২-নং ঘটনা।(কাটোয়া লোকালে।)
================================
একবার গুরুমহারাজ কাটোয়া লোকালে চেপে ধাত্রীগ্রাম থেকে আজিমগঞ্জ আশ্রমে যাচ্ছিলেন। সাধারণত শীতকালের দিকে গুরুমহারাজ আজিমগন্জ আশ্রমে যেতেন এবং ওখানে কমবেশি একমাস কাটাতেন। তবে আশ্রম তৈরির প্রথম দিকে ভক্তসংখ্যা কম ছিল, আর সেই সময় উনি একা একাই এখানে ওখানে চলে যেতেন। সেবারও উনি ট্রেনে(কাটোয়া লোকাল) চেপে একাই আজিমগন্জ যাচ্ছিলেন। সম্ভবত উনি ধাত্রীগ্রাম ষ্টেশনে চেপেছিলেন_কয়েকটা ষ্টেশন পরেই নবদ্বীপধাম। এটি চৈতন্য মহাপ্রভূর জন্মস্থান _ফলে ওখানে প্রচুর আশ্রম, মঠ, মিশন গড়ে উঠেছে। আর সব আশ্রমেই সাধু-সন্তরা থাকে। বিশেষতঃ ইস্কন মন্দিরের দেশী-বিদেশী সাধুর সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। তাছাড়াও ঐ সমস্ত অঞ্চলে পূর্ববাংলার লোকের অধিক বসতি_ওদের মধ্যেও একটু বয়স বাড়লেই গেরুয়া কাপড় পড়ে নেওয়ার একটা tendency রয়েছে ।হয়তো ভিক্ষা করছে _তাও গেরূয়া কাপড় পড়ে! এরা সবাই ট্রেনেই যাতায়াত করে _বিশেষ করে হোলি, রাস ইত্যাদি উৎসবের সময় তো ট্রেনগুলিতে ওঠা দায় – হয়ে যায়। এইসব বিভিন্ন কারণে ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের (ডেইলি প্যাসেঞ্জার) গেরূয়া কাপড় পড়ে থাকা লোকেদের খুব একটা ভালো চোখে দেখে না(নিশ্চয়ই সবাই নয়)। ট্রেনের কামরায় কোন গেরূয়া কাপড় পড়া লোক উঠলেই ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের অনেকেই একটু আধটু টিকাটিপ্পনি কাটে!
এরপরের ঘটনা গুরু মহারাজের মুখেই শোনা যাক্_ “সেদিন আমার সাথে যে ঘটনাটি ঘটলো _সেটা কিন্তু ছিল একটু অন্যরকম! আমি যে কম্পার্টমেন্টে বসে ছিলাম সেখানে অনেক নিত্যযাত্রীরাও ছিল। দু-একটা হালকা টিপ্পনি শুনতেও পাচ্ছিলাম। এখানকার মেয়েরা যেমন একটু বড় হবার পরই বুঝতে পারে যে, সে রাস্তায় বের হলে তাকে নানান অস্বস্তির শিকার হতেই হবে _তেমনি সাধুসন্তরাও এটা জানেন যে রাস্তায় বেরোলে তাদেরকে একটু আধটু টিকাটিপ্পনি শুনতেই হবে! এসব জানে বলেই তাঁরা সবকথায় কান দেন না।
যাই হোক, ঐদিন ঘটনাটা যেমন ঘটল সেটা বলছি শোন__কয়েকজন নিত্যযাত্রী আমার সামনেই বসে তাস খেলতে খেলতে যাচ্ছিল। তারা মাঝে মাঝেই। হৈচৈ _চিৎকার – চ্যাঁচামেচি করে কামরার বাকি সবার বিরক্তি উৎপাদন করছিল।
কিন্তু একজন নিত্যযাত্রী আমার ঠিক পাশেই বসে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ে যাচ্ছিল। আমার ব্যাপারে ওর নির্লিপ্ততা দেখে আমি একটু নিশ্চিন্ত ছিলাম _যাক পাশের লোকটির হাত থেকে তো রেহাই পাচ্ছি! কিন্তু আমাকে ভূল প্রমাণ করে ভদ্রলোক জানান দিলেন যে তিনিও আর পাঁচজনের ই দলে। ঘটনাটা হোল _ওই ভদ্রলোক যে বইটা পড়েছিলেন _সেটা হলো “সহজতা ও প্রেম” _লেখক_স্বামী পরমানন্দ । এটা আমি অনেক আগেই দেখে নিয়েছিলাম। আমাদের চরৈবেতি কার্যালয় থেকে তার কিছুদিন আগেই ‘সহজতা ও প্রেম’ এবং :বাউলের মর্মকথা’_এই বইদুটি published হয়েছিল ।ধাত্রীগ্রাম ষ্টেশন থেকে দু-চারটে ষ্টেশন পেরোতে না পেরোতেই ভদ্রলোকের ঐ বইটি পড়া শেষ হয়ে গেল।
বই পড়া শেষ হতেই ভদ্রলোকের চোখ পড়ল আমার দিকে! তারপরেই সরাসরি আমাকে বলে বসল_’এই যে মশাই! সাধু তো হয়েছেন _তা এই সমস্ত বই পড়েছেন? দেখুন – দেখুন, এই বইটির লেখক স্বামী পরমানন্দ! তিনি ও তো একজন আপনারই মতো সাধু, যিনি এতসব জ্ঞানের কথা লিখেছেন _আর আপনারা কি করছেন? শুধু গেরূয়া বসন পড়ে ঘুরে বেড়ালেই হবে? এই নিন এই বইটা পড়ুন_দেখবেন অনেক জ্ঞানলাভ করতে পারবেন!’__এই সব কথা বলে ভদ্রলোক বইটি আমার হাতে ধরিয়ে দিল! আমার অবস্থাটা ভাবো একবার! ঐ ভদ্রলোকের অনুরোধে আমারই নিজের লেখা বই_হাতে নিতেই হোল, কিন্তু কতক্ষণই বা চোখ বোলাই! বই এর পাতাগুলি একটু উল্টে পাল্টে আবার ওনার হাতে বইটা ফেরত দিয়ে দিলাম! বললাম_’বাঃ! বেশ ভালো বই!’
