘দান’-গ্রহণ করবেন বলেছেন’, তখন তার খুবই আগ্রহ হোলো__ এই সুযোগে একবার ভগবানের দর্শন করা এবং তাঁর হাতে যাহোক কিছু তুলে দেওয়া ! সেই বৃদ্ধা আধখানা কাপড় শুকিয়ে নিয়ে পড়ে নিল আর পাশের বাগানে খুঁজে খুঁজে একটা পাখিতে ঠোকড়ানো পাকা পেঁপে কুড়িয়ে পেল। পাখিতে ঠোকরানো ফল ঠাকুর-দেবতাকে দেওয়া যায় না – একথা ওই বুড়ি-মা জানতেন কিন্তু তাঁর তো ফল কিনে দেবার পয়সা নেই – তাই অগত্যা এই ফলটিকেই ভালো করে ধুয়ে নিয়ে কাপড়ের তলায় চাপা দিয়ে লুকিয়ে হাঁটা দিল বৃদ্ধা !
দীর্ঘপথ হাঁটা তার পক্ষে বড় কষ্টের ! যেন সে শরীর আর টানতে পারছে না ! একে অনাহার-অর্ধাহার, তায় বয়সের ভার – আর অতটা পথ হাঁটা ! কিন্তু অদম্য মনের জোরে বৃদ্ধা ঠিক পৌঁছে গেল সারনাথের সেই আম্রকুঞ্জে – যেখানে ভগবান বুদ্ধ সকাল থেকে এক আসনে ঠায় বসে বসে অপেক্ষা করে আছেন শ্রেষ্ঠ দানের জন্য !
এদিকে দিনমণি অস্তাচলের দিকে ঢলে পড়েছে – ধনী, শ্রেষ্ঠী, রাজা-মহারাজাদের ভিড় ঠেলে ঐ বৃদ্ধা ভগবানের কাছে পৌঁছাতেই পারছে না। কেউ তাকে ঢুকতেই দিচ্ছিলো না – ধাক্কাধাক্কি করছিল, আর এতে ঐ বৃদ্ধা আরও আহতও হোচ্ছিলেন। ভগবান বুদ্ধ এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলেন – হঠাৎ করে আনন্দ আর উপালিকে ডেকে বললেন – ” তোমরা যাও দেখো – বাইরে এক বৃদ্ধা মা ভিতরে ঢুকতে চাইছে – ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো !” ওরা ভগবানের মুখের কথা শোনা মাত্রই দৌড়ে গিয়ে সেই মা-টিকে নিয়ে এলো ! সেই কম্পিত কলেবর, পথশ্রমে ক্লান্ত- বিধ্বস্ত বৃদ্ধা ভগবান বুদ্ধের সামনে দাঁড়াতেই ভগবান ভিক্ষা-মুদ্রায় দুহাত ঐ বৃদ্ধার সামনে মেলে ধরলেন, বললেন_”দাও মা দান দাও !” আনন্দে আত্মহারা হয়ে সেই বৃদ্ধা আঁচলের তলা থেকে খুঁতো পাকা ফলটি (পাখি ঠোকরানো) ভগবান বুদ্ধের হাতে দিয়ে – তাঁর দুহাতের মধ্যে মাথা রেখে ঐখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বুদ্ধলোকে গমন করলেন !
এ এক চরম আত্মত্যাগের কাহিনী ! বৃদ্ধার মৃতদেহকে যত্ন করে পাশে রেখে দিয়ে, আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ভগবান বুদ্ধ ! তারপর উচ্চৈস্বরে বলে উঠলেন – ” বা-জা-ও ভেরী !” বৌদ্ধসংঘে বরাবরই থাকে বড় বড় জয়ঢাক –ভগবান বুদ্ধের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল সমস্ত ধর্মভেরী ! বারবার তিনবার ! তিনবার কেন বাজলো – “বুদ্ধং শরণনম্ গাচ্ছামি, ধর্মং শরণম্ গচ্ছামি, সঙ্ঘম্ শরণম্ গচ্ছামি !”
ভগবান বুদ্ধের ধর্মবিজয়ের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মভেরী বেজে উঠলো, আর এই ঘটনার পরেই বুদ্ধের শিষ্যেরা ধর্মবিজয়ের নিমিত্ত চতুর্দিকে বেরিয়ে পড়েছিলেন !
এই ঘটনার পর থেকেই বৌদ্ধ ধর্মমত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এবং আরো পরে ভারতবর্ষের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল।
বৌদ্ধ ধর্মমত ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসার ধর্ম । ধীরে ধীরে ভগবান বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মমত, রাজন্যবর্গেরাও গ্রহণ করতে শুরু করলো। আর এর চূড়ান্ত রূপ পেল বুদ্ধের মহাপ্রয়াণের প্রায় ৫০০ বছর পরে, যখন সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন। অশোক ভগবান বুদ্ধের মহাসংগতির কথা স্মরণ করে সারনাথে আবার মহাসংগতি বা বৌদ্ধ শ্রমণ ও ভক্তদের নিয়ে বিরাট সম্মেলন করলেন। ওখানে তৈরি হোলো স্মৃতিস্তম্ভ – যা পরবর্তীতে অশোকস্তম্ভ নামে পরিচিত হয়েছিল।
ভগবান বুদ্ধের ধর্মবিজয়ের পুণ্যস্মৃতি ও পুণ্যস্থানে স্থাপিত ধর্মস্তম্ভের ধর্মচক্র-ই পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় পতাকায় স্থান পায় এবং সারনাথের ঐ অশোকস্তম্ভের চারটি সিংহের মুখ-ই ভারতের জাতীয় symbol হিসাবে গ্রহণ করা হয়। যাইহোক, সম্রাট অশোকের মহাসংগতিতেও বাজানো হয়েছিল ধর্মভেরী – আর ওখান থেকে বৌদ্ধ শ্রমণদের সাথে সাথে অশোকের পুত্র এবং কন্যা মহেন্দ্র এবং সংঘমিত্রা-ও ধর্মবিজয়ের জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে বেড়িয়ে পড়েছিল। মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রা গিয়েছিল সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য !