কোন এক দেশে একজন সদগুরু, মহাত্মা-মহাপুরুষ বসবাস করতেন। ফুল ফুটলে যেমন ভ্রমরের অভাব হয় না __তেমনি ওনার কাছে মানুষজনের আনাগোনার অন্ত ছিল না। অনেকেই ওনার কাছে দীক্ষাও নিয়েছিল। গুরুদেব সদা সর্বদা উপস্থিত ভক্তজনেদের আত্মতত্ত্বের শিক্ষা দিতেন। অন্য কোন প্রসঙ্গ বা আজেবাজে কথা তিনি বলতে ভালোবাসতেন না। কিন্তু আত্নতত্বের ভারী ভারী কথা অনেকেই তাঁর কথা ভালো বুঝতে পারত না, আবার অনেকে বুঝতে চাইতোও না।
গুরু কিন্তু তাঁর নির্দিষ্ট কাজ ঠিকই করে যাচ্ছিলেন| এইভাবে দিন চলে যাচ্ছিল _একদিন গুরুদেব খবর পেলেন যে তাঁর এক প্রিয় শিষ্যের স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে এবং ঐ শিষ্য তার পরমাসুন্দরী স্ত্রীর বিরহে নাওয়া-খাওয়া পরিত্যাগ করে শুধু পড়ে পড়ে কাঁদছে!
শিষ্যের এমন করুন অবস্থার কথা শুনে গুরুদেব স্বয়ং একদিন সেই শিষ্যের বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন। গুরুদেব সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন সুদৃশ দেখতে একটা মাটির হাঁড়ি, যার চারিদিকে সুন্দর নক্সাকাটা!
বাড়িতে স্বয়ং গুরুদেব এসেছে _এই খবর শোনামাত্র শিষ্য শোকাবস্থা থেকে কোনক্রমে উঠে এসে গুরুদেবের পা দুটো ধরে তার দুরবস্থার কথা জানাতে জানাতেই কেঁদে আকুল হয়ে গেল! গুরুদেবও খুবই শোক প্রকাশ করলেন _শিষ্যকে সান্তনাও দিলেন। তারপর শিষ্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন _”তোমার জন্য আমি এমন একটা সামগ্রী এনেছি, যেটি ঘরে রেখে দিলে _দেখবে তোমার শোকের উপশম হবে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে গৃহেরও কল্যাণ হবে। এই বস্তুটি আমার খুবই প্রিয় ও সৌখীন ছিল, আজ তোমাকে দিলাম _দেখো, তুমি যেন এর অমর্যাদা কোরনা!”_এই বলে গুরুদেব তার শিষ্যকে এমনভাবে হাত বাড়িয়ে মাটির হাঁড়িটি দিতে গেলেন, যাতে শিষ্য হাঁড়িটি ভালোভাবে ধরার আগেই সেটি মাটিতে পড়ে যায়। হ’লও তাই! শিষ্যের হাত থেকে হাঁড়িটা পড়ে যেতেই ভেঙে একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। মাটির জিনিস মেঝেতে আছড়ে পড়লে তো ভেঙে যাবেই!
কিন্তু যেই না মাটির হাঁড়িটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল __অমনি গুরুদেব মাটিতে আছড়ে পড়ে ঐ টুকরোগুলিকে ধরে ভয়ঙ্কর কান্না শুরু করে দিলেন ! গুরুদেব চিৎকার করে কাঁদছেন আর ছটফট করছেন। শিষ্য বুঝতে পারছে না গুরুদেবের এমন কি হোল যে শুধু মাত্র একটা সামান্য হাঁড়ির জন্য ঐরকম একজন পরমযোগী, মহাজ্ঞানী মানুষ এইভাবে কাঁদছেন!!
গুরুদেবের সাথে যারা এসেছিল তারাও এসব দেখে অবাক! তারাও কখনো তাদের গুরুদেবকে এইরুপ আচরন করতে দেখেনি!
যাইহোক, গুরুদেব যার বাড়ি গিয়েছিলেন (অর্থাৎ যে ব্যক্তি বউ মরার শোকে কাতর), সেই ভদ্রলোক তার গুরুদেবের এইরকম শিশুর ন্যায় আচরণ দেখে __নিজের শোক ভুলে গুরুদেবকে নিয়ে পড়ল! হাউমাউ করে গুরুদেব শুয়ে শুয়ে কাঁদছে দেখে ঐ শিষ্য গুরুদেবের মাথাটা কোলের উপর বসিয়ে সান্তনা দিতে থাকল, মাথায় – বুকে হাত বোলাতে লাগল! বারবার জিজ্ঞাসা করতে শুরু করল _”গুরুদেব! কি এমন হয়েছে যে আপনি এত শোক করছেন?”