এইবার শুরু হয়ে গেল ভদ্রলোকের বাক্যবান! বলতে লাগলো _’ওই তো মশাই আপনাদের দোষ! একটা ভালো বই দিলাম, সেটা খানিকক্ষণ পড়ার ধৈর্যও নাই! একটু নাড়াচাড়া করেই ফেরত দিয়ে দিলেন! আপনাদের মতো লোকেদের জন্যই সাধুদের আজ এত দুর্নাম হচ্ছে!’
আমি আর কি করি! চুপ করে বসে আছি _সেই সময় ট্রেনটি কাটোয়া ষ্টেশনে ঢুকে পড়লো। ট্রেনের কামরার কিছু লোক নামতেই হুড়মুড় করে আরো বেশি লোক উঠে পড়লো। এদের মধ্যে একজন ছিল আমাদের আজিমগন্জ আশ্রমের ভক্ত ‘মানিক ব্রহ্ম’। মানিক ওখানেই রেল এ চাকরি করে। কার্যোপলক্ষে কাটোয়া এসেছিল _এখন আজিমগন্জ ফিরে যাচ্ছে। আর উঠবি তো ওঠ্ ঐ কামরাতেই!!
যাইহোক, এবার যে অঘটনটা ঘটার নয় _সেটাই ঘটলো! মানিক ব্রহ্ম কামরায় উঠে প্রাথমিক অস্থিরতা কাটিয়ে একটু সুস্থ হয়ে দাঁড়াতেই ওর চোখ পড়ে গেল আমার দিকে! আচমকা আমাকে দেখে প্রথমে ও হতবাক হয়ে গেল _আর হবে নাই বা কেন! কারন সেবার আজিমগন্জ যাবার কথা কাউকে বলাই হয় নি। ফলে হটাৎ করে আমাকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না _ভিড় ঠেলে একেবারে হুমড়ি খেয়ে আমার পায়ে এসে মাথা ঠুকে নিল। আর ঐভাবে বসে বসেই _”গুরুদেব আপনি!! আজিমগন্জ যাচ্ছেন!! দারুণ ব্যাপার! চলুন তাহলে একসাথে আশ্রমে পৌঁছে সকলকে অবাক করে দেব! “_ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কথা বলতে লাগলো। ওর এই ধরনের পাগলের মতো ব্যবহারে রেল-কামরার অন্য লোকেদের সবার দৃষ্টি পড়ে গেল আমাদের দুজনের উপর! মোটামুটি একটু নির্ঝঞ্ঝাটে বসে ছিলাম _সেই সুখটা যে গেল, সেটা ভালোই বুঝতে পারছিলাম। মানিককে হালকা চিমটি কেটে বলার চেষ্টা করলাম _’পা ছাড় মানিক! সিনক্রিয়েট করিস না! এটা ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট!’
কিন্তু মানিক পা ছাড়বে কেন! ঐ অবস্থাতেই মানিকের নজর পড়ল পাশের ভদ্রলোকের হাতে থাকা ‘সহজতা ও প্রেম’-বইটির দিকে! মানিক আমার পা ছেড়ে ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল _’ বাঃ! বাঃ! আপনি এই বইটা পড়ছেন? পড়ুন_খুব ভালো বই_আধ্যাত্নিক বই! আমাদের আশ্রমের চরৈবেতি কার্যালয় থেকে ছাপা! বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । এই যে ইনি_ঐ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা _স্বামী পরমানন্দ! এই যে বইটি পড়ছেন _সেটা এনারই লেখা!!’
এবার ভাবো _পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক টির কি করুন অবস্থা! কাঁচুমাচু মুখে আমতা আমতা করে শুধু বলল ‘ওঃ, আচ্ছা – আচ্ছা’!
মানিক তো আগেকার ঘটনা কিছু জানে না _ও বলেই যাচ্ছিল _’ বুঝলেন মশাই! এই বই হিমালয়ে বসে লেখা! পড়লে তো উপকার হবেই _গৃহে রাখলেও গৃহের কল্যাণ!’। লোকটি অসহায়ের মতো হ্যাঁ – হুঁ করে যাচ্ছিল! তাছাড়া আর কি ই বা করতে পারে!
এসব চলতে চলতেই ট্রেনটি পরের ষ্টেশনে পৌঁছে গেল। ট্রেন থামতেই ঐ ভদ্রলোক একলাফে ট্রেন থেকে নেমে হয়তো পরের কামরায় গিয়ে উঠেছিল। তবে সে যাই করুক _ও নেমে গিয়ে নিজেও বাঁচলো আমাকেও অস্বস্তিবোধ থেকে বাঁচালো!
সুতরাং সাধু-সন্তদেরও রাস্তাঘাটে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। আর গুরুদেব হলে তো কথাই নেই _তখন আসবে নানারকম ভালোবাসার অত্যাচার!!” (ক্রমশঃ)