[ছোটবেলায় গুরুমহারাজ একবার বেনারসে ছিলেন। সেইসময় একটি মুচি দশাশ্বমেধ ঘাটে জুতোর দোকান করে সাধু-সন্তদের জুতো সারাই করত। আর এক পাগলী মাঝে মাঝেই সেখানে এসে বলত _”সাধু মরণ সে হুঁশিয়ার রহনা!” এসবের একটা পূর্ব ইতিহাস ও ছিল…..]
…… গুরু মহারাজ সেই সময় ঐ অঞ্চলে (বেনারসে) ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ৷ উনি ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন যে , পাগলীটি মুচি ছেলেটির কাছে গেলেই বলে ওঠে ” ক্যায়া ! বোলা থা না — সাধু মরণ সে হুঁশিয়ার রহনা !” এর পিছনে রহস্যটি কি ! ঐ পাগলীর সাথে গুরু মহারাজের আগে থাকতেই খুব প্রেমের সম্বন্ধ ছিল , কারণ ঐ পাগলী একদিন বালক গুরু মহারাজকে চরম অভুক্ত অবস্থা থেকে রক্ষা করেছিলেন ৷ নোংরা কাপড়ের আঁচল থেকে গরম এবং অপার্থিব স্বাদযুক্ত খাবার খাইয়েছিলেন , সেই থেকে গুরু মহারাজ পাগলীকে মাতৃজ্ঞানে ভক্তি করতেন! (প্রকৃতপক্ষে ঐ পাগলীমা ছিলেন কাশীর সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা), কিন্তু স্থুলশরীরেই থাকতেন। গুরুমহারাজ বলেছিলেন _কাশীর বিশেষত্ব এটাই! এখানে সবসময়ের জন্য বিশ্বনাথ শিব এবং মা অন্নপূর্ণা কোন না কোন স্থুলশরীর ধারণ করে ঘুরে বেড়ান) । একদিন গুরু মহারাজ ঐ পাগলী মাকে follow করে করে গিয়ে এক নির্জন স্থানে মাকে ধরে ফেললেন ৷ তাঁর কাছে ঐ মুচি ছেলেটির রহস্য কি – তা জানতে চাইলেন ৷ মা সব কথা অর্থাৎ ঐ ছেলেটি যে পূর্বজন্মে পাশের আশ্রমের মন্ডলেশ্বর ছিল _ইত্যাদি সব কথা গুরুজীকে খুলে বললেন ৷ সব শুনে করুণাদ্র হয়ে গুরু মহারাজ মা-কে প্রার্থনা করলেন ” মা ! ছেলেটিকে এবার মুক্ত করে দাও ! ওর কর্মফল শেষ করে দাও !” মা বললেন ” তুই যখন বলছিস , তখন তাই হোক্ “।
এরপরেই ওখান থেকে উঠে পাগলী-মা সোজা দশাশ্বমেধ ঘাটে সেই মুচি ছেলেটির কাছে গেলেন – গুরুজীও পিছু পিছু গিয়ে সব লক্ষ্য করছিলেন ৷ মা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে যেই বলে উঠলেন – ” এই সাধু ! বোলা থা না – মরণ সে হুঁশিয়ার রহনা ! মেরি বাত মানা নেহি – ভুগতনা তো পড়েগাই! ” এই বলে সে কি হাসি ! ছেলেটি কিছুই বুঝতে না পেরে, অন্যান্য দিনের মতো লাঠি নিয়ে তাড়া করতে যেই না উঠেছে __আর অমনি মা একটা বিশেষ মুদ্রা করে দাঁড়িয়ে গেলেন! আর সাথে সাথে ছেলেটির পূর্বস্মৃতি সব মনে পড়ে গেল! ছেলেটি আর দোকানের দিকে , জুতোর দিকে না তাকিয়ে সোজা নেমে গেল গঙ্গায় । সেখানে কয়েকটা ডুব দিয়ে গঙ্গার ধার ধরে কোথায় যে হারিয়ে গেল – আর কেউ কোনদিন তার সন্ধান পায়নি! গুরু মহারাজ বললেন — ও পূর্বে যে পরম্পরার সন্ন্যাসী ছিল সেখানেই দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যায় ও সাধন-ভজনে বাকীকাল অতিবাহিত করে!