গুরুদেব কাঁদতে কাঁদতে বললা_” আমার মাটির হাঁড়িটা ভেঙে গেল! আমার অমন সুন্দর নকশা করা মাটির হাঁড়িটা ছিল গো!”_এই বলে আবার কান্না!! ঐ শিষ্যটি সান্তনা দিতে দিতে গুরুদেবের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল_” ওটা তো তুচ্ছ একটা মাটির হাঁড়ি বই আর কিছু নয়! না হয় একটু নক্সা কাটা ছিল _এই যা! কিন্তু গুরুদেব! আপনি মহাজ্ঞানী, আপনাকে আর আমি বেশি কি বলব_তবু বলছি, ঐ মাটির পাত্রটি তো ভঙ্গুর _ওটা তো চিরস্থায়ী নয়! তাছাড়া হাটে বাজারে খুঁজলে তো এর বিকল্পও পাওয়া যায়! তাহলে এরজন্য আপনি এত উতলা হচ্ছেন বা শোক করছেন?”
শিষ্যের মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার পর গুরুদেব ‘ঝরে-মেরে’ উঠে পড়লেন, তারপর শিষ্যের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বৎস! এই কথা কটাই আমি তোমাকে বলতে এসেছিলাম। এখন তুমিই যখন বলে দিলে _তাহলে তো আর আমার কিছুই বলার থাকল না!”
.গুরুদেবের কথা শুনে সবাই ওনার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে দেখে গুরুদেব পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলতে শুরু করলেন _”দ্যাখো বাবারা! এই জগৎসংসারে সবকিছুই অনিত্য! সুতরাং এখানকার যা কিছু তা ভঙ্গুর, পরিবর্তনশীল বা মরনশীল! আর সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার তো কোন অবকাশই নাই! মাটির হাঁড়ির মতো মানুষের শরীরও পাঞ্চভৌতিক উপাদানে তৈরি। মৃত্যুর পর তাই শরীর আবার সেই পঞ্চভূতে লীন হয়ে যায়। বাউল গানে রয়েছে _”মাটির দেহ মাটি হবে _পুড়ে হবে ছাই!” তাই বাবারা! স্থুলশরীরের সৌন্দর্য, সুন্দর স্বামী, সুন্দরী স্ত্রী _এসব কদিনের? কালের নিয়মে সবই পরিবর্তিত হয়ে যায় আর মৃত্যুর পরে এই মাটির দেহ মাটি হয়ে যায়!
এই জ্ঞান যার হয়ে গেছে সে জানে যে – স্থুল দেহ বা যে কোন অনিত্য বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে _যা নিত্য, যা শাশ্বত তার প্রতি আকর্ষণ বাড়ানোই আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে চলা বা ‘চরৈবেতি’!
স্থুল শরীরের কর্তা আত্মা! মনুষ্যজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য সেই আত্মতত্ত্বের বোধ করা। আত্মতত্ত্বের বোধ হলেই ব্রহ্মতত্ত্বের বোধ হয়।”
এতদূর পর্যন্ত বলার পর গুরুমহারাজ গল্পটি শেষ করে বললেন _”মানুষের স্থুলশরীর যেন মাটির হাঁড়ি! সুন্দর নক্সা কাটা অবস্থা যেন শরীরের সৌন্দর্য! মানুষের মৃত্যুতে যেমন স্থুলশরীরের অবসান ঘটে এবং শরীরের উপাদানগুলি পঞ্চভূতে মিশে যায়_ তেমন ই মাটির হাঁড়ি ভেঙে টুকরো টুকরো হলে, টুকরো গুলোও কিছুকালের মধ্যেই মাটিতে মেশে। পুনরায় মাটি থেকেই যেমন নতুন হাঁড়ি তৈরি হয় _তেমনি নতুন শরীর যখন তৈরি হয় তখন এই পাঞ্চভৌতিক উপাদান থেকেই তৈরি হয়। শরীর পরিবর্তনশীল হলেও আত্মা অবিনশ্বর! আত্মা শরীরে প্রকাশমান –তাই শরীর সুন্দর, শরীর ক্রিয়াশীল! আত্মা যে শরীরে প্রকাশমান নয় _সেই শরীরই মৃত। তাই শাশ্ত্রে আত্মাকে শরীরের ‘স্বামী’ বলা হয়েছে। সুতরাং তোমরা শরীরের পূজারী হয়োনা _শরীরের স্বামী .’আত্মাকে’ বোধে বোধ করার চেষ্টা করো।” [ক্রমশঃ]
গুরু কিন্তু তাঁর নির্দিষ্ট কাজ ঠিকই করে যাচ্ছিলেন| এইভাবে দিন চলে যাচ্ছিল _একদিন গুরুদেব খবর পেলেন যে তাঁর এক প্রিয় শিষ্যের স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে এবং ঐ শিষ্য তার পরমাসুন্দরী স্ত্রীর বিরহে নাওয়া-খাওয়া পরিত্যাগ করে শুধু পড়ে পড়ে কাঁদছে!
