সময়:– 1987 সাল।
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:– সব্যসাচী মান্না, আশ্রমের কয়েকজন মহারাজ ও অন্যান্য ব্যক্তিগণ।
জিজ্ঞাসু:– জীবন্ত মানুষকে moving dead body বলা হয়েছে কেন? মানুষ যদি মৃত-ই হয়__ তাহলে জীবনের লক্ষণ এবং ধর্ম কি?
গুরুজী:—-ঐ টা স্বামী বিবেকানন্দের কথা! দ্যাখো, উনিই তো বলেছেন “গতিই জীবন, স্থিতিই মৃত্যু”! জীবশরীরের ক্রম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রাণশক্তির নিরন্তর প্রবাহ চলেছে downward থেকে forward এবং পরে forward থেকে upward এর দিকে। উদ্ভিদ থেকে প্রানের উৎক্রমনের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, মনুষ্যশরীরে এসে অর্থাৎ upward শরীরে তা পূর্ণতা পেল, অর্থাৎ evolution complete হোল কিন্তু তাতে চেতনার পূর্ণবিকাশ ঘটলো কি ?_ ঘটলো না! কেন ঘটলো না_এবার সেই আলোচনায় আসছি।
জড় এবং জীবনের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে! যেমন জড়ের ইচ্ছা শক্তি নাই_ জীবের আছে, জড়ের বোধশক্তি নাই_ জীবের আছে, জড়ের ‘বাঁচা বা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবার’ অর্থাৎ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা নাই _জীবের আছে,__ এই রকম আরো অনেক বলা যায়! এবার এখানে কথা হচ্ছে এই যে, সমস্ত জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জীব হওয়া সত্ত্বেও মানুষকে ‘চলমান মমি’ বা moving dead body বলা হোলটাই বা কেন?
কারণটা বেশ মজার! দ্যাখো, জলে বাস করেও _মাছ যেমন ‘জলবিজ্ঞান’ জানে না, তেমনি মানুষ _নিজে পূর্ণস্বরূপ হয়েও অজ্ঞানতা বা ভ্রান্তিবশতঃ ‘আমি দেহ’– এই বোধে সর্বদা থাকার জন্য, অহরহ ত্রিতাপ জ্বালায় ক্লিষ্ট হচ্ছে! জ্ঞানীরা এই ‘অবস্থা’-টাকে অর্থাৎ নিশ্চেষ্টভাবে শুধুই কামনা-বাসনার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে জন্ম থেকে জন্মান্তরে আত্নসুখভোগের আশায় অহরহ ক্লিষ্ট হওয়াটাকেই “মৃতবৎ” বলে ব্যাখ্যা করেছেন। শুধু চেতনাকে অন্তর্মুখী করলেই যেখানে চৈতন্যোদয় ঘটতো, সেখানে তার জন্য সচেষ্ট না হয়ে, কেবল গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলে যারা__ তাদেরকেই moving dead body বলা হয়েছে_কথাটা বুঝতে পারলে? এই ধরণের ব্যক্তিরা জীবন ধারণ করে শুধুমাত্র “আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা”-য়, জগতে কোন স্থায়ী কল্যান _এদের দ্বারা সংঘটিত হয় না! বরং জাগতিক সমস্তরকমের ‘অসহজতা’-র জন্য এরাই দায়ী! কারণ, এরা নিজেরাই অসহজ!
এবার কথা হচ্ছে, নিজেদের চেতনাকে অন্তর্মূখী করে তাঁরা চৈতন্যে উপনীত হয়েছেন অথবা হবার চেষ্টা করছেন তাঁদেরকেই ‘জীবিত’ বলা যায়! সেই অর্থে _’জীবিত’-দের অবশ্য পালনীয় ধর্মাদর্শের চারটি বিষয় আছে !
