এক নাবিক জাহাজে করে এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ায় ৷ হঠাৎ একদিন জাহাজ ডুবি হয়ে সে সাঁতরে সাঁতরে একটি এমন দ্বীপে এসে উঠল যে দ্বীপে যে সমস্ত মানুষ বসবাস করে, তারা সকলেই কুষ্ঠরোগী! সবার হাতে পায়ে দগ্-দগে ঘা আর সেই সব ঘায়ে ন্যাকড়া জড়ানো!
লোকটি যখন পাড়ে উঠে লোকালয়ের দিকে গেল_তখন সেখানকার মানুষজনের আচার আচরণ দেখে সে অবাক হয়ে গেল! এই ব্যক্তির গায়ে, হাতে, পায়ে ন্যাকড়া জড়ানো নাই দেখে – ওখানকার লোকেরা একে এড়িয়ে যেতে শুরু করল! ঐ ব্যক্তি যতই মানুষজনের কাছে যায়, কিছু খাদ্য-পানীয়ের কথা বলতে যায় – কেউ ওর কথা শোনে না! বরং ওকে দেখে সবাই যেন কেমন একটা অনীহা, এড়িয়ে যাবার মানিসকতা!
লোকটি সবার কাছেই এইরূপ ব্যবহার পেয়ে একটা গাছতলায় বসে ভাবতে শুরু করল – ব্যাপারটা কি ? কিছুক্ষণ ভাবার পর সে বুঝতে পারল যে – যেহেতু এই দ্বীপে সকলেই কুষ্ঠরোগী এবং সকলের হাতে পায়ে ন্যাকড়া জড়ানো, অতএব প্রথমেই তাকে ওদের মতো সাজতে হবে — তবেই সেখানকার মানুষ তার কথা শুনবে, অন্যথায় নয় ।
এইটা বুঝতে পেরে নাবিকটি একটি ঝোপের আড়ালে গিয়ে নিজের কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে হাতে পায়ের বিভিন্ন স্থানে ন্যাকড়া জড়িয়ে নিল । এরপর যখনই সে পুনরায় লোকসমক্ষে এল, তখন অনেকেই এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগল – “কি মশাই ! এদেশে নতুন নাকি ! আগে তো কখনো দেখিনি! তা – কোথা থেকে আসা হচ্ছে ?” লোকটি তখন এক জায়গায় বসে সবার জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে শুরু করল । বলল — সে অনেক দূরের দেশ থেকে আসছে ৷ আসার পথে আরও নানান দেশ সে দেখেছে! সেখানকার মানুষ, সেখানকার জীবন-যাপন, সেসব দেশের নানান কাহিনী তার জানা রয়েছে! এইকথা শুনে তো মানুষজনের মধ্যে তুমুল সাড়া পড়ে গেল, সেখানকার মানুষেরা ঐ আজনবীর কাছ থেকে অজানা দেশের কাহিনী শুনতে লাগল! কিছু বয়স্ক মানুষ মা বা বাবার মতো স্নেহপ্রবন, তারা দেখল ছেলেটি বহুদূর থেকে আসছে – হয়তো ভালো করে খাওয়াও হয়নি, তারা খাবার ব্যবস্থা করে দিল । কিছু ইয়ং ছেলে-মেয়ের খুবই উৎসাহ! নতুন দেশের অতিথিকে নিয়ে তারা মেতে উঠল, করে দিল বাসস্থানের ব্যবস্থা ! এদের অনেকের সাথে নাবিকের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল!