শিষ্যের এমন করুন অবস্থার কথা শুনে গুরুদেব স্বয়ং একদিন সেই শিষ্যের বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন। গুরুদেব সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন সুদৃশ দেখতে একটা মাটির হাঁড়ি, যার চারিদিকে সুন্দর নক্সাকাটা!
বাড়িতে স্বয়ং গুরুদেব এসেছে _এই খবর শোনামাত্র শিষ্য শোকাবস্থা থেকে কোনক্রমে উঠে এসে গুরুদেবের পা দুটো ধরে তার দুরবস্থার কথা জানাতে জানাতেই কেঁদে আকুল হয়ে গেল! গুরুদেবও খুবই শোক প্রকাশ করলেন _শিষ্যকে সান্তনাও দিলেন। তারপর শিষ্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন _”তোমার জন্য আমি এমন একটা সামগ্রী এনেছি, যেটি ঘরে রেখে দিলে _দেখবে তোমার শোকের উপশম হবে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে গৃহেরও কল্যাণ হবে। এই বস্তুটি আমার খুবই প্রিয় ও সৌখীন ছিল, আজ তোমাকে দিলাম _দেখো, তুমি যেন এর অমর্যাদা কোরনা!”_এই বলে গুরুদেব তার শিষ্যকে এমনভাবে হাত বাড়িয়ে মাটির হাঁড়িটি দিতে গেলেন, যাতে শিষ্য হাঁড়িটি ভালোভাবে ধরার আগেই সেটি মাটিতে পড়ে যায়। হ’লও তাই! শিষ্যের হাত থেকে হাঁড়িটা পড়ে যেতেই ভেঙে একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। মাটির জিনিস মেঝেতে আছড়ে পড়লে তো ভেঙে যাবেই!
কিন্তু যেই না মাটির হাঁড়িটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল __অমনি গুরুদেব মাটিতে আছড়ে পড়ে ঐ টুকরোগুলিকে ধরে ভয়ঙ্কর কান্না শুরু করে দিলেন ! গুরুদেব চিৎকার করে কাঁদছেন আর ছটফট করছেন। শিষ্য বুঝতে পারছে না গুরুদেবের এমন কি হোল যে শুধু মাত্র একটা সামান্য হাঁড়ির জন্য ঐরকম একজন পরমযোগী, মহাজ্ঞানী মানুষ এইভাবে কাঁদছেন!!
গুরুদেবের সাথে যারা এসেছিল তারাও এসব দেখে অবাক! তারাও কখনো তাদের গুরুদেবকে এইরুপ আচরন করতে দেখেনি!
যাইহোক, গুরুদেব যার বাড়ি গিয়েছিলেন (অর্থাৎ যে ব্যক্তি বউ মরার শোকে কাতর), সেই ভদ্রলোক তার গুরুদেবের এইরকম শিশুর ন্যায় আচরণ দেখে __নিজের শোক ভুলে গুরুদেবকে নিয়ে পড়ল! হাউমাউ করে গুরুদেব শুয়ে শুয়ে কাঁদছে দেখে ঐ শিষ্য গুরুদেবের মাথাটা কোলের উপর বসিয়ে সান্তনা দিতে থাকল, মাথায় – বুকে হাত বোলাতে লাগল! বারবার জিজ্ঞাসা করতে শুরু করল _”গুরুদেব! কি এমন হয়েছে যে আপনি এত শোক করছেন?”
