গুরুমহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) বনগ্রাম আশ্রমে থাকলে সকাল ৮টা_৮.৩০টার মধ্যে সিটিং এ বসে পড়তেন এবং বিশেষ কোন কারন না থাকলে দুপুর ১২-টার আগেই (১১টা থেকে ১১.৩০ এর মধ্যে)উঠে পড়তেন, বলতেন _”যাও! তোমরা সবাই খাওয়া দাওয়া করে নাও গে যাও।” সিটিং এ তাঁর আলোচনায় ইতিহাস, ভূগোল , প্রকৃতি বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা হলেও বেশিরভাগ সময়েই তাঁর আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে থাকত আত্মতত্ত্ব বা ‘ভান্ডে ব্রহ্মান্ড তত্ত্ব’ !
সেদিন কথা হচ্ছিল _মানুষের জীবনে ‘মায়া’ বা মহামায়ার প্রভাব নিয়ে। ‘মায়া’-শব্দের অর্থ গুরুমহারাজ বলেছিলেন _’মা’ শব্দে’ ‘না’ এবং’ য়া’-শব্দে ‘হ্যাঁ’ বোঝায়, অর্থাৎ যা সত্য নয় তাকে সত্য বলে মনে করা! আবার ঠিক উল্টোটা _অর্থাৎ যা শাশ্বত, চিরন্তন সত্য, সেটাকে মিথ্যা – অলীক বলে মনে করা!
.এই মায়ার সংসারে “অহং-মম” _এই ভাবটাই সর্বাপেক্ষা অধিক ভূমিকা গ্রহণ করে।
আমি ‘অমুক’ এটাই অহং! `আমিই ব্রহ্ম’_এটা কেউ ভাবতে পারছে না! কিন্তু এটাই সত্য। আর এই সত্য বোধের চেষ্টা না করে, ধর্মজগতের মানুষেরা _’ আমি ভক্ত”, আমি ‘সাধক’, ‘আমি গুরু’ ইত্যাদি _’অহং’ এ ফেঁসে রয়েছে।
আর সাধারন মানুষের সমাজেও অহং রয়েছে, সেগুলি হল _’আমি উচ্চকুলজাত’, _’ আমি ধনী’, _’আমি শিক্ষিত`, _’আমি অমুক’_’আমি তমুক’ ইত্যাদি। আমি যা__’তা’ আর ভাবা হচ্ছে না! ফলে মিথ্যার জগতে, মায়ার জগতে রয়ে গেছি আমরা! নিত্যলোক বা শাশ্বতলোকের সন্ধান আর পাওয়া যাচ্ছে না! এই প্রসঙ্গে গুরুমহারাজ তাঁর ছোটবেলায় মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে ভ্রমণকালীন সময়ে নিজের চোখে দেখা একটা ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। সেটাই এখন বলা হচ্ছে :—
.. “মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলগুলিতে প্রচুর টিয়াপাখী! আমাদের এইসব অঞ্চলে (পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান অঞ্চলে) তো টিয়াপাখীর সংখ্যা খুবই কম হয়ে গেছে! কিন্তু ঐ অঞ্চলে সত্যিই টিয়াপাখীর সংখ্যা এখনও যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। একবার ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে ওখানকার জঙ্গলে একটা ঝরনার(সরু স্রোতস্বিনী) ধারে একটা গাছতলায় বিশ্রামের জন্য আমি (গুরু মহারাজ) বসে ছিলাম। হটাৎ দেখলাম একজন স্থানীয় মানুষ কাঁধে একটা বড় বস্তা ঝুলিয়ে ঝরনার ধারেই আর একটা গাছতলায় এসে বসল। তারপর বস্তা খুলে কিছু কিছু জিনিস বের করতে শুরু করল। আমি দেখলাম লোকটি ঝরনার এপারে একটা লাঠি শক্ত করে পুঁতে ফেলল। তারপর সে ঝরনাটির(একহাঁটু জল ছিল) ওপারে গিয়েও আর একটা লাঠি একইরকমভাবে পুঁতে দিল! ঝরনাটা বড়জোর ২০/২৫-হাত চওড়া ছিল _এবার সে ঐ খুঁটিদুটোয় একটা সরু তার খুব টান টান করে এমনভাবে বেঁধে দিল যাতে সেটি জলতলের ঠিক এক থেকে দেড়ফুট উপরে থাকে। তারপর লোকটা জলের মধ্যে নেমে নেমে একহাত অন্তর অন্তর শক্ত সুতোয় লাল লাল লঙ্কা তারের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল। এমনভাবে বাঁধল যাতে লঙ্কাগুলো জলের ঠিক উপরে থাকে। এরপর সে নিশ্চিন্ত হয়ে আবার গাছতলায় গিয়ে বসে বসে ধুমপান করতে লাগলো।
আমিও অন্য একটা গাছতলায় বসে বসে লোকটা শেষ পর্যন্ত কি করে _তাই দেখছিলাম! দেখলাম কি জানো–কিছুক্ষণের মধ্যেই একঝাঁক টিয়াপাখ সেখানে এসে হাজির! আর ওরা পটাপট্ এক একটা লঙ্কা লক্ষ্য করে উড়ে গিয়ে বসতে গেল! কিন্তু কি আশ্চর্য! ওরা যেই ‘লঙ্কা’ খাবে বলে সুতোয় বসতে যাচ্ছিল অমনি ওদের মাথাগুলো উল্টে জলের দিকে হয়ে যাচ্ছিল আর লেজটা হয়ে যাচ্ছিল উপরের দিকে !!
