এক গরীব বিধবার একটি পুত্রসন্তান ছিল। ছেলেটি ছিল রুপবান এবং গুনবানও বটে! বিধবা মা গোবর-ঘুঁটে কুড়িয়ে, লোকের বাড়ি কাজ করে ছেলেটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে তুলেছিল। তখনকার দিনে ছেলেমেয়েদের কমবয়সে বিয়ে হোত_তাই এই ছেলেটির রুপগুনের পরিচয় পেয়ে ঐ অঞ্চলের এক ধনী ব্যক্তি তার একমাত্র মেয়ের সঙ্গে ঐ ছেলেটির বিয়ে দিয়ে দিল। বিবাহের শর্ত ছিল ছেলেটিকে ঘর জামাই থাকতে হবে। দুঃখিনী মা ,দুঃখিনীই থেকে গেল _শুধু একটাই সান্তনা যে তার ছেলে এবার থেকে ভালোটা-মন্দটা খেতে পাবে! সে তো ছেলেকে কখনই কোন ভালো খাবার রান্না করে খাওয়াতে পারে নি _প্রতিদিনই শুধু চালের খুদ(ভাঙা ও বাতিল চালের অংশ, যা খুবই অল্প মুল্যে পাওয়া যায়) ঘাঁটা খেতে দিত!
বিয়ের পর ছেলেটি প্রথমবার তার বড়লোক শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছে! নতুন জামাই বাড়িতে এসেছে দেখে শ্বাশুড়ীমাতার সে কি আহ্লাদ! তখনও সন্ধ্যা নামেনি_কিন্তু নতুন জামাই খাবে বলে, শ্বাশুড়ীমাতা তখন থেকেই রান্নার বিভিন্ন পদ চাপিয়ে দিল! রান্নার সুঘ্রানে গোটা বাড়ি একেবারে ম-ম করছে!!
একটু রাত্রি হতে না হতেই ভিতরে খাবার ডাক! শ্বশুরমশাই এবং আরো অন্যান্যদের সাথে সেই ঘুঁটেকুড়ানির ছেলে আজ একসাথে খেতে বসেছে _এটা ভাবতেই তার চরম আনন্দ হচ্ছিল!তবু শত আনন্দের মধ্যেও মনে পড়ে যাচ্ছিল তার দুঃখিনী মায়ের কথা!
শুরু হোল খাবার পরিবেশন! শ্বাশুড়ীমাতা জামাই কে যত্ন করে খেতে দিচ্ছেন _কিন্তু উনি দেখলেন যে _যা যা খাবার দেওয়া হচ্ছে, ছেলেটি নিমেষের মধ্যে সেগুলি পরম তৃপ্তিতে একদম চেটেপুটে খেয়ে নিচ্ছে!
নতুন জামাই-এর খাওয়া দেখে শ্বাশুড়ীমাতা তো বেজায় খুশী! কিন্তু সে তো আর জানেনা _ রান্নার সমস্ত পদগুলোই জামাই-এর ভালো লাগার আসল কারণ! জামাই তো জীবনে কোনদিনই এইরকম তেল-মশলাদার খাবার খায় নি_তাই শ্বাশুড়ী যা দিয়েছে, তাই ওর ভালো লেগেছে!
এইবার শ্বাশুড়ী শেষপাতে একটু পরমান্ন দেবার জন্য যেই হাতায় করে তুলে ছেলেটিকে দিতে গেছে__অমনি ছেলেটি “হুঁ-হুঁ-হুঁ ! দেবেন না!দেবেন না! ওটা আমি রোজ খাই”_এই কথা বলে উঠেছে! কারন সে পরমান্নকে ভেবেছে খুদঘাঁটা!!
উপস্থিত সকলে নতুন জামাইয়ের এ হেন আচরনে একটু ঘাবড়ে গেল বটে কিন্তু মনে মনে সবাই এই ভেবে সন্তুষ্ট হল যে _জামাই-এর মা গরীব হতে পারে, কিন্তু ছেলেকে রোজ পরমান্ন রে়ঁধে খাওয়াতো!
যাইহোক, ছেলেটির ঐরূপ অকস্মাৎ আচরণে ঘাবড়ে গিয়ে শ্বাশুড়ীমাতা পরমান্নর হাতা ছেলেটির পাতের কাছে নিয়ে গিয়েও তাড়াতাড়িতে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে দু-চার ফোঁটা ওর পাতে পড়ে গেল! দুগ্ধ-ঘৃত সমন্বিত, নলেন গুড় মিশ্রিত সুগন্ধি চালের পায়েস __পাতে একটু পড়তেই চারিদিক একটা যেন অপার্থিব সৌরভে ভরে গেল! ছেলেটি কৌতুহলবশতঃ তার পাতে অসাবধনতায় পড়ে যাওয়া দু-এক ফোঁটা পরমান্ন খেয়ে নিল। আহা! কি অপূর্ব আস্বাদ! এমনটা তো সে কোনদিন খায়নি! তার গরীব মা এধরনের স্বাদযুক্ত কোন খাবার তো কোনদিন তৈরি করে দেয় নি!
এইবার সে আফসোস করতে লাগল _কেন যে সে শ্বাশুড়িকে এমন সুন্দর খাবার কে খুদঘাঁটা মনে করে __নিষেধ করতে গেল! এখন আর লজ্জায় চাইতেও পারছে না! এত সুন্দর যার আস্বাদ _সেটা তো খেয়ে দেখতেই হবে! তাহলে কি করা যায়?মনে মনে ছেলেটি মতলব আঁটল_”ঠিক আছে! গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন নাহয় রান্নাঘরে ঢুকে ঐ হাঁড়ি থেকে খানিকটা খেয়ে আসব!”
