(এই গল্পের প্রথমাংশে রাজার ঘোষনা মতো বিভিন্ন রাজকুমার বা অন্যান্য যুবকেরা রাজ্য এবং রাজকন্যার লোভে অনেকেই রাজসভায় এসেছিল কিন্তু সকলেই অদ্ভুত শর্ত পালনে ব্যর্থ হয়ে কারাগারে বন্দি হল। এবার মন্ত্রীমশাই এক ব্রাহ্মণকুমারকে যোগাড় করল। তারপর কি হলো……!!)
……. যথারীতি নির্দিষ্ট দিনে ঐ ব্রাহ্মণকুমার ছাগলগুলি নিয়ে রাজসভায় গিয়ে হাজির হোল। সকলে উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছে কি হয় – কি হয়! রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে ব্রাহ্মণকুমারের কাছে দাঁড়ালেন, সামান্য কুশল বিনিময়ের পর আসল পরীক্ষার কথায় এলেন। রাজা জানতে চাইলেন যে ছাগলগুলি খাদ্যের ব্যাপারে নির্লিপ্ত হয়েছে কি না? তরুন ব্রাহ্মণ দীপ্তকন্ঠে উত্তর দিল _”নিশ্চয়ই! আমি ওদেরকে খাবার খাইয়ে সন্তুষ্ট করেছি এবং তার সাথে সাথে সংযম শিক্ষাও দিয়েছি। হে রাজন! আপনি নিজে আমার কথার সত্যতা যাচাই করে নিন।”
রাজা কিছু কচি কাঁঠালপাতা, কচি কুলপাতা(এই সব খাদ্যেই ছাগলের লোভ বেশি) ছাগলগুলির মুখের সামনে ধরলেন __ কিন্তু কি আশ্চর্য!! ছাগলগুলি পাতাগুলির দিকে একবার তাকিয়েই মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল! রাজা অবাক _মহামন্ত্রী অবাক _সভাস্থ সকলে অবাক!
ছাগলের কাঁঠালপাতায় অনীহা!! রাজার আদেশে অন্য গাছ থেকে আরো কিছু কিছু পাতাও নিয়ে আসা হোল_কিন্ত ঐ ছাগলগুলি খাবার ব্যাপারে সত্যিই সংযমের পরিচয় রাখল, কোন খাবারের প্রতি কোন আগ্রহই দেখাল না! ছেলেটি পরীক্ষায় পাশ! রাজা ঘোষনা করলেন যে _”এই ছেলে ই উপযুক্ত! এই ব্রাহ্মণকুমারের সাথেই আমি আমার কন্যার বিবাহ দেব এবং এর হাতে রাজ্যের ভার তুলে দিয়ে আমি বাণপ্রস্থ অবলম্বন করব।”এই কথাগুলো বলে এবং সাতদিন ব্যাপী রাজ্যময় উৎসবের ঘোষনা করে রাজামশাই অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ালেন।
রাজ্যময় তুমুল হৈচৈ পড়ে গেল! প্রজারা সকলে আনন্দ করতে লাগল! কিন্তু মহামন্ত্রীর মনে একটা খটকা লেগেই থাকল_ছাগলগুলোকে ঐ ব্রাহ্মণকুমার এমন কি খাইয়েছে _যা খেয়ে ছাগলের পেট এমন ভরেছে যে তারা কেউ একটা পাতা অবধি ছুঁল না!!
মহামন্ত্রীর উপরেই রাজার হবু জামাই এবং রাজ্যের ভাবী রাজার দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।ফলে out house-এ হবু জামাইয়ের ভালোভাবে থাকার ব্যবস্থা করার পর , সুযোগ বুঝে মহামন্ত্রী যুবক ব্রাহ্মণের কাছে ‘এর রহস্যটা কি’ – তা জানতে চাইলেন। কুমার বলল – “আমার এই ছয়টি ছাগল আর চট্ করে কোনদিনই ওদের প্রচলিত খাবার(ঘাস/পাতা) খাবে না। ওদের কে গাছের ‘পাতা’-র বদলে অন্য সহজপাচ্য তরল খাবার খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।”মন্ত্রী আবার জিজ্ঞাসা করল – ” হ্যাঁ, কিন্তু ওরা কাঁঠাল পাতা বা অন্যান্য প্রচলিত পাতা জাতীয় খাবার খেতে চাইছেই বা না কেন?”