.পাহাড়ী ঝরনার স্বচ্ছ জল, টিয়াপাখীগুলির মাথা থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দুরে! এরফলে ওরা ওদের নিজেদের ছায়া জলে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল! নিজের ছায়া যে মুহুর্তে দেখতে পেল _অমনি ওরা আপন আপন ছায়ার সাথে ঝগড়া করতে শুরু করে দিল! সে কি ঝগড়া!! ঝগড়ায় তারা এমন মত্ত হয়ে গেল যে ঐ ব্যাধ জলে নেমে হাতে গ্লাভস্ পরে একটা একটা করে পাখি ধরে বস্তায় পুরতে শুরু করল _তবু বাকিরা তখনও ঝগড়া করেই যাচ্ছে!! এইভাবে সব কটা পাখি ধরা হয়ে গেলে- লোকটা আবার লাল লঙ্কাগুলো ঠিকঠাক করে দিচ্ছিল যাতে আরও এক ঝাঁক পাখী ধরা যায়!!
গুরুমহারাজ গল্পটা এতদূর বলার পর আমাদেরকে আরও বলতে লাগলেন _”এই ঘটনাটা দেখার পর আমার মনে হল, আমরা অর্থাৎ মানুষেরাও তো সবাই এই একইরকম!! আমরাও তো সবসময় ছায়াবাজীর শিকার! আমরাও তো সারাদিন ছায়ার সঙ্গেই যুদ্ধ করছি _ক্লান্ত হচ্ছি, বিশ্রাম নিচ্ছি, আবার লড়াই শুরু করে দিচ্ছি!
সাধারণ মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ বা ঈশ্বরত্ব অর্জন করা!যেমন টিয়াপাখি গুলোরও উদ্দেশ্য ছিল পাকা পাকা লাল লঙ্কা খাওয়া _কিন্তু যেইমাত্র স্বচ্ছ জলে ওরা ওদের ছায়া দেখতে পেল, সেটাকে অন্য পাখি ভেবে__ যে উদ্দেশ্যে আসা (লঙ্কা খাওয়া) তা ভুলে গিয়ে নিজের ছায়ার সাথেই ঝগড়ায় মত্ত হয়ে গেল! ঠিক তেমনি আমরাও (সাধারণ মানুষেরা) এইরকমটাই করে থাকি! আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি তা ভুলে গিয়ে ‘অহং’ বা ego-রূপ ছায়ার সঙ্গে লড়াই করছি। যে মুহূর্তে আমার স্বরূপ ভুলে ‘আমি অমুক’, ‘আমি তমুক’ এইটা ভেবে বসেছি_অমনি নিজে নিজেই এক একটা বিরাট জগৎ সৃষ্টি করে ফেলেছি। ‘অহং’ _আর ‘মম’ __এই দুটোতে এমনভাবে ফেঁসে গেছি যে মনে হচ্ছে _এর থেকে বেরোনোর আর নিস্তার নাই। এক একটা জীবন কেটে যাচ্ছে, ব্যাধ-রূপী মৃত্যু নিয়ে চলে যাচ্ছে _তখনও আমরা অহং-মুক্ত হতে পারছি না! তাই আবার নতুন করে নতুন শরীরে ফিরে ফিরে আসতে হচ্ছে!.বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুকুমার রায় অন্তর্মুখী মানুষ ছিলেন। উনি লিখেছিলেন __”আজগুবি নয়, আজগুবি নয় _সত্যিকারের কথা,
ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গাত্রে হোল ব্যাথা।।”(ক্রমশঃ)