এর প্রথমটি হোল,”সত্য”__ মানবজীবনে ‘সদাচার’ অনুশীলনে এই সত্য প্রকটিত হয়।
এর দ্বিতীয়টি হোল, “ত্যাগ”__মানবজীবনে ‘পরোপকার’ অনুশীলনে এই ত্যাগ প্রকটিত হয়।
এর তৃতীয়টি হোল,”প্রেম”__ মানব জীবনে ‘ভালোবাসা’ অনুশীলনে প্রেম প্রকটিত হয়!
এর চতুর্থটি হোল “শান্তি”, মানবজীবনে ‘সংযমে’-র অনুশীলনে শান্তি প্রকটিত হয়!
শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় আছে_ “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরোধর্ম ভয়াবহঃ”_ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একথা বলেছেন! এখানে বিবেকপরায়ণতা-কে ‘স্বধর্ম’ এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণতা-কেই “পরোধর্ম” বলা হয়েছে! একমাত্র বিবেকপরায়ণ ব্যক্তিরাই জীবনে সদাচার-পরোপকার-ভালোবাসা ও সংযমের অনুশীলন করে চেতনাকে চৈতন্যের দিকে নিয়ে চলেন বা নিজের অপূর্ণতাকে পূর্ণত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেন! প্রকৃতপক্ষে এঁরাই গতিশীল_ তাই তাঁরা “জীবিত”! অপরদিকে আত্মবিস্মৃতি-রূপ ‘মহামৃত্যু’ যাদের ঘটে গেছে, তারা ‘পরধর্ম’ পরায়ণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়পরায়ণ হয়ে ওঠে, এবং তারা মিথ্যাচার-স্বার্থপরতা-প্রেমহীনতা-পাশবিকতা এবং অসংযমতাকে আশ্রয় করে! ফলে, এদের শুধুই horizontal movement হয় জন্ম থেকে জন্মান্তরে, প্রকৃত অর্থে upward movement বা কুলকুন্ডলীনীর ঊর্ধ্ব-গতি লাভ এদের হয়না! একটা পেরেক-কে মাটিতেখাড়াভাবে পুঁততে গেলে যেমন, horizontally হাতুড়ি চালালে পেরেকটা শুধুই সরে সরে যায় কিন্তু পোঁতা আর হয়না! অনন্তকাল ধরে চেষ্টা করলেও ঐ এক অবস্থাই হয়! আত্মোন্নতির প্রচেষ্টাহীন এই ধরনের ব্যক্তিদেরও তেমনি দশা হয়। বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ফিরে ফিরে আসতে হয়। এদেরকেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন moving dead body !
আগে ঐ যে পেরেকের কথা বলা হচ্ছিল_ সেটিকে মাটিতে পুঁততে গেলে, যেমন হাতুড়িটিকে উপরে বা ঊর্ধ্বে তুলতে হবে অর্থাৎ আগে upward-ভাবে তুলে__ তবে পেরেকের মাথায় আঘাত করা করতে হবে এবং তা করতে পারলে তবেই পেরেকটি মাটির ভিতরে প্রবেশ করবে। তেমনি মানুষের চেতনাকেও আগে চৈতন্যে উন্নীত করতে হবে_তবেই মানবজীবনে perfection বা পূর্ণতা আসবে। এইজন্যেই উপনিষদে বলা হয়েছে “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত” অর্থাৎ “ওঠো_জাগো”। ব্যক্তিজীবনে চেতনার উত্তরণ হয় এবং বিবেকের জাগরণ ঘটে। আর এইভাবেই ঈশ্বরমুখী হয়েই ওই পূর্ব উল্লিখিত মৃত-অবস্থা থেকে পুনর্জীবন লাভ করা সম্ভব হয়।
জিজ্ঞাসু:—আচ্ছা মহারাজ! ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন _ কথাটা কি ঠিক?
গুরুজী:— তোমার কি মনে হয়__ কথাটা বেঠিক? আচ্ছা, আগে বলো_ ঈশ্বর সম্বন্ধে তোমার ধারণাটা কি? কোন ব্যক্তি ঐ আকাশে বা উঁচুতে কোথাও বসে বসে কলকাঠি নাড়ছে, ভাঙছে-গড়ছে এইসব না কি? ঈশ্বর সম্বন্ধে এরূপ ধারণা করে একমাত্র মূর্খরা! এই মনোভাব কোন জ্ঞানী ব্যক্তি কখনোই পোষণ করেন না! কোন ঋষি মহাপুরুষ কখনো এরকম ধারণা মানুষকে কোনদিন দিয়েছেন কি?
যাইহোক, মন দিয়ে ব্যাপারটা শোন এবং বোঝার চেষ্টা করো। “ঈশ্বর”_ একটা শব্দ! যেমন ‘আল্লাহ’, ‘গড’ ইত্যাদি শব্দ_ ঠিক সেরকমই ‘ঈশ্বর’-ও একটা শব্দ! কিন্তু শব্দ দিয়ে শুধুই কি কোন কিছুর স্থুলরূপকে বোঝায়? যে কোন শব্দের একটা অন্তর্নিহিত অর্থও থাকে! সুতরাং “ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন”_ এই ভাবনার দ্বারা “ঈশ্বর”-কে যদি কোন ‘ব্যক্তি’ হিসেবে চিন্তা করে বস, তাহলে তোমার ভাবনায় ভুল হবে! ‘ঈশ্বর’_ একটা তত্ত্ব, কোন বস্তু বা ব্যক্তি নন। বেদ বলেছে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম্ _এই পঞ্চভূতের সৃষ্টি এই পৃথিবী। আর_ শুধু পৃথিবী কেন, এগুলি সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের-ই মুখের উপাদান! এদের প্রথম চারটি বস্তুসমূহের অবস্থার ভিন্নতা এবং পঞ্চমটি এদের আধার! ইংরাজিতে বলা যায় solid,liquid,gaseous, plasma and space! Space বা আকাশ-কে অবলম্বন করেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু অবস্থিত! পৃথিবীর উপরিভাগে plasma অবস্থায় কোন বস্তুকে পাওয়া যায় না, কিন্তু ভূ-অভ্যন্তরে এবং সূর্যের মতো জ্বলন্ত অবস্থায় যে সমস্ত নক্ষত্রেরা রয়েছে, তাদের মধ্যে এই ধরনের অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। plasma-অবস্থা সম্বন্ধে তাদের ধারণা এরকম যে, এক বর্গমিটার plasma-বস্তুর পৃথিবীর উপরিভাগে ওজন হবে_ 13000 মেট্রিক টন।
পৃথিবী কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে_ সেই নিয়ে বিজ্ঞানীদের নানা মত থাকলেও, সর্বাধুনিক গ্রহণযোগ্য যে মতটি সেটি হোল_ “বিগ ব্যাং থিওরি”! আধুনিক বিজ্ঞানীদের অভিমত পৃথিবীর সমস্ত গ্রহ সহ সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্রমন্ডলী, নীহারিকাপুন্জ ইত্যাদি সবকিছুই একই সাথে একটা নির্দিষ্ট নিয়মে এবং নির্দিষ্ট ক্রমে সৃষ্টি হয়েছিল। আদিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল 13×10-এর পিঠে 36টা শুন্য বসালে ,যে সংখ্যা হয়_তত ডিগ্রি সেলসিয়াস!
যাইহোক, পূর্বোক্ত থিওরি অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রথমে অতি অতি ঘনীভূত অবস্থায় একেবারে ‘বিন্দু’ রূপে ছিল! হঠাৎ big-bang বা মহাবিস্ফোট ঘটে যাওয়ায়_’অতি ঘনীভূত অবস্থা’_ প্রসারিত হতে হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে চতুর্দিকে ছুটে বেরিয়ে যেতে থাকে! ছুটে যাবার পথেই তারা কেউ কেউ এক একটা পারস্পরিক relattion-এ নিজেদেরকে আবদ্ধ করে ফেলে! এই ভাবেই এই সৌর পরিবারের মতো সৃষ্টি হয় অনেক অনেক নক্ষত্র পরিবার! যাদের সামগ্রিক রূপ Inter Galaxy Matter! অনেকগুলি এইরূপ গ্যালাক্সিরসামগ্রিক রূপ Inter Stalas Mater।এইভাবে অর্থাৎ গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, ছায়াপথ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন সিস্টেমে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সৃষ্টির শুরুতে যে মহাবিস্ফোট হয়েছিল তাতেই ব্রহ্মান্ড(ব্রহ্ম+অন্ড, অতি ক্ষুদ্র অন্ডাকৃতি সেই ঘনীভূত অবস্থা) চারিদিকে ভিন্ন ভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এখনও তারা পরস্পরে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই অবস্থাকে আধুনিক বিজ্ঞানীরা Theory of Expansion বা Expanding Theory বলছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা এই Expansion একদিন শেষ হবে, তখন ছড়িয়ে যাওয়া সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রাদি সহ সবকিছু আবার প্রচন্ড টানে কেন্দ্রে ফিরে আসবে! একেই বলা হচ্ছে Theory of Contraction! তখনই হবে মহাপ্রলয়! যখন সব গ্রহ-নক্ষত্রাদির Identity লুপ্ত হয়ে, আবার সেই পুরাতন অণ্ডরূপে ফিরে যাবে।
এতক্ষন তোমাকে বর্তমান বিজ্ঞানের আধুনিক মতবাদের সংক্ষিপ্ত ও সহজ ব্যাখ্যা বললাম এবং তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারলে যে এই বিশ্ব সৃষ্টির জন্য দায়ী সেই মহাবিস্ফোরণ বাbig-bang! এবার বলতো__ তুমি কি কখনো বাইরে কাউকে জিজ্ঞাসা করবে _ “আচ্ছা মশাই! big-bang-ই কি পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? করবে কি? নিশ্চয়ই না_ কারণ তুমি জানো, যে এটা একটা তত্ত্ব!_ একটা theory- মাত্র! কিন্তু যেই কেউ ওটাকেই “ঈশ্বর করেছেন”_ এরূপ বললো, অমনি ব্যাপারটা না বুঝেই_ তোমার মত কিছু লোক যেন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ল! বলতে শুরু করল _ “লোকটা_ ‘ঈশ্বর করেছে’,__ এই কথা উচ্চারণ করেছে, তাহলে ওকে ইঁট-পাটকেল মার! ওকে ‘পাগল’- বলে রাগা!”
কিন্তু কেন এই অসহিষ্ণুতা? তোমাদের অজ্ঞানতাই কি এর জন্য দায়ী নয়? কারণ এসব তথ্য আবিষ্কারের বহু হাজার বছর আগে আর্যশাস্ত্রাদি, ‘সৃষ্টিরহস্য’-এর কথা বহুভাবে বলে গেছে! “আসিৎ বিন্দু স্ততো নাদঃ”_বায়বীয় সংহিতার কথা। উপনিষদে অস্ফুট ব্রহ্ম থেকে স্ফুট ব্রহ্মের প্রকাশের কথা বলা হয়েছে! এছাড়াও উপনিষদ এবং পুরাণাদি শাস্ত্রও “প্রণব”(নাদ বা big bang)-কেই “ঈশ্বর” বলেছে। বলা হয়েছে “প্রণব” থেকেই সবকিছু সৃষ্টি__ তাই ইনি ব্রহ্মা, প্রনব-ই বিশ্বজগতে ব্যাপ্ত__ তাই ইনি বিষ্ণু, আবার প্রনবেই সবকিছু লয় হয়__ তাই ইনিই মহেশ্বর!
