বেনারসে এক সাধুর একটি আশ্রম ছিল । সেই সাধুবাবার অনেক শিষ্যও ছিল। তাদের মধ্যে কেউ গৃহী , কেউ ব্রহ্মচারী , আবার কেউ সন্ন্যাসী! ঐ সাধুবাবার আশ্রমে একটা ঘটনা ঘটেছিল। আর এই ঘটনাটাও গুরু মহারাজের সামনেই ঘটেছিল – কারণ সেই সময় বালক অবস্থায় উনিও বেশ কিছুদিন বেনারসে অবস্থান করেছিলেন । দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে ঐ সাধুবাবার আশ্রম ছিল । ভক্ত সমাগম হলে ঐ সাধুবাবা বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ ও ব্যাখ্যা করতেন , প্রবচন করতেন বা সৎসঙ্গ করতেন ৷ এবার মজার ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, ঐ সাধুবাবার সৎসঙ্গ বা ব্যাখ্যা চলাকালীন ওখানে মাঝে মাঝেই এক পাগলীর আবির্ভাব ঘটতো – যে ঐ সাধুটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠত “সাধু ! মরণ সে হুঁশিয়ার রহনা !”
যেহেতু এই একই ঘটনা প্রায়ই ঘটত – তাই সাধুর শিষ্যরা বা সাধু নিজেই ঐ পাগলীকে নিছক পাগলী ভেবে তাড়াতুড়ো করত আর পাগলী হাসতে হাসতে ছুটে পালাত!
এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল সময় । ঐ আশ্রমের সাধুবাবা ধীরে ধীরে বয়সের ভারে জরাগ্রস্থ ও ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পড়লেন । প্রয়াণের সময় আগত — সাধুবাবার শিষ্যরা গুরুর কুঠীয়ার সামনে বসে পালা করে নাম-জপ করছে – গীতাপাঠ চলছে! সাধুবাবার নাভিশ্বাস উঠেছে — এই প্রাণ বের হয় কি সেই প্রাণ বের হয়! সাধুবাবার চোখ শুধু উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে আর তিনি শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে শেষ সময়ের প্রহর গুনে চলেছেন ৷ এর মধ্যে পাগলী দু-একবার এসে বলে গেছে — “সাধু – মরণ সে হুঁশিয়ার রহনা” ! মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ সাধুটির উপরপানে দৃষ্টি – চোখ ঘুরে ঘুরে ঘরের চালের বিভিন্ন প্রান্তে চোখ যাচ্ছে । হঠাৎ সাধুবাবার চোখে পড়ল একটা চক্-চকে কাগজে মোড়া নতুন একজোড়া জুতোর দিকে !
আরে ! এ তো সেই জুতো – যেটা এক বড়লোক মারোয়ারী ভক্ত দিয়েছিল, দামী হরিণের চামড়ার জুতো ! যে কোন বড়লোক অর্থাৎ ধনী ভক্তের বাড়ী যাবার আগে সাধারণত এই জুতোটাই সাধুবাবা পড়তেন ৷ মাঝখানে জুতোটা আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না – কোথায় যত্ন করে তোলা হয়েছিল! সেইসময় সাধুবাবার ঐ জুতোজোড়ার জন্য খুবই কষ্ট হয়েছিল – আর এতদিন পরে আজ তাকে দেখা গেল, তাহলে চালের বাতার মধ্যে আটকানো ছিল ! .. বড় আফশোষ হ’ল সাধুবাবার মনে — সৗেখিন দামী জুতোটা এ জীবনে আর পড়তে পেলো না ? এই ভাবতে ভাবতেই একটা কাশির দমক্ উঠল – আর সেই দমকেই সাধুবাবার প্রাণবিয়োগ হয়ে গেল!!
জুতোর চিন্তা নিয়ে মৃত্যু হওয়ায় পরের শরীরে ঐ সাধুবাবা জুতার কারবারী মুচির ঘরে জন্ম নিল । কিন্তু পূর্বজন্মের সুকৃতির জন্য কাশীতেই এবং দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছাকাছি এক মুচি পরিবারে সে শরীর নিয়েছিল । একটু বড় হতেই সে পিতার সঙ্গে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছেই – পূর্ববর্ত্তী জন্মের ওরই আশ্রম সংলগ্ন স্থানে চট্ পেতে জুতো সেলাই ও সারাই-এর কাজ করত! পিতার মৃত্যুর পর পাকাপাকিভাবে ঐ ছেলেটি-ই (পূর্ব জীবনের সাধুবাবা) জুতোর দোকানের মালিক হ’ল । অনেক জুতো নিয়ে সবসময় নাড়াচাড়া কোরতো ৷ তবে পূর্ব জন্মের ধ্যান-জপ-সাধন ভজনের ফলে এবং স্থান মাহাত্ম্যে ঐ ছেলেটি বেশীরভাগ সাধু-সন্তের অথবা পূণ্যার্থীদের জুতো সারাই বা সেলাই কোরতো — তাদের order মতো জুতো তৈরীও করে দিতো!
এদিকে সেই পাগলীর কিন্তু দেহান্ত হয়নি – সে তখনও মাঝে মাঝেই ছেলেটির সামনে এসে বলত – ” ক্যায়া রে সাধু ! বোলা থা না – সাধু! মরণ সে হুঁশিয়ার রহনা ” ! ছেলেটি কিছুই বুঝতে পারতো না , পাগলী ‘কি বলছে না কি বলছে’ মনে করে ছেলেটি পাগলীকে লাঠি নিয়ে তাড়া দিতো – পাগলী হাসতে হাসতে চলে যেতো! [ক্রমশঃ]