রাত্রিতে একে একে বাড়ির সব আলো নিভে গেল__ সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার অল্পবয়সী স্ত্রী ও ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে ছেলেটি চুপি চুপি উঠে সোজা চলে গেল রান্নাঘরে! সেখানে গিয়ে শিকল খুলে ভিতরে ঢুকল বটে কিন্তু অত হাঁড়ি-কুঁড়ির মধ্যে কোনটা পরমান্নর হাঁড়ি সেইটা সে অন্ধকারে ঠাহর করতে পারছিলাম না। এটায় একবার হাত দিচ্ছে _ওটায় একবার হাত দিচ্ছে, জামাকাপড়ে কালি লাগছে _তবু নতুন জামাই পাগলের মতো পরমান্ন খুঁজে চলেছে!!
এই করতে গিয়ে একটু উঁচুতে রাখা কাঁসার বাসনের গোছায় যেমনি হাত লেগেছে _অমনি সব বাসন ঝন্ ঝন্ করে বিকট শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেছে! সেই আওয়াজে বাড়ির লোকজন সকলে ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে! সবাই ভেবেছে রান্নাঘরে চোর ঢুকেছে! সবাই মিলে গিয়ে দেখে _হ্যাঁ, রান্নাঘরের দরজাও খোলা! চোর ভিতরেই আছে! হাতে কালি, মুখে কালি, কাপড়-চোপড়ে কালিমাখা চোর ধরাও পড়ল! তারপর শুরু হোল গনধোলাই!
এদিকে বাড়ির নববিবাহিত কন্যাটিরও চ্যাঁচামেচি তে ঘুম ভেঙে গেছে। সে উঠে দেখে বিছানায় তার স্বামী নাই! তাই সে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে বেরিয়ে এসেছে _এমন সময় চোরটিকেও আলোর সামনে আনা হয়েছে ____তখন চোরকে দেখে বাড়ির লোকজন তো এক্কেবারে অবাক! __”ওমা! এ তো চোর নয়! এ তো বাড়ির নতুন জামাই বাবাজী!”
কি লজ্জার ব্যাপার! তখন সবাই মিলে জামাই এর শুশ্রূষায় লেগে গেল ! জামাই একটু ধাতস্ত হতেই সকলের একটাই জিজ্ঞাসা __” বাবাজীবন! অত রাতে রান্নাঘরে তুমি কি করছিলে??”
নতুন জামাই এইভাবে ধরা পড়ে গিয়ে যারপরনাই লজ্জিত বোধ করছিল_ফলে সে সত্য গোপন করতে পারল না, বলেই দিল যে_ দু-এক ফোঁটা পরমান্ন খেয়ে এমন taste পেয়েছে, যে আরো খাবার লোভে সে একাজ করতে এসেছে! আর তাতেই এই কেলেঙ্কারি কান্ড!
গল্পটি এখানেই শেষ। এবার গুরুমহারাজ আমাদেরকে বললেন _”ঘুঁটেকুড়োনির ছেলের মতোই মানুষ প্রথমটায় আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের ব্যাপারে “উঁ-হুঁ-হুঁ” বা না-না করে।পরে দু-এক ফোঁটা পরমান্ন আস্বাদ এর মতো, পরমানন্দের স্বাদ যখন মানুষ পায়_তখন তার আর লোকলজ্জা, ভয়-ডর ইত্যাদি আর কাজ করে না _কেমন যেন একটা আচ্ছন্নতা, একটা আবেশ কাজ করে এবং সে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে চলে লক্ষ্যপূরনের উদ্দেশ্যে!
প্রথমটায় ছেলেটি যেমন পরমান্ন কে ভেবেছিল “ও তো খুদঘাঁটা”! তেমনি আধ্যাত্মিক জগতেও কোন মহাপুরুষ যখন পরমানন্দের স্বাদ সাধারণ মানুষকে দিতে আসেন __তখন প্রথমটায় মানুষ মনে করে _”এ আর কি আনন্দ! ওইরকম আনন্দ তো আমরা রোজই পাই! কিন্তু সদগুরু (গল্পের শ্বশ্রুমাতা) কৃপা করে যখন সেই ভূমানন্দের স্বাদ পাইয়ে দেন _তখন সাধক বলে ওঠে _”এ কি!! এ কি!! এমনটা তো কখনও পাইনি!” শুরু হয় অন্বেষণ “কোথায় পাব তারে!!”
এই অবস্থায় সাধকের আর লজ্জা ঘৃনা ভয় কুল শীল মান অপমান __সমস্ত ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সাধক ছুটে চলে _আনন্দের ভান্ডারের(গল্পে পরমান্নের হাঁড়ি) সন্ধানে। পরমানন্দ লাভ করার পর সাধক বুঝতে পারে বিষয়ানন্দ আর ভূমানন্দের ফারাক!!অন্তর্মুখী সাধকের ইন্দ্রিয় ভোগের স্পৃহা তুচ্ছ হয়ে যায়, এক অপার্থিব আনন্দে আত্নমগ্ন হয়ে সাধকের জীবন রূপান্তরিত হয় মহাজীবনে!!!!! (ক্রমশঃ)