[ “ভারতবর্ষের উন্নতি রাজনৈতিক কারণে হোচ্ছে, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের দ্বারা নয়”___এই জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন গুরু মহারাজ। আজ পরবর্ত্তী অংশ..!]
….. ভারতবর্ষের বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নতি যেটুকু দেখছো – তা সবুজ বিপ্লবের ফল ! এই ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধির কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু তবু বলছি ভারতবর্ষের কৃষকেরা নিজস্ব প্রেরণা ও প্রচেষ্টার দ্বারা এটা করেছে ! সরকারি সাহায্য তারা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু কৃষকের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা-ই তাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে ! জানো – (অভাব) প্রয়োজন থেকেই আসে প্রেরণা, আর প্রেরণাই অভিব্যক্তির মূল ! অন্তরের প্রেরণার তাগিদেই জীবসকল এগিয়ে চলার পথ খুঁজে পায়। হাতির লম্বা শুড়, জিরাফের লম্বা গলা – এগুলি সবই তো হয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে এবং অন্তর থেকে প্রেরণা জাগার ফলেই !
চাষিরা চাষ করবেই – না হোলে তারা খাবে কি ? তারা নিজেরা বাঁচবে কি করে, বা তাদের জীবন-যাত্রা চলবে কি করে ? কৃষিই যে তাদের একমাত্র জীবিকা ! কোনো বছরে হয়তো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে (খরা, বন্যা ইত্যাদি) বা অন্য কোনো কারণে চাষে loss হয়েছে, কিন্তু চাষী পরের বছরে আবার চাষ করছে অধিক production-এর আশায়, অধিক লাভের আশায় ! এইভাবেই সবকিছুই এগিয়ে চলে সামনের দিকে – একেই ডারউইন বলেছে – Survival of the fittest !
আদিম মানব সমাজ থেকে আজ এই একবিংশ শতক পর্যন্ত_ যদি মানুষের বিবর্তনের ধারা ধরে বিচার করো, তাহলে দেখা যায়__ আদিম মানবসমাজে যারা ছিল ‘শক্তিমান’, তারাই অপরদেরকে control করতো ! আর সেই শক্তিমানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতো একটা দল। আর সেই দলের লোকজনেরা ঐ শক্তিমান ব্যক্তিটিকেই তাদের নেতা বা সর্দার বলে মেনে নিতো।
এরপর মানুষ যখন একটু সভ্য হোলো, সমাজবদ্ধ হোলো তখন ‘বুদ্ধিমান’রা__ ‘শক্তিমান’-সহ বাকিদেরকে control করতে শুরু করলো৷ তখন তারাই হয়ে গেল সমাজ-নেতা ! তখনকার মানুষ ‘বুদ্ধিমান’-দেরকেই দলের নেতা হিসাবে মেনে নিল। আরও পরে সমাজে এসেছিল কূটনীতিবিদ বা রাজনীতিবিদরা !
সমাজজীবনের অগ্রগতির সাথে সাথে শক্তিমান ও বুদ্ধিমানদের মধ্যে একটা সদ্ভাব এবং understanding তৈরি হয়ে যায় ! পরস্পর পরস্পরকে মেনে নিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু এই সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরালো কূটনীতিবিদেরা। এরা সেখান থেকেই ফায়দা তোলার চেষ্টা করে ! সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাসের একটা দিক তোমাদের কাছে খোলসা করে দিলাম। সুতরাং তোমরাই বলো__ কূটনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি সমাজের কতোটা মঙ্গল করবে !
তাই বলছিলাম__ রাজনীতি সমাজের কোনো ভালো করতে পারে না! রাজনীতির শীর্ষে বসে থাকা ব্যক্তিটি ( বর্তমানের সমাজে এরাই রাজা, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী প্রভৃতি।) যদি ভাল হয়, সত্ত্বগুনী হয় তাহলে সেই সমাজের কিছুটা ভালো হোতে পারে! ব্যাপারটা বুঝতে পারলে ?
