(আগের এপিসোডে ছিল দুই সন্ন্যাসীর কথা! জুনিয়র সন্ন্যাসী একটি যুবতী মেয়েকে কোলে তুলে একটি পাহাড়ী নদী পার করে দিয়েছিল। এতে ওনার কোন মনোবিকার হয় নি _কিন্তু সিনিয়র সন্ন্যাসী সারাদিন ধরে ওই কথাটাই মনে চেপে বসিয়ে রেখেছিল। সন্ধ্যার সময় আর চেপে রাখতে না পেরে তার বহিঃপ্রকাশ করেই ফেলল…….)
….Senior সন্ন্যাসী রাগত স্বরে বলল – ” ওই যে একটা যুবতী মেয়েকে তুমি খালি গায়ে কৌপীন পড়া অবস্থায় কোলে তুলে নিয়ে পুরো নদীটা পাড় করে দিলে ?”
নবীন সন্ন্যাসী ঘটনাটি স্মরণ করে বলল , “ওঃ! আচ্ছা _আচ্ছা! কিন্তু এটা তো সেই সকালের কথা – এখন সন্ধ্যাবেলা ! আর তাছাড়া আমি তো মেয়েটিকে নদী পার হবার পরই কোল থেকে নামিয়ে দিয়েছি – আপনি কেন এখনো মনে বয়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন ?”
গল্পটি শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠল ৷ গুরু মহারাজ নিজেও হাসছিলেন ৷ তাঁর সুন্দর মুখের স্বর্গীয় অনাবিল হাসির তুলনা ছিল না । এবার তিনি বলতে শুরু করলেন –”এইভাবেই আমরা জন্ম-জম্মান্তরের সংস্কার মনে বয়ে বয়ে বেড়াচ্ছি! মনকে free হোতে দিচ্ছি না – মুক্ত বিহঙ্গের মতো মন চিদাকাশে বিচরণ করতে পারছে না! স্থূলশরীর-কেন্দ্রিক জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে মন!
তাহলে মনের সংকল্প-বিকল্পরহিত অবস্থা কিভাবে প্রাপ্ত হওয়া যাবে ? পাওয়া কি যাবে না? অথচ দেখুন এই অবস্থা প্রাপ্ত হওয়াটাই তো মানবজীবনের লক্ষ্য , ওটাই অন্তিম বা চরম দশা !
কিন্তু সেই লক্ষ্যে না পৌঁছে, এইভাবে পথ হারিয়ে দিশাহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে মানবের – সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে চলা আর হয়ে উঠছে না! জড়বিজ্ঞানের দিক থেকে দেখলে পৃথিবীগ্রহের যা কিছু তা সততই নিম্নমুখী – পৃথিবীর কেন্দ্রের অভিমুখী! উঁচুতে উঠতে না দেওয়াই পৃথিবীর অভিকর্ষতার ধর্ম! এখানে উপরে উঠতে গেলে হালকা হতেই হবে – যত ভারী হবে তত নিম্নমুখীনতা বাড়বে!
সুতরাং মনের বিষয়বস্তু , চিন্তার বিষয়বস্তু যত স্থূল হবে, যত ভারী হবে, ততই তা নিম্নগামী হবে! স্থূলশরীর ধারণ করে মানবের মনে স্থূল চিন্তা বা পার্থিব বিষয়সমূহের চিন্তা যে একেবারেই আসবে না তা নয় – কিন্তু তাকে মনে বয়ে বেড়ালে চলবে না! অকারণ মনকে ভারাক্রান্ত করে কি লাভ ! ঐ নবীন সন্ন্যাসীর মতো বলতে হবে – ” ওকে তো আমি কোন সকালে নদীর পাড়েই নামিয়ে দিয়েছি – অাপনি কেন এখনো মনে বয়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন ?” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও বলেছিলেন – মানুষ মনেই বদ্ধ আবার মনেই মুক্ত! কোন বিষয় , কোন দুশ্চিন্তা যা মনকে ভারাক্রান্ত করছে , মনকে পীড়া দিচ্ছে – তাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেই আর কষ্ট নাই!
মনের বিষয়কে ঝেড়ে ফেলতে পারার জন্যই তো সাধনা ! সাধক ছাড়া , যোগী ছাড়া অত সহজে মনের বিষয়কে ইচ্ছামাত্র ঝেড়ে ফেলা সহজ কাজ নয়! বিশেষতঃ কাম , ক্রোধ , লোভ , মোহ আদি রিপুর প্রভাব, শোক-দুঃখের প্রভাব , শারীরিক যন্ত্রণা বা ব্যাধির প্রভাব – ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে খুবই দুঃসাধ্য!
কিন্তু এগুলির প্রভাব থেকেও মুক্ত হওয়া যায়! তার প্রমাণ বিভিন্ন মহাত্মা – মহাপুরুষ নিজের জীবনে আচরণ করে দেখিয়ে গেছেন অর্থাৎ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন!
‘সংসার জীবনে আছে _তার দ্বারা আর কিছু হবে না’ _এমন ভেবে দুর্বল হওয়া উচিত নয়। বহু সাধক প্রথমজীবনে সংসার করেও পরবর্ত্তীতে সিদ্ধিলাভ করেছেন ! অনেকে বিরাট ধনীর ঘরে জন্মেছিলেন কিন্তু পরবর্ত্তীতে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়েছেন , শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী হয়েও বাকি জীবন ধ্যান-জপ , সাধন-ভজনে কাটিয়েছেন ৷ এইরূপ অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। যে ব্যক্তি যে অবস্থাতেই থাক না কেন ঈশ্বরমুখী বা ইষ্টমুখী হলেই জীবের কল্যাণ হবে ৷৷” [ক্রমশঃ]