গল্পটি সাঙ্গ করে গুরু মহারাজ উপস্থিত জনদের উদ্দেশ্য করে বললেন — মরণকালে যে ভাবনায় মানুষের মৃত্যু হয় , পরের শরীরে সেইটাই প্রকট হয় ৷ ভাবনা – ইচ্ছা – ক্রিয়া ; ভাবনা ইচ্ছায় রূপ নিলেই তা কার্য্যে রূপ নেবে ৷ এইটাই কর্মজগতের রহস্য! তাই ইচ্ছা , আকাঙ্খা বা বাসনায় আগুন দেবার কথা বলা হয়েছে ৷ বাসনা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতে পারলে অার ক্রিয়ায় রূপ নিতে পারে না । ভাবনায় ভালো খারাপ যা কোন কিছু উদয় হলেও তাতে দোষ হয় না । এইজন্যেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন “কলিতে মনের পাপ – পাপ নয় ।” মরণকালে (শরীর ত্যাগের মুহূর্ত্তে) ইষ্টচিন্তা , গুরুচিন্তা , ঈশ্বরচিন্তায় বিভোর হয়ে শরীর ছাড়লে পরমগতি লাভ হয় ৷ গুরু বা ইষ্টচিন্তায় মৃত্যু হলে গুরু বা ইষ্ট তার ভার গ্রহণ করেন – তাই বলা হল পরমগতি ৷
স্থূলশরীর ছাড়ার পর সূক্ষ্ম অবস্থাতেই গুরু তখন তাকে নানা প্রকারের সাধন করিয়ে নেন । ঐ অবস্থায় স্থূল ইন্দ্রিয়সকল না থাকায় সাধনের বিশেষ সুবিধা হয় ৷ ফলে যখন ঐ শরীরের আবার জন্ম হয় অর্থাৎ সে যখন পুনরায় স্থূলশরীর প্রাপ্ত হয় তখন তার অনেক অগ্রগতি হয়ে গেছে! সেই শরীরে হয়তো কামনা বাসনা সমূহ আর স্পর্শ্যই করতে পারবে না! তাই করুণাময় বলা হয়েছে গুরুকে! তিনি যার ভার নেন – তার আর ভাবনা কি ! তিনি ঠিক তাকে দিয়ে সঠিক কাজটি করিয়ে তাকে ভবরোগের জ্বালা থেকে মুক্ত করে দেন! ভবরোগবৈদ্য যে তিনি – মানুষের মঙ্গল করতেই তাঁর আসা !
মরণকালে যাতে শুদ্ধ ভাবনা থাকে , গুরুভাবনা – ইষ্টভাবনা থাকে__তারজন্যই তো সাধন-ভজন , সৎগ্রন্থ পাঠ , সৎ-আলোচনা , সৎসঙ্গ – সাধুসঙ্গ!! মানুষ সারাজীবন যা করে – মৃত্যুকালে তারই জৃম্ভন হয় (জাবর কাটে) ৷ এইজন্যই গুরু শিক্ষা দেন __সৎভাবে , সৎচিন্তায় জীবন কাটালে মৃত্যুকালে মানুষের সত্যলোকে – সৎলোকে গতি হয়, আর অসৎচিন্তায় , অসৎভাবে জীবন কাটালে মৃত্যুর পর অসৎলোকে গতি হয়! তাই তো ঋষিরা প্রার্থনা করেছিলেন ” অসতো মা সদগময় , তমসো মা জ্যোতির্গময় ……”!
সুতরাং বুঝলে তো, ‘মা’ কেন বলতেন_ ” সাধু মরণ সে হুঁশিয়ার রহনা ” ৷৷
[ক্রমশঃ]
…… গুরু মহারাজ সেই সময় ঐ অঞ্চলে (বেনারসে) ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ৷ উনি ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন যে , পাগলীটি মুচি ছেলেটির কাছে গেলেই বলে ওঠে ” ক্যায়া ! বোলা থা না — সাধু মরণ সে হুঁশিয়ার রহনা !” এর পিছনে রহস্যটি কি ! ঐ পাগলীর সাথে গুরু মহারাজের আগে থাকতেই খুব প্রেমের সম্বন্ধ ছিল , কারণ ঐ পাগলী একদিন বালক গুরু মহারাজকে চরম অভুক্ত অবস্থা থেকে রক্ষা করেছিলেন ৷ নোংরা কাপড়ের আঁচল থেকে গরম এবং অপার্থিব স্বাদযুক্ত খাবার খাইয়েছিলেন , সেই থেকে গুরু মহারাজ পাগলীকে মাতৃজ্ঞানে ভক্তি করতেন! (প্রকৃতপক্ষে ঐ পাগলীমা ছিলেন কাশীর সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা), কিন্তু স্থুলশরীরেই থাকতেন। গুরুমহারাজ বলেছিলেন _কাশীর বিশেষত্ব এটাই! এখানে সবসময়ের জন্য বিশ্বনাথ শিব এবং মা অন্নপূর্ণা কোন না কোন স্থুলশরীর ধারণ করে ঘুরে বেড়ান) । একদিন গুরু মহারাজ ঐ পাগলী মাকে follow করে করে গিয়ে এক নির্জন স্থানে মাকে ধরে ফেললেন ৷ তাঁর কাছে ঐ মুচি ছেলেটির রহস্য কি – তা জানতে চাইলেন ৷ মা সব কথা অর্থাৎ ঐ ছেলেটি যে পূর্বজন্মে পাশের আশ্রমের মন্ডলেশ্বর ছিল _ইত্যাদি সব কথা গুরুজীকে খুলে বললেন ৷ সব শুনে করুণাদ্র হয়ে গুরু মহারাজ মা-কে প্রার্থনা করলেন ” মা ! ছেলেটিকে এবার মুক্ত করে দাও ! ওর কর্মফল শেষ করে দাও !” মা বললেন ” তুই যখন বলছিস , তখন তাই হোক্ “।
এরপরেই ওখান থেকে উঠে পাগলী-মা সোজা দশাশ্বমেধ ঘাটে সেই মুচি ছেলেটির কাছে গেলেন – গুরুজীও পিছু পিছু গিয়ে সব লক্ষ্য করছিলেন ৷ মা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে যেই বলে উঠলেন – ” এই সাধু ! বোলা থা না – মরণ সে হুঁশিয়ার রহনা ! মেরি বাত মানা নেহি – ভুগতনা তো পড়েগাই! ” এই বলে সে কি হাসি ! ছেলেটি কিছুই বুঝতে না পেরে, অন্যান্য দিনের মতো লাঠি নিয়ে তাড়া করতে যেই না উঠেছে __আর অমনি মা একটা বিশেষ মুদ্রা করে দাঁড়িয়ে গেলেন! আর সাথে সাথে ছেলেটির পূর্বস্মৃতি সব মনে পড়ে গেল! ছেলেটি আর দোকানের দিকে , জুতোর দিকে না তাকিয়ে সোজা নেমে গেল গঙ্গায় । সেখানে কয়েকটা ডুব দিয়ে গঙ্গার ধার ধরে কোথায় যে হারিয়ে গেল – আর কেউ কোনদিন তার সন্ধান পায়নি! গুরু মহারাজ বললেন — ও পূর্বে যে পরম্পরার সন্ন্যাসী ছিল সেখানেই দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যায় ও সাধন-ভজনে বাকীকাল অতিবাহিত করে!
গল্পটি সাঙ্গ করে গুরু মহারাজ উপস্থিত জনদের উদ্দেশ্য করে বললেন — মরণকালে যে ভাবনায় মানুষের মৃত্যু হয় , পরের শরীরে সেইটাই প্রকট হয় ৷ ভাবনা – ইচ্ছা – ক্রিয়া ; ভাবনা ইচ্ছায় রূপ নিলেই তা কার্য্যে রূপ নেবে ৷ এইটাই কর্মজগতের রহস্য! তাই ইচ্ছা , আকাঙ্খা বা বাসনায় আগুন দেবার কথা বলা হয়েছে ৷ বাসনা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতে পারলে অার ক্রিয়ায় রূপ নিতে পারে না । ভাবনায় ভালো খারাপ যা কোন কিছু উদয় হলেও তাতে দোষ হয় না । এইজন্যেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন “কলিতে মনের পাপ – পাপ নয় ।” মরণকালে (শরীর ত্যাগের মুহূর্ত্তে) ইষ্টচিন্তা , গুরুচিন্তা , ঈশ্বরচিন্তায় বিভোর হয়ে শরীর ছাড়লে পরমগতি লাভ হয় ৷ গুরু বা ইষ্টচিন্তায় মৃত্যু হলে গুরু বা ইষ্ট তার ভার গ্রহণ করেন – তাই বলা হল পরমগতি ৷
স্থূলশরীর ছাড়ার পর সূক্ষ্ম অবস্থাতেই গুরু তখন তাকে নানা প্রকারের সাধন করিয়ে নেন । ঐ অবস্থায় স্থূল ইন্দ্রিয়সকল না থাকায় সাধনের বিশেষ সুবিধা হয় ৷ ফলে যখন ঐ শরীরের আবার জন্ম হয় অর্থাৎ সে যখন পুনরায় স্থূলশরীর প্রাপ্ত হয় তখন তার অনেক অগ্রগতি হয়ে গেছে! সেই শরীরে হয়তো কামনা বাসনা সমূহ আর স্পর্শ্যই করতে পারবে না! তাই করুণাময় বলা হয়েছে গুরুকে! তিনি যার ভার নেন – তার আর ভাবনা কি ! তিনি ঠিক তাকে দিয়ে সঠিক কাজটি করিয়ে তাকে ভবরোগের জ্বালা থেকে মুক্ত করে দেন! ভবরোগবৈদ্য যে তিনি – মানুষের মঙ্গল করতেই তাঁর আসা !
মরণকালে যাতে শুদ্ধ ভাবনা থাকে , গুরুভাবনা – ইষ্টভাবনা থাকে__তারজন্যই তো সাধন-ভজন , সৎগ্রন্থ পাঠ , সৎ-আলোচনা , সৎসঙ্গ – সাধুসঙ্গ!! মানুষ সারাজীবন যা করে – মৃত্যুকালে তারই জৃম্ভন হয় (জাবর কাটে) ৷ এইজন্যই গুরু শিক্ষা দেন __সৎভাবে , সৎচিন্তায় জীবন কাটালে মৃত্যুকালে মানুষের সত্যলোকে – সৎলোকে গতি হয়, আর অসৎচিন্তায় , অসৎভাবে জীবন কাটালে মৃত্যুর পর অসৎলোকে গতি হয়! তাই তো ঋষিরা প্রার্থনা করেছিলেন ” অসতো মা সদগময় , তমসো মা জ্যোতির্গময় ……”!
সুতরাং বুঝলে তো, ‘মা’ কেন বলতেন_ ” সাধু মরণ সে হুঁশিয়ার রহনা ” ৷৷
[ক্রমশঃ]