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষকে বোঝাবার জন্য একই “তত্ত্ব”(ঈশ্বর)-কে বিভিন্ন রূপকে, বিভিন্ন নাম প্রয়োগ করে ঋষিরা বলে গিয়েছিলেন। এখনো যে কোন মহাপুরুষকে এইভাবেই কথা বলতে হয়! ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যতান’-কে খুঁজে বের করাটাই Art ! দ্যাখো, ঈশ্বর-মানা বা না মানা-টা, কোন ব্যাপার নয়! বেদ বলেছে_ “জানো” ! কাকে জানবে? স্ব-স্বরূপকে জেনেই বা আত্নতত্ত্ব-কে জেনেই সেই পরম তত্ত্বের বোধ হয়! কারণ কেন্দ্র স্থির না করে যেমন কোন বৃত্ত অঙ্কন করা যায় না_তেমনি আবার একবার কেন্দ্র স্থির হয়ে গেলে যেমন বৃত্তের পরিধি বাড়াতে বাড়াতে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জোড়া টানা সম্ভব হয়__ তেমনি আত্মতত্ত্বের বোধ না হলে, কোন জিনিসেরই প্রকৃত স্বরূপের বোধ হয় না! আর আত্নতত্বের বোধ হয়ে গেলে আর কোনো তত্ত্বই অজানা থাকে না, সকল রহস্যেরই সমাধান হয়ে যায়।
স্থান:– শিবপুর, সময়:– জুন-জুলাই,88!
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:–গঙ্গা বাবু, এনাঙ্ক বাগচী, প্রবীর বাবু প্রমুখেরা।।
জিজ্ঞাসু :—ভাগবতে তিনটি কৃষ্ণের কথা আছে। এর মধ্যে কোনটিকে “পুরুষোত্তম” কৃষ্ণ বলা হবে?
গুরুজী:— তুমি অত অত বই পড়ে মাত্র তিনটি কৃষ্ণ পেলে? আমিতো অনন্ত কৃষ্ণ দেখতে পাই! জড় কৃষ্ণ, জীব কৃষ্ণ__ “কৃষ্ণময় জগত”_ দেখি! দ্যাখো, বেশি বই পড়ার বেশি বিপদ! এই জন্যই বলে যেন বেশি বই পড়তে নেই! তুমি বোধহয় ভাগবতে “কৃষ্ণ কৃষ্ণ ত্রি-সা কৃষ্ণ”_এইধরনের কোনো কথা কোথাও পেয়েছো, তাই তুমি এই ধরনের জিজ্ঞাসা করছো! তবে তোমার মত অনেক পন্ডিত-ই এরূপ জিজ্ঞাসা করে যে, বালকৃষ্ণ বা বৃন্দাবনের কৃষ্ণ, রাজা কৃষ্ণ বা মথুরার কৃষ্ণ এবং ভগবান কৃষ্ণ বা ‘কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ’__ এঁরা কি পৃথক? উত্তর হচ্ছে,_ “না, তা নয়!” প্রকৃতপক্ষে, ভগবানের অনন্ত শক্তির তিনভাবে প্রকাশ ঘটে থাকে_ সন্ধিনী (স্বরূপশক্তি বা অন্তরঙ্গা),সম্বিৎ( মায়াশক্তি বা বহিরঙ্গা) ও হ্লাদিনী(জীবশক্তি বা তটস্থা)! সৎ-চিৎ-আনন্দ এই তিনেই তো এক__ সচ্চিদানন্দ! বিভিন্ন শাস্ত্রাদিতে অ-উ-ম, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, বিন্দু-বিসর্গ(.:) ইত্যাদি প্রতি ক্ষেত্রেই তিন প্রকার প্রকাশের কথা বর্ণনা করা হয়েছে!
তাছাড়া শুধু কৃষ্ণ-ই বা কেন, তিন প্রকার রাধার কথাও বলা হয়েছে কামরাধা (চন্দ্রাবলী), প্রেমরাধা(ব্রজেশ্বরী) এবং নিত্যরাধা(গোলোকের রাধা)! সাধারনতঃ যুগ-প্রয়োজনে অবতারসমূহ যখন লীলা করতে আসেন তখন তাদের এই ত্রিবিধ শক্তির মধ্যে সবকয়টি প্রকাশের প্রয়োজন হয় না কিন্তু ভগবান কৃষ্ণের ক্ষেত্রে এই ত্রিবিধ শক্তির-ই প্রকাশ ঘটেছিল! তাই বলা হয় পুরুষোত্তম কৃষ্ণ। আবার বলা হয়েছে_ “কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং”! ভিন্ন ভিন্ন স্থানে, ভিন্ন ভিন্ন ভক্তের সঙ্গে এই ত্রিবিধ শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ! তাই ‘এক’-কে ‘তিন’ ভাবার কোনো কারণ নেই! বেশি বই পড়লে অনেক সময় অনেক জিনিস গোলমাল হয়ে যায়_ তাই আমি তোমাদের সকলকে বলছি, যেটুকু পড়লে ভগবৎ-লাভের আকাঙ্ক্ষা জন্মে_ শুধু সেইটুকু পড়ো! তারপর অনুশীলনে নেমে যাও! এই যুগে শুধুমাত্র “রামকৃষ্ণ কথামৃত” পড়লেই মানুষের ঈশ্বরলাভের আকাঙ্ক্ষা জাগবে_তাহলে তার থেকে বেশি পড়ায় কাজ কি? হাজার বছর ধরে পুস্তক পড়লেও অজ্ঞানতা বা সংশয় দূর হয় না কিন্তু “জো-সো” করে তাকে একবার লাভ করতে পারলেই হাজার বছরের জমাট অজ্ঞান-অন্ধকার এক লহমায় জ্ঞান-সূর্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে! সুতরাং যা করলে পরম প্রাপ্তি ঘটে তাই করাই শ্রেয়! তবে, স্বাধ্যায় ও শ্রুতি conception এনে দেয়_ perceptionর জন্য সদগুরু নির্দেশিত পথই একমাত্র পথ!
জিজ্ঞাসু:—-আচ্ছা পুরুষোত্তম এর সাথে সাধারণ অবতার_আদির পার্থক্য কি?
গুরুজী:—-দেখেছো, সঙ্গে সঙ্গে পার্থক্য খুঁজতে বসল! আমি তো আগেই বললাম যে, অবতারদের যুগ-উপযোগী শক্তি-প্রকাশের তারতম্য ঘটে মাত্র! তাই স্থুলবিচারে পার্থক্য খুঁজতে যাওয়া মূর্খতা হবে না কি? ‘অবতার অর্থাৎ descending’ এবং জীব অর্থাৎ acending! অতএব এটাতো সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, জীব-ভাব দিয়ে ‘শিব’কে বা শিব-ভাবের রহস্য বোঝা_ কখনোই সম্ভব নয়! বেদে ব্রহ্মের ষোলোকলা প্রকাশের কথা বলা আছে__সেটাকে এখন বলছি, এখান থেকেই তুমি তোমার উত্তর পেয়ে যাবে আশা করি! বলা হয় __
এক কলায় ব্রহ্ম জড়জগৎ রূপে প্রকাশমান।
দ্বিতীয় কলায় ব্রহ্ম উদ্ভিদজ( লতা, গুল্ম, ওষধি, বনস্পতি রূপে প্রকাশমান।
তৃতীয় কলায় ব্রহ্ম স্বেদজ (বীজাণু, কিটানু,জীবাণু) রূপে প্রকাশমান!
চতুর্থ কলায় ব্রহ্ম অন্ডজ (জলচর, খেচর, উভচর) রূপে প্রকাশমান।
ষষ্ঠ কলায় ব্রহ্ম জরায়ুজ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী গ্রুপে প্রকাশমান ।
অষ্টম কলায় ব্রহ্ম প্রকাশমান মানুষরূপে, হোমো ইরেকটাস থেকে হোমো স্যাপিয়েনস। তাই মানুষকে অর্ধ-কলার প্রকাশ-ও বলা হয়! এখানেই অভিব্যক্তির পূর্ণ প্রকাশ ঘটে। “অধঃমূলম্ অধঃশাখম্”-(উদ্ভিদজ) নিয়ে জীব-বিবর্তনের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা সম্পূর্ণতা লাভ করল মনুষ্য শরীরে এসে! যেখানে”ঊর্ধ্বমূলম্ অধঃশাখম্”। Vertical body লাভ করে জীব সকলের মধ্যে মানুষই প্রথম_ ভালোভাবে আকাশ দেখল, পর্বত_সমুদ্র দেখল! মনপ্রধান মানব এই প্রথম বিশালতার স্পর্শ পেলো মনে! অনুসন্ধিৎসা তাকে এগিয়ে নিয়ে চলল evolution-থেকে involution-এর দিকে_অপূর্ণতা থেকে পূর্নত্বের দিকে!
এইভাবে দশম কলায় ব্রহ্ম প্রকাশিত হলেন দেবতারূপে! বিবেক এবং বৈরাগ্য লাভ করায় মানুষ দেবতায় উন্নীত হলো।
তারপর দ্বাদশ কলায় ব্রহ্ম সিদ্ধ বা ঋষি রূপে প্রকাশমান হলেন অর্থাৎ বিবেক ও বৈরাগ্যবান মানবের “জ্ঞান” লাভ হওয়ায়_ তিনি সিদ্ধ হলেন! ছোলা সিদ্ধ হলে যেমন আর তা থেকে অংকুর বের হয়না_ তেমনি এই অবস্থায় পৌঁছে জীবকে আর কামনা-বাসনার মোহে পড়ে জন্ম-জন্মান্তরে ক্লিষ্ট হতে হয়না। এতদূর পর্যন্ত ব্রহ্মের প্রকাশ হয় অ্যাসেন্ডিং বা উৎক্রমণের পথে। এরপর ব্রহ্মের ডিসেন্ডিং বা অবতরণ লীলা হয় । প্রেম বা করূনাবশতঃ জীবকল্যানে অবতরণ হয় তাই এঁদেরকে “অবতার” বলা হয়। ব্রহ্ম চতুর্দশ কলায় অবতার রূপে প্রকাশমান হয়। কিন্তু এই অবস্থাতেও তিনি অপূর্ণ, কারণ আনন্দের আস্বাদন তাঁর হয় কিন্তু তিনি অপরকে আস্বাদন করাতে পারেন না! তাই ষোলকলায় ব্রহ্ম পুরুষোত্তম রূপে প্রকাশিত হন। তখন তিনিও পূর্ণ_ ভক্তও পূর্ণ! এই অবস্থায় ভগবান নিজেই নিজেকে যুগপৎ ভেদ ও অভেদরূপে সম্পূর্ণভাবে আস্বাদন করেন। এটাকেই শাস্ত্র “অপ্রাকৃত চিন্ময় রাসলীলা” বলে বর্ণনা করেছেন!
এই ভাবেই ঘটে চলেছে লীলাবিলাস, ব্রহ্মেরই অভিসার-লীলা__জড় থেকে জীবে, আবার জীব থেকে ব্রহ্মে__ নিরন্তর নিরবিচ্ছিন্নভাবে ! এখানে প্রকাশের তারতম্যেই যা পার্থক্য, স্বরূপে তিনি সর্বদাই সচ্চিদানন্দ_সর্বদাই পূর্ণ।।
তাই উপনিষদ বলেছে _”ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমূদচ্চতে, পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণামেবাবশিষ্যতে”!!
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।