ব্রাহ্মণকুমার উত্তর দিল – “শর্তের কথা শোনার পরই আমায় কি করতে হবে _সে সম্বন্ধে আমি একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। ফলে আপনি যখন আমাকে ছয়টি ছাগল দিয়ে এলেন, তখন থেকেই আমি কচি কাঁঠালপাতা/কুলপাতা ওদের সামনে রাখতাম, আর যেই খাবার জন্য জিভ বের করত_অমনি লম্বা ছুঁচ দিয়ে ওদের জিভ এফোঁড়-ওফোঁড় করে কয়েকটা ফুটো করে দিতাম। এইভাবে এই কদিনে বারবার ঐ একই কাজ করার ফলে ওদের পাতা খাওয়ার প্রতি একটা ভীতি তৈরি হয়েছে! আর ওদের জিভে অসংখ্যবার ছুঁচ ফোটানোর ফলে ওদের জিভগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেছে। ফলে পাতা বা যে কোনো জিনিস আর ওদের কাছে লোভনীয় বস্তু বলেই বিবেচিত হয় না _আর এইজন্যই খাবার প্রবৃত্তিও থাকে না। এখন আমি যে খাবার ওদেরকে খেতে দিই ওরা সেই খাবার খেয়েই বেঁচে থাকে।”
গুরুমহারাজ গল্পটি বলার পর এর তাৎপর্য বলতে শুরু করলেন_”এখানে রূপকাকারে রাজামশাই হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি, রাজকুমারী হচ্ছে ব্রহ্মবিদ্যা আর রাজ্য হোল ভূমা বা শাশ্বত আনন্দময় স্থিতি। ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রহ্মবিদ্যা দান করতে ইচ্ছুক কিন্তু দেবেন কাকে? উপযুক্ত পাত্র ছাড়া তো এইবিদ্যা দান করা যায় না, আর অপাত্রে দিলেও উপযুক্ততার অভাবে সে এটা নষ্টও করে ফেলবে।
বাউলগানে আছে _ “কাঁচা হাঁড়িতে গো হাঁড়িতে রাখিতে নারিলি প্রেমজল “_ সুতরাং ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি উপযুক্ত আধার না দেখে কখনোই কারো কাছে সাধন তত্ত্ব, আধ্যাত্মিক রহস্যের কথা উন্মোচন করেন না।
এবার জিজ্ঞাসা এসে যাচ্ছে _তাহলে কোন ব্যক্তি উপযুক্ত, কি তার লক্ষন?? __যিনি (এখানে ব্রাহ্মণকুমার) ছয় রিপু-(গল্পে ছয়টি ছাগল)কে স্ববশে আনতে পেরেছেন। ষড়রিপুরা তো তাদের মতো করে চলার চেষ্টা করবেই। কিন্তু প্রকৃত সাধক, প্রকৃত যোগী তাদেরকে (ইন্দ্রিয়াদি, রিপুগন) স্ববশে নিয়ে আসেন। এটাই যথার্থ ‘রসেবশে’ থাকা। ‘রস:_যখন সাধকের ‘বশে’ আসে তখনই তো সে ব্রহ্মবিদ্যা বা আত্মতত্ত্ব লাভের যথার্থ অধিকারী হয়! অন্যথায় উপযুক্ত হবার চেষ্টা করে যেতে হয়! সাধনা কখনো ব্যর্থ হয় না _সাধনার ফল ফলবেই, আজ অথবা কাল !!” [ক্রমশঃ]