গুরুদেব কাঁদতে কাঁদতে বললা_” আমার মাটির হাঁড়িটা ভেঙে গেল! আমার অমন সুন্দর নকশা করা মাটির হাঁড়িটা ছিল গো!”_এই বলে আবার কান্না!! ঐ শিষ্যটি সান্তনা দিতে দিতে গুরুদেবের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল_” ওটা তো তুচ্ছ একটা মাটির হাঁড়ি বই আর কিছু নয়! না হয় একটু নক্সা কাটা ছিল _এই যা! কিন্তু গুরুদেব! আপনি মহাজ্ঞানী, আপনাকে আর আমি বেশি কি বলব_তবু বলছি, ঐ মাটির পাত্রটি তো ভঙ্গুর _ওটা তো চিরস্থায়ী নয়! তাছাড়া হাটে বাজারে খুঁজলে তো এর বিকল্পও পাওয়া যায়! তাহলে এরজন্য আপনি এত উতলা হচ্ছেন বা শোক করছেন?”
শিষ্যের মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার পর গুরুদেব ‘ঝরে-মেরে’ উঠে পড়লেন, তারপর শিষ্যের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বৎস! এই কথা কটাই আমি তোমাকে বলতে এসেছিলাম। এখন তুমিই যখন বলে দিলে _তাহলে তো আর আমার কিছুই বলার থাকল না!”
.গুরুদেবের কথা শুনে সবাই ওনার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে দেখে গুরুদেব পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলতে শুরু করলেন _”দ্যাখো বাবারা! এই জগৎসংসারে সবকিছুই অনিত্য! সুতরাং এখানকার যা কিছু তা ভঙ্গুর, পরিবর্তনশীল বা মরনশীল! আর সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার তো কোন অবকাশই নাই! মাটির হাঁড়ির মতো মানুষের শরীরও পাঞ্চভৌতিক উপাদানে তৈরি। মৃত্যুর পর তাই শরীর আবার সেই পঞ্চভূতে লীন হয়ে যায়। বাউল গানে রয়েছে _”মাটির দেহ মাটি হবে _পুড়ে হবে ছাই!” তাই বাবারা! স্থুলশরীরের সৌন্দর্য, সুন্দর স্বামী, সুন্দরী স্ত্রী _এসব কদিনের? কালের নিয়মে সবই পরিবর্তিত হয়ে যায় আর মৃত্যুর পরে এই মাটির দেহ মাটি হয়ে যায়!
এই জ্ঞান যার হয়ে গেছে সে জানে যে – স্থুল দেহ বা যে কোন অনিত্য বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে _যা নিত্য, যা শাশ্বত তার প্রতি আকর্ষণ বাড়ানোই আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে চলা বা ‘চরৈবেতি’!
স্থুল শরীরের কর্তা আত্মা! মনুষ্যজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য সেই আত্মতত্ত্বের বোধ করা। আত্মতত্ত্বের বোধ হলেই ব্রহ্মতত্ত্বের বোধ হয়।”
এতদূর পর্যন্ত বলার পর গুরুমহারাজ গল্পটি শেষ করে বললেন _”মানুষের স্থুলশরীর যেন মাটির হাঁড়ি! সুন্দর নক্সা কাটা অবস্থা যেন শরীরের সৌন্দর্য! মানুষের মৃত্যুতে যেমন স্থুলশরীরের অবসান ঘটে এবং শরীরের উপাদানগুলি পঞ্চভূতে মিশে যায়_ তেমন ই মাটির হাঁড়ি ভেঙে টুকরো টুকরো হলে, টুকরো গুলোও কিছুকালের মধ্যেই মাটিতে মেশে। পুনরায় মাটি থেকেই যেমন নতুন হাঁড়ি তৈরি হয় _তেমনি নতুন শরীর যখন তৈরি হয় তখন এই পাঞ্চভৌতিক উপাদান থেকেই তৈরি হয়। শরীর পরিবর্তনশীল হলেও আত্মা অবিনশ্বর! আত্মা শরীরে প্রকাশমান –তাই শরীর সুন্দর, শরীর ক্রিয়াশীল! আত্মা যে শরীরে প্রকাশমান নয় _সেই শরীরই মৃত। তাই শাশ্ত্রে আত্মাকে শরীরের ‘স্বামী’ বলা হয়েছে। সুতরাং তোমরা শরীরের পূজারী হয়োনা _শরীরের স্বামী .’আত্মাকে’ বোধে বোধ করার চেষ্টা করো।” [ক্রমশঃ]