নাবিক নানান দেশের মানুষের কথা এবং তাদের জীবন-যাপন নিয়ে কথা বলে – সব মানুষই এইসব কথাবার্তা শুনে আনন্দ পায় , কেউ কেউ তার কথা অনুযায়ী জীবন যাপন ও করে ।
এইরকমটাই চলছিল, নাবিক কিন্তু তারই ফাঁকে অনুসন্ধান চালাতে শুরু করে __এই দ্বীপের সমস্ত মানুষের কুষ্ঠরোগের কারণ কি — তা জানার! খুঁজে খুঁজে সে দেখল যে, কিছু কিছু বিশেষ প্রজাতির গাছ রয়েছে সেই দ্বীপে – যাদের পাতা জলের সঙ্গে মিশে জলদূষণ করছে বা এদের ফুলের রেণু বাতাসে ছড়িয়ে বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে ৷ ব্যস্ — যেমনি চিহ্নিত হয়ে গেল অমনি নাবিক তার অন্তরঙ্গদের ডেকে নিল তার কাছে! সে ঐ অন্তরঙ্গদের কাছে তার সুস্থ নিরোগ দেহ দেখাল। আর তার দেহ দেখিয়ে সমগ্র ব্যাপারটা তাদের কাছে পরিষ্কার করে বলল। অন্তরঙ্গরা ব্যাপারটা বুঝে ঐ নাবিকের সাথে হাত মিলিয়ে কি করে দ্বীপকে কুষ্ঠরোগমুক্ত যায় তার প্রচেষ্টায় লেগে পড়ল।ওদের দেখাদেখি আরও অনেকে এই কাজে হাত লাগাল। এর ফলে সকলের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে দ্বীপটি কুষ্ঠরোগমুক্ত হতে শুরু করল।
গল্পটি এতদূর পর্যন্ত বলার পর গুরু মহারাজ বললেন – এই পৃথিবী গ্রহটি ওইরূপ কুষ্ঠরোগীদের দ্বীপের মতো! যখন কোন মহাপুরুষ শরীর নিয়ে সমাজে কাজ করতে আসেন তখন তিনি দেখেন মানুষের মধ্যে কামনা-বাসনার বীজ কৃমি-কীটের মতো কিলবিল করছে! মোহ-মায়া-মমতার বন্ধনে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে মানুষ, আর এরফলে ত্রিবিধ জ্বালায় জ্বলছে! কিন্তু মুক্ত, নির্মোহ, সদানন্দ, পূর্ণজ্ঞানী মানুষকে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করবে না – তাঁর কাছে ভিড়বেই না! সেইজন্য মহাপুরুষগণ পৃথিবীতে শরীর ধারণ করার পর ছদ্মবেশ ধারণ করেন! এই ছদ্মবেশ হোল __আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের ন্যায় আচরণ করতে থাকা! একই রকম পোষাক – একই রকম খাওয়া দাওয়া – প্রায় সব কিছুই যেন একই রকম!
কিন্তু যেহেতু তার দেশ-বিদেশের কথা বা খবর জানা আছে _তাই লোক সংগ্রহে কোন অসুবিধা হয় না। বিশেষত তার স্বদেশ – যেখান থেকে সবাই এসেছে বা যেখানে সকলকে আবার ফিরতে হবে, __সেই দেশের কথা বলতে শুরু করতেই লোকের মধ্যে ধারণা জাগে যে ইনি আমাদের মতো হলেও কেমন যেন আলাদা!
ধীরে ধীরে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করতে থাকেন তিনি । অন্তরঙ্গ জনেরা বেশীরভাগ তারই লোক , কেউ তার সমবয়সী – কেউ হয়তো কিছু আগে পরে শরীর ধারণ করেছে । কিন্তু ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যায়! মহাপুরুষ যেই কাজ শুরু করেন এরা যে যেখানেই থাক পৃথিবীর অন্য প্রান্তের হলেও ঠিক মহাপুরুষের আরব্ধ কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে চলে আসে! দ্বীপকে কুষ্ঠমুক্ত করার কাজে হাত লাগায় ! অর্থাৎ মানুষের মনে জমে থাকা জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার কাটিয়ে মায়া-মোহের বন্ধন থেকে মুক্তির পথ দেখাতে শুরু করে ৷ সাধারণ মানুষকে দেখে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন “বজ্রাহত বৃক্ষ” ৷ কেন বলেছিলেন – উনি দেখলেন তৎকালীন মানুষ (ভারতের স্বাধীনতার বহুপূর্বে) অভাবে, অত্যাচারে, দারিদ্র্যে, পরাধীনতায় ধুঁকছে ৷ সামনে কোন আলো নাই , কোন দিশা নাই বরং দিন দিন আরও অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । তার উপর উশৃঙ্খল জীবন-যাপন ফলে হীন বীর্য্য মানুষ! এদের দেখেই তিনি দুঃখ করে ওই কথা বলেছিলেন ৷ কিন্তু দেশের স্বাধীনতা-উত্তর পরিস্থিতিতেই বা মানুষের এমন কি হোল ! হ্যাঁ , অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থার প্রভূত উপকার হয়েছে , উন্নতি হয়েছে , কিন্তু অন্তরজগতের কতটুকু উন্নতি হয়েছে ! স্থূলশরীর পুষ্ট করতে গিয়ে সূক্ষ্ম বা কারণশরীর শুকিয়ে যাচ্ছে বা বলা যায় একদম শুকিয়েই গেছে!
কোন সমাজের প্রকৃত উন্নতি বলতে ত্রিবিধ শরীরের পুষ্টি । স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ – এই তিন শরীরের পুষ্টিসাধন হলেই সমাজও পুষ্ট হবে ,আর একমাত্র তখনই সমাজ সমস্যামুক্ত হবে ৷ [ক্রমশঃ]