রাজনীতির দ্বারা কোনো সমাজে ভালো কিছু হয়েছে মানেই জানবে__সেখানকার শীর্ষে রয়েছে এক বা একাধিক ভালোমানুষ ! সমাজের ভালো হবার শর্ত এটাই ! এবার একটা জিজ্ঞাসা আসতে পারে যে__ “ভালো মানুষ বলতে কি বুঝবো” !! এর উত্তরে বলতে হয়__ ত্যাগী, বিবেকবান, বুদ্ধিমান, কর্তব্যসচেতন, সমাজ সচেতন ব্যক্তিরাই ভালো মানুষ !
বর্তমানের বুদ্ধিমানেরা সমাজের ভালোর চেয়ে মন্দ করে বসে বেশি।। কারণ তাদের বুদ্ধি, বিবেকাশ্রিত নয়। বুদ্ধির উৎকর্ষতার উদাহরণ হোলো প্রাচীন ভারতের ঋষিকুল ! যাঁরা আজ থেকে বহু বছর আগেই পৃথিবীর মানুষকে বাঁচার মন্ত্র শিখিয়েছে, জীবনে এগিয়ে চলার পথ দেখিয়েছে ! আর রাজনৈতিক বা কূটনীতিক নেতাদের উৎকর্ষতার উদাহরণ হিসেবে তুমি যাদের নাম করতে পারবে –ভালো করে ইতিহাস ঘেঁটে দেখো, তারা লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে, অসহায় নারী ও শিশুদের হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত করেছে !
প্রকৃত বুদ্ধিমানেরা (বিবেকাশ্রিত) কখনও শক্তিমানদের ভয় পায়নি ! বহু পুরোনো ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়__ ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে(বর্তমানের অবিভক্ত পাঞ্জাব) তৎকালীন এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তি কল্লন – দিগ্বীজয়ী বীর আলেকজান্ডারের রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি ! আলেকজান্ডারের সাথে কথা বলার সময় উনি নির্ভীকভাবে আলেকজান্ডারকে ভৎর্সনা করেছিলেন ! একটা অতি সাধারণ মানুষের এতো সাহস দেখে – আলেকজান্ডার তাকে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখান ! সেই কথা শুনে ‘কল্লন’ বলেছিলেন__ “শরীরকে হত্যা করা যায়, ‘আমাকে’ নয় !” এরপর সম্রাটের উষ্ণীশ ঐ একাকী, দরিদ্র, সামান্য ব্যক্তি অথচ মহাজ্ঞানী,আধ্যাত্মিক সন্ন্যাসীর পদতলে লুন্ঠিত হয়েছিল।
সম্রাট অশোক যখন তার ভাইদেরকে হত্যা করে ‘সম্রাট’ হবার পথ সুগম করছিলেন – সেইসময় বৌদ্ধ-শ্রমণ উপগুপ্তের সাথে অশোকের দেখা হয়৷ তার ভাইটি প্রাণভয়ে উপগুপ্তের আশ্রমে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। অশোকের হাতে উদ্যত রক্তাক্ত তরোয়াল দেখেও শান্ত,সৌম সন্ন্যাসী উপগুপ্ত হাসিমুখে অশোককে নিরস্ত করার চেষ্টা করছিলেন দেখে – সম্রাট অবাক হয়ে গেলেন। উনি সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “সাক্ষাৎ মৃত্যুর (অশোক) সামনে দাঁড়িয়েও তুমি হাসছো কিভাবে ? আমি এই রাজ্যের সর্ব শক্তিমান সম্রাট হয়েও সর্বদা আতঙ্কে থাকি !” সন্ন্যাসী উপগুপ্ত অশোককে জীবনে শান্তি কিভাবে পাওয়া যায়, তার রহস্য বোঝালেন ! এরপরে দেখা গিয়েছিল_ সম্রাট অশোক ঐ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উপগুপ্তের কাছেই শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হোয়েছিলেন। …..
(ক্রমশঃ)
[আলোচনাটি এখনো চলবে] !!