এক দেশে এক রাজা তার মন্ত্রী – সেনাপতি – সভাসদদের নিয়ে সুখেই রাজত্ব করছিল । হঠাৎ সেই সুখের ছন্দপতন ঘটে গেল! ভোররাতে একদিন রাজার ঘুম ভেঙে গেল, আর ঘুম এল না! তার ভাবনায় এল – সময় কেটে যাচ্ছে , তার নিজের বয়স বাড়ছে কিন্তু জীবনে কি-ই বা হোল ? রাজকার্য্য হচ্ছে , রাজ্য ঠিকমতো চলছে — এসবই ঠিক আছে ,এগুলো তো নিত্যনৈমিত্তিক কাজ! কিন্তু ভালো কাজ কি হচ্ছে ? মানুষের জীবন তো ভালো কাজ করার জন্য!! তখনই রাজার মনে তিনটি জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হ’ল – (১) ভালো কাজ কি ? , (২) ভালো কাজ কখন করা উচিৎ এবং (৩) ভালো কাজ করব কেন ?
সকাল বেলায় রাজা আর রাজসভায় গেল না, শুধু ঐ তিনটি প্রশ্নের উত্তর ভেবে যাচ্ছে৷ মন্ত্রী-সভাসদরা সবাই রাজার অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে সভা ভেঙে যার যার কাজে চলে গেল। পরের দিনও রাজামশাই ভাবনার জগতে এমনভাবে ডুবে রইলেন যে, সেদিন ও রাজসভায় যাওয়া হোল না। এইভাবে তিন দিন কেটে যাবার পর যখন রাজ্যপাট লাটে উঠতে বসেছে, তখন মহামন্ত্রী রাজঅন্তঃপুরে এলেন রাজার খবর নিতে! এসে দেখলেন রাজার শরীর ঠিক আছে কিন্তু মন খুবই খারাপ! ‘তিনদিন রাজসভায় না যাওয়ার এমন কি মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে’ _তা জানতে চাইলো মহামন্ত্রী। রাজামশাই মন্ত্রীকে সব কথা খুলে বলল।
সব শুনে মহামন্ত্রী বলল – ” মহারাজ ! ঠিক আছে , কিছু জিজ্ঞাসা আপনার মনে উদয় হয়েছে – কিন্তু সেগুলোর তো উত্তর রয়েছে !”
রাজা বলল – ” বল উত্তর !”
মহামন্ত্রী বলল – ” দেখুন মহারাজ ! রাজ্যে বড় বড় পণ্ডিত রয়েছে , আমি না পারলেও কেউ না কেউ তো এর উত্তর দেবে – সুতরাং আপনি অন্তঃপুর থেকে বেড়িয়ে রাজসভায় বসুন এবং পণ্ডিতদের ডেকে পাঠিয়ে তাদের কাছে জেনে নিন জিজ্ঞাসার উত্তর ৷” মহামন্ত্রীর কথায় রাজা খুশী হোল । রাজসভায় বসে পণ্ডিতদের ডেকে পাঠাল ৷ একে একে পণ্ডিতেরা এসে রাজার তিনটি জিজ্ঞাসার উত্তর শাস্ত্র ঘেঁটে ঘেঁটে বের করে দিতে থাকল। রাজার সেসব উত্তর মোটেই মনে ধরল না। পণ্ডিতের দলকে চরম অপমান করল রাজা! বসে বসে মাইনে নিচ্ছ_আর এই তিনটে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারো না? অপমানিত হয়ে ফিরে গেল তারা! কিন্তু এতে হোল কি — নতুন করে আর কোন পণ্ডিত ভয়ে রাজসভায় আসতে চাইল না ।
মহামন্ত্রী পড়ল মহা ফাঁপড়ে – কি করে এখন ! রাজার সেই এক গোঁ — জিজ্ঞাসার উত্তর না পেলে রাজকার্য্য আর হবে না ৷ মন্ত্রী রাজাকে সান্তনা দিয়ে কোন রকমে সুস্থ করে খুঁজতে বেরোলো এমন একজনকে যে এই জিজ্ঞাসাগুলির উত্তর দিতে পারবে ।
মন্ত্রী সারা রাজ্য খুঁজে এমন একজনকেও পেল না – যে রাজার মুখোমুখি হয়ে রাজাকে উত্তরগুলি বলে দেয় । রাজ্যের সীমান্তে এসে মন্ত্রী খবর পেল সেখানে জঙ্গলের মধ্যে এক বৃদ্ধ সাধুবাবা থাকে যিনি মহাজ্ঞানী এবং একজন যোগী । দীর্ঘদিন একা একা জঙ্গলের মধ্যে একটি কুঠিয়ায় থেকে সাধন ভজন করেন আর কোন মানুষ তার কাছে কোন সমস্যা নিয়ে গেলে তিনি সমাধান করে দেন ৷ মন্ত্রী অতি ব্যাগ্রতা সহকারে সেই সাধুবাবার কাছে গেল – তার সমস্যার কথা সবিস্তারে সাধুকে খুলে বলল । তারপর সাধুবাবাকে অনুরোধ করল যাতে তিনি মন্ত্রীর সাথে রাজসভায় গিয়ে রাজার জিজ্ঞাসার উত্তর দেন এবং রাজ্যকে সমস্যামুক্ত করেন!
কিন্তু সন্ন্যাসী বলল – ” আমি তোমার রাজার প্রজা নই যে তার হুকুম আমাকে মানতে হবে ৷ আমি তোমাদের রাজ্যের সীমানার ঠিক বাইরে বাস করি । আমি তোমাদের রাজ্যের কোন ফসল খাই না — বনের ফলমূল খাই , ঝরনার জল পান করি । কাজেই আমার কোন দায়বদ্ধতা নেই , যে তোমাদের রাজসভায় গিয়ে আমাকে রাজার মনোরঞ্জন করতে হবে ৷ যদি সত্যিই তোমাদের রাজার মনে কোন জিজ্ঞাসার উদয় হয় — তাহলে তাকে গিয়ে বোলো যেন এখানে এসে তার মীমাংসা করে নিয়ে যায়! ”
মন্ত্রী তখন ভয় দেখালো , বলল – ” জানেন , আমি আপনার কি করতে পারি ?” সাধু হেসে বলল – ” মাথা কাটতে পারো ; তাহলে সেটাই কেটে তোমাদের রাজার কাছে নিয়ে যাও! কিন্তু কাটা মাথা তো কথা বলতে পারে না! সেক্ষেত্রে তোমাদের রাজার জিজ্ঞাসার উত্তর দেবে কে ?” মন্ত্রী ভেবে দেখল – সত্যিই তো , একে তো মারা চলবে না , রাজাকেই নিয়ে আসতে হবে ৷
মন্ত্রী সাধুবাবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল রাজ্যে। রাজাকে সব কথা খুলে বলল ৷ রাজা সব শুনে রেগে গিয়ে বলল – “সেই বেয়াদবকে বেঁধে আনতে পারলে না ?
মন্ত্রী বলল – ” মহারাজ ! যে সাধু প্রাণের তোয়াক্কা করে না বরং প্রাণনাশের কথায় হাসে – তাকে চাপ দিয়ে কাজ আদায় করা যাবে না ৷ আপনাকেই যেতে হবে তার কাছে ।”
রাজার জিজ্ঞাসার উত্তর চাই ৷ যে কোন মূল্যে তার মনের বোঝা হালকা করতেই হবে , না হলে শরীর খারাপ হচ্ছে , রাজকার্য্য মাথায় উঠেছে , এভাবে তো চলতে পারে না — তাই রাজী হল রাজা!
মন্ত্রী পরামর্শ দিল, “মহারাজ ! সেই স্থান অনেক দূর ! রাজ্যের সীমান্তে সাধুর কুটির ৷ তাই খুব ভোরে ছদ্মবেশে দুজনে বেরিয়ে যাবো , যাতে কাক-পক্ষীতে টের টি না পায় !”
যেমন কথা তেমনি কাজ ! রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই দুজনে সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়ল সেই সাধুবাবার আশ্রমের উদ্দেশ্যে । দীর্ঘপথ পেড়িয়ে ওরা যখন সাধুর কুটিরের কাছে পৌঁছালো তখন বেলা দ্বিপ্রহর । গ্রীষ্মের দুপুর — চরম দবদাহ , তবে জায়গাটি জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় একটু আধটু ছায়া আছে ৷ রাজা ও মন্ত্রী দেখল একটা বাঁশের বেড়া দেওয়া ঘেরা স্থানে সাধুবাবার কুটির ৷ ছদ্মবেশী রাজা অর্গল (আগুড়) ঠেলে বেড়ার ভেতরে ঢুকতেই দেখল শীর্ণকায় জটা-দাড়ি সমন্বিত এক বৃদ্ধ কুটির প্রাঙ্গনে একটা গর্ত খুঁড়ছে ৷ … [ক্রমশঃ]
সকাল বেলায় রাজা আর রাজসভায় গেল না, শুধু ঐ তিনটি প্রশ্নের উত্তর ভেবে যাচ্ছে৷ মন্ত্রী-সভাসদরা সবাই রাজার অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে সভা ভেঙে যার যার কাজে চলে গেল। পরের দিনও রাজামশাই ভাবনার জগতে এমনভাবে ডুবে রইলেন যে, সেদিন ও রাজসভায় যাওয়া হোল না। এইভাবে তিন দিন কেটে যাবার পর যখন রাজ্যপাট লাটে উঠতে বসেছে, তখন মহামন্ত্রী রাজঅন্তঃপুরে এলেন রাজার খবর নিতে! এসে দেখলেন রাজার শরীর ঠিক আছে কিন্তু মন খুবই খারাপ! ‘তিনদিন রাজসভায় না যাওয়ার এমন কি মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে’ _তা জানতে চাইলো মহামন্ত্রী। রাজামশাই মন্ত্রীকে সব কথা খুলে বলল।
সব শুনে মহামন্ত্রী বলল – ” মহারাজ ! ঠিক আছে , কিছু জিজ্ঞাসা আপনার মনে উদয় হয়েছে – কিন্তু সেগুলোর তো উত্তর রয়েছে !”
রাজা বলল – ” বল উত্তর !”
মহামন্ত্রী বলল – ” দেখুন মহারাজ ! রাজ্যে বড় বড় পণ্ডিত রয়েছে , আমি না পারলেও কেউ না কেউ তো এর উত্তর দেবে – সুতরাং আপনি অন্তঃপুর থেকে বেড়িয়ে রাজসভায় বসুন এবং পণ্ডিতদের ডেকে পাঠিয়ে তাদের কাছে জেনে নিন জিজ্ঞাসার উত্তর ৷” মহামন্ত্রীর কথায় রাজা খুশী হোল । রাজসভায় বসে পণ্ডিতদের ডেকে পাঠাল ৷ একে একে পণ্ডিতেরা এসে রাজার তিনটি জিজ্ঞাসার উত্তর শাস্ত্র ঘেঁটে ঘেঁটে বের করে দিতে থাকল। রাজার সেসব উত্তর মোটেই মনে ধরল না। পণ্ডিতের দলকে চরম অপমান করল রাজা! বসে বসে মাইনে নিচ্ছ_আর এই তিনটে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারো না? অপমানিত হয়ে ফিরে গেল তারা! কিন্তু এতে হোল কি — নতুন করে আর কোন পণ্ডিত ভয়ে রাজসভায় আসতে চাইল না ।
মহামন্ত্রী পড়ল মহা ফাঁপড়ে – কি করে এখন ! রাজার সেই এক গোঁ — জিজ্ঞাসার উত্তর না পেলে রাজকার্য্য আর হবে না ৷ মন্ত্রী রাজাকে সান্তনা দিয়ে কোন রকমে সুস্থ করে খুঁজতে বেরোলো এমন একজনকে যে এই জিজ্ঞাসাগুলির উত্তর দিতে পারবে ।
মন্ত্রী সারা রাজ্য খুঁজে এমন একজনকেও পেল না – যে রাজার মুখোমুখি হয়ে রাজাকে উত্তরগুলি বলে দেয় । রাজ্যের সীমান্তে এসে মন্ত্রী খবর পেল সেখানে জঙ্গলের মধ্যে এক বৃদ্ধ সাধুবাবা থাকে যিনি মহাজ্ঞানী এবং একজন যোগী । দীর্ঘদিন একা একা জঙ্গলের মধ্যে একটি কুঠিয়ায় থেকে সাধন ভজন করেন আর কোন মানুষ তার কাছে কোন সমস্যা নিয়ে গেলে তিনি সমাধান করে দেন ৷ মন্ত্রী অতি ব্যাগ্রতা সহকারে সেই সাধুবাবার কাছে গেল – তার সমস্যার কথা সবিস্তারে সাধুকে খুলে বলল । তারপর সাধুবাবাকে অনুরোধ করল যাতে তিনি মন্ত্রীর সাথে রাজসভায় গিয়ে রাজার জিজ্ঞাসার উত্তর দেন এবং রাজ্যকে সমস্যামুক্ত করেন!
কিন্তু সন্ন্যাসী বলল – ” আমