[“ভারতবর্ষে রাজনীতির দ্বারা উন্নতি হোচ্ছে__আধ্যাত্মিক লোকেদের দ্বারা নয়!” এই জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন গুরু মহারাজ। আজ শেষাংশ]
……. এইভাবেই দেখা যায় সম্রাটের গর্বিত মুকুট বারবার সর্বত্যাগী, জ্ঞানী, যোগী, মহাত্মার পদতলে বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে ! দ্যাখো, ল্যাংটাকে সবাই ভয় পায় ! প্রকৃতপক্ষে ল্যাংটা (সর্বত্যাগী)-কে ভগবানও ভয় পায় ! পুরাণে রয়েছে__ দেবসভায় দেবাদিদেব মহাদেব বা শিব কোনো কারণে হঠাৎ করে হাজির হয়ে গেলে –সাথে সাথেই দেবরাজ ইন্দ্র সহ সকল দেবতাগণ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানাতেন ! ল্যাংটার সম্মান দেখেছো_কারণ এর পিছনে ভয় রয়েছে যে ! অন্য দেবতাদের পদ হারানো বা অন্যকিছু হারানোর ভয় রয়েছে!ল্যাংটা শিবের সব‌ই রয়েছে_কিন্তু কোনোকিছুর হারাবার ভয় নাই।
দেব এবং দানবদের সহায়তায় যখন সমুদ্রমন্থন হয়েছিল_ ভালো ভালো জিনিস উঠেছিল, তখন সেগুলি দেবতারা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নিল ! দেবরাজ ইন্দ্র‌ই বেশিরভাগ জিনিস নিয়েছিল, কিন্তু যখন সমুদ্র থেকে হলাহল গরল বা ভয়ঙ্কর বিষ উঠলো –তখন আর সেটিকে ধারণ করার মতো কেউ নেবার নাই, তখন অগতির গতি সেই শিবের ডাক পড়েছিল !
শিবকে সেইজন্যে তো শুধু দেবতারাই নয়, রক্ষ-যক্ষ-মানব-দানব-ভুত-প্রেত ইত্যাদি সকলে মানে বা বলা চলে সকলেই মানতে বাধ্য হয় !
কিন্তু দ্যাখো – সাধারণ মানুষের ব্যাপারটা আলাদা, কারণ তারা টাকা-পয়সা, বিষয়-আশয়, জমি-জায়গা এইসব নিয়ে থাকতে ভালবাসে, এইসব নিয়েই একে অপরের সাথে বিবাদ করে । অপরদিকে শিবকে দ্যাখো, তিনি দেবদূর্লভ অমৃতের অধিকার নিয়েও কোনো বিবাদ করেননি – এমনকি সেই অমৃতের একটু ভাগও চাননি !!
মানব সমাজ চিরকাল‌ই ত্যাগীদেরকে সম্মান করে এসেছে_আজ‌ও করে! শিব বা শংকর সর্বত্যাগী – তাইতো তিনি সকলেরই সম্মানীয় !
পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জগতে ভোগী মানুষেরা, অহংকারী ব্যক্তিরা যদি শক্তিমান হয়ে ওঠে__তাহলে সাধারণ মানুষ তাদেরকে ভয়ে ভক্তি করে কিন্তু অন্তর থেকে ঘৃণা করে ! এইটা বোঝা যায় কখন বলো তো__ঐ সব ব্যক্তিরা যখন কা’তে (বিপদে বা অসুবিধায়) পরে__ তখন!! তখন ব্যাঙেও (দুর্বল লোকেরাও) তাদেরকে লাথি মারে !!
রাবণের মতো সাক্ষাৎ ‘ভয়ঙ্কর অহংকার’ পৃথিবীতে মানুষ হিসাবে কোনো সময় জন্ম নিয়েছিল কিন্তু রাম-রাবনের যুদ্ধের শেষে যখন তার মৃতদেহ মাটিতে পড়েছিল, তখন সেটা আর পাঁচটা সাধারণ শবদেহ ছাড়া আর কি ছিল__বলো তো ?
আর এক ‘সাক্ষাৎ অহংকার’ ছিল মহাভারতের যুগের দূর্যোধন ! গদাযুদ্ধে ভীম যখন মেরে মেরে দূর্যোধনের হাত-পা-কোমর ভেঙে দিয়েছিল, তখন ধরণীর ঐ ভীষণ ‘অহংকার’-অসহায় অবস্থায় একাকী মাটিতে পড়ে ছিল ! শেয়াল-কুকুর-শকুনসহ কিছু মাংসখাদক পাখিরা দুর্যোধনের শরীরের মাংস, এমনকি তার চোখদুটো খুবলে খাওয়ার চেষ্টা করছিল ! দুর্যোধন তখনও জীবিত কিন্তু ভাঙা হাত-পা নিয়ে ঐ পশুগুলিকে তাড়াবার সামর্থ্য নাই ! দেখেছো__অহংকারের কি নিদারুণ পরিণতি ! ঐ অবস্থায় যন্ত্রণায়, অসহায়ত্বের বেদনায় আর্তনাদ করছিল দুর্যোধন কিন্তু কোনো সাহায্য পায় নি ! সাধারণতঃ মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় – দূর্যোধনও যন্ত্রণা ও ভয় পেয়ে পেয়েই একসময় মারা গিয়েছিল !
দেখবে কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা হয়তো মারা যেতে বসেছে, তার বল-বুদ্ধি সবই হারিয়েছে__ তবু মৃত্যুকালে জল-জল করছে!! একটু জল-পান করে আরও কিছুক্ষণ বা কিছুদিন বাঁচতে চাইছে ! তখনও সে ভয় পাচ্ছে বোধহয় ‘সব শেষ হয়ে যাবে'(অর্থাৎ সে মারা যাবে)। আর শুধু মৃত্যুর সময়েই বা কেন – সাধারণ মানুষের টাকা-পয়সা, সম্মান ইত্যাদি চলে গেলেও মানুষ তার নিজের অস্তিত্ব হারাবার ভয় পায় ! তাই না !!
কিন্তু ভালো করে চিন্তা করে দেখোতো – মানুষের এত ভয়ের কারনটাই বা কি – কি হারাবে সে ? মানুষ যখন নিদ্রিত থাকে – তখন তো তার সেই অবস্থায় ধন, যশ, মান, বল, বুদ্ধি – এসব কিছুই থাকে না ! কিন্তু সেই অবস্থায় সে হারায় টা কি ? মৃত্যুও তো তাই ! মৃত্যু যেন দীর্ঘায়িত নিদ্রা ! মৃত্যু হোলে শুধু dimension change হবে – আর কি হবে ?
মৃত্যু – জীবনের পাশে পাশেই থাকে ! অজ্ঞানতার জন্য এই চরম সত্যটি মানুষ অনুভব করতে পারে না – তাই ভয় পায় ! কিন্তু মৃত্যু সত্য ! জীবন যদি সত্য হয়, তাহলে তো মৃত্যু আরও বেশি বেশি সত্য ! সবই যদি ঈশ্বরের রূপ হয়__ তাহলে মৃত্যুও ঈশ্বরেরই একটা রূপ ! কি ভালোই হতো যদি সমস্ত মানুষ মৃত্যুকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করতে পারতো ! এটা একমাত্র জ্ঞানীরাই পারেন। তাঁরা মৃত্যুকে ভয় তো পানই না বরং হাসিমুখে তাকে আলিঙ্গন করেন ! মৃত্যুকে জয় করতে পারেন বলেই তো এঁরা মৃত্যুঞ্জয় ! দধিচীর মতো জগৎকল্যাণে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পারেন এঁরা !
একটা কথা রয়েছে না__ “মৃত্যুবরণ করা”। কিন্তু এটি সবক্ষেত্রে খাটে না। একমাত্র ঐ ধরনের মহাত্মা-মহাপুরুষদের ক্ষেত্রেই খাটে ! যাঁরা আর পাঁচজন মানুষের মতো মারা যায় না, সত্যি সত্যিই মৃত্যুকে ‘বরণ’ করে নেন।
দক্ষিণভারতের বিখ্যাত ফিল্ম পরিচালক নায়নারের “শঙ্করাচার্য্য” নিয়ে একটা flim আছে ! সেখানে পরিচালক দেখিয়েছেন যে আচার্য্য শঙ্করের শেষ সময়ে যখন উনি উত্তরাখণ্ডে যাত্রা করছেন, তখন দেখলেন মৃত্যু তার পাশেই ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে(আচার্য্য সব সময়েই জানতেন যে, জীবন ও মৃত্যু একসাথে জড়াজড়ি করে অবস্থান করে)! আচার্য্য শঙ্কর মৃত্যুকে আহ্বান করে বললেন – “এসো!”– তারপর তাকে আলিঙ্গন করলেন এবং মৃত্যু বরণ করলেন !! এঁরাই মৃত্যুঞ্জয় !
সাধারণ মানুষের সাথে এঁদের কোনোদিন কোনো তুলনা করাই উচিৎ নয় ! একটা নারীকে পাবার জন্য মানুষ মারামারি করে – কিন্তু সর্বত্যাগী শিবকে স্বামীরূপে পাবার জন্য সাক্ষাৎ জগজ্জননীরূপিনী উমা বা পার্বতী তপস্যা করেন ! মা (মহামায়া বা যোগমায়া) স্বয়ং তাঁতে মুগ্ধ যখন সমগ্র জগৎ মায়া-তে মুগ্ধ !
‘ত্যাগ’ যাঁর জীবনে প্রতিষ্ঠিত__ তাঁকে পাওয়ার জন্যই তো তপস্যা ! এটা একটা রূপক। ব্রহ্মকে জানাই মানবজীবনের উদ্দেশ্য – তাই মানব তপস্যা করে আত্মোপলব্ধির জন্য বা ব্রহ্মকে জানার জন্য ! উমার শিবকে লাভ করার তপস্যার গল্প দিয়ে এটাই বোঝানো হয়েছে ! আর সেক্ষেত্রে তোমরা সবাই উমা, তোমরা সকলেই হর-প্রিয়া হবার চেষ্টা করছো ! এটাই সত্য যে, ঠিক ঠিক উমা হয়ে উঠতে পারলেই_ শঙ্করের বক্ষলগ্না হওয়া যায় !!