একই বস্তু, ব্যক্তি বা বিষয় ___ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতীয়মান হয়। গুরুমহারাজ বলেছিলেন _”পৃথিবীর যতকোটি মানুষ রয়েছে _তাদের তত রকমের মানসিকতা! অনেকসময় দুটো মানুষের চেহারার আশ্চর্য রকমের মিল হয় _কিন্তু মনের গঠন বা মানসিকতার অমিল থাকবেই! সাধারণতঃ পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় ও পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়-এর সাহায্যে মানুষ জাগতিক বিষয়সমূহকে অনুভব বা উপলব্ধি করে। আর সকল ইন্দ্রিয়ের ‘রাজা’ হলো মন। মনই বাকি ইন্দ্রিয়দের নিয়ন্ত্রণ করে!
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, মানসিকতা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার জন্যই মানুষের অনুভব বা উপলব্ধির জগতেরও পরিবর্তন ঘটে থাকে এবং একই বস্তুকে বিভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখে বা পর্যালোচনা করে!! এই ব্যাপারটি বোঝানোর জন্য গুরুমহারাজ নিম্নলিখিত গল্পের অবতারণা করেছিলেন। গল্পটি অনেক পুরোনো এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও কথা প্রসঙ্গে গল্পটি তাঁর ভক্তদের কাছে উপস্থাপনা করেছিলেন।
কোন একস্থানে যাতায়াতের পথে (তখনকার দিনের মাটির রাস্তা)রাস্তার পাশেই রাখাল বালকেরা একদিন মাটি দিয়ে একটা ঢিবি তৈরী করে খেলাধুলা করেছিল। তারপর দিনের শেষে সন্ধ্যা আগতপ্রায় দেখে তারা যে যার ঘরে ফিরে গেছিল _কিন্তু থেকে গেছিল তাদের সেই খেলার ঢিবিটি!
একটু রাত্রি হতেই চারিদিক নিকষ কালো অন্ধকার হয়ে এল_কারন সেদিন ছিল অমাবস্যা তিথি! ঢিবিটি যেখানে ছিল সেই পথ ধরে ফিরছিল এক মাতাল _সে প্রতিদিনই ঐ একই রাস্তা দিয়ে ফেরে, তাই মাতাল হলেও তার রাস্তা মুখস্থ! কিন্তু ঐ ঢিবিটির জায়গায় এসে সে থমকে দাঁড়াল_দেখল একটা মাতাল বেহুঁশ হয়ে বসে রয়েছে। সে মনে মনে খুব খুশি হয়ে বলল “আজ বাড়ি ফিরে আমি আমার বউকে বলব_আমি আর কি এমন ‘মাল’ খাই, দ্যাখ্ গে যা! আমার থেকেও বেশি মাল টেনে একজন পথেই পড়ে রয়েছে _উঠে বাড়ি যেতেই পারে নি! আর আমাকে দ্যাখ্, আমি নিজে হেঁটে হেঁটে বাড়ি এসেছি! _তাহলে আমার বৌ আর আমাকে আজ আর কিছুই বলতে পারবে না!”এই বলে মাতাল বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
এরপর রাত্রি আরও গভীর হোল_মধ্যরাত্রে ঐখানে এল এক চোর! তারও রাস্তাঘাট সব চেনা _অন্ধকারে একটু দূর থেকে ঢিবিটিকে দেখে সে ভাবল-আর একটা চোর আগে থেকেই চুরির মতলবে ঘাপটি মেরে বসে আছে! সে দুর থেকেই মনে মনে বলল _” যা বাবা! আজ আমার সামান্য একটু দেরি হয়েছে _তাতেই তুমি আমার জায়গা দখল করে বসে আছো!! তাহলে আর কিই বা করা যায় _যাই অন্য কোন জায়গায় গিয়ে ধান্দা করি!”__এই বলে সে ঐ স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেল।
রাত্রি তৃতীয় প্রহর!! এক যোগী-সন্ন্যাসী চলেছেন তাঁর নির্দিষ্ট সাধন-স্থলে__নিভৃতে সাধনা করার জন্য। ঢিবিটির কাছে এসে থমকে দাঁড়াল সন্ন্যাসী _বলল-” হে যোগী! তুমি আমার থেকেও আগে নিদ্রাভঙ্গ করে ধ্যানে বসে গেছো!! আমি কত সময় নষ্ট করে ফেললাম __তোমাকে দেখে আমার শিক্ষা হওয়া দরকার! তাড়াতাড়ি যাই _জীবন সংক্ষিপ্ত, তাকে কাজে লাগানোটাই যোগীর একমাত্র লক্ষ্য !” _এই বলতে বলতে যোগীবর সেই স্থান ত্যাগ করে – তাঁর নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে হাঁটা লাগালেন।
এতদূর পর্যন্ত গল্পটা বলার পর গুরুমহারাজ থামলেন, তারপর বললেন _” জানো–এই জগৎ-সংসার মহামায়ার মায়ায় আচ্ছন্ন! সমগ্র সংসারই মায়াচ্ছন্ন। তাই মানুষ যা দেখে _তা ঠিক দেখে না, যা বোঝে তা ঠিক বোঝে না, ভাবনার জগতেও নানা ভূল! মায়া বা মোহে আচ্ছন্ন অবস্থায় থেকে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা কি করে সম্ভব?
বিশেষত সত্য তো শাশ্বত, সনাতন _সেই সত্যে উপনীত হতে গেলে বা সত্যের বোধ প্রাপ্ত হতে গেলে মোহ এবং মায়ামুক্ত হয়েই তা লাভ করতে হবে। মায়ার মধ্যে থেকে মায়াধীশের লীলা বোঝা কি অত সহজ? মহামায়াকে প্রসন্ন করতেই হবে _আর মহামায়ার মায়া অতিক্রম করার এটাই একমাত্র পথ বা রাস্তা!
তবে মায়াধীশ(ভগবান) যখন শরীর নেন তখন মহামায়া অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন _অবাক হয়ে মায়াধীশের লীলা দেখেন। কিন্তু তিনি ছাড়া বাকি জগৎসংসার মহামায়ার মায়ায় মুগ্ধ!
তাই সাধন ভজনের দ্বারা ধীরে ধীরে মহামায়ার মায়া কাটাতে হয় বা অন্তত চেষ্টা করতে হয়। নাহলে ঐরকমই হবে _যা সত্যি নয় তাকেই সত্যি বলে মনে হবে এবং যেটা প্রকৃত সত্য _সেটার খোঁজই মিলবে না, অধরাই থেকে যাবে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন যে _বনবাসে থাকাকালীন রাস্তায় চলাফেরার সময় লক্ষন সবসময় রামের পানে চেয়ে থাকতে চাইতেন কিন্তু তা করতে পারতেন না _কারণ মধ্যিখানে ছিলেন সীতা!! এখানে সীতাই মহামায়া!!(ক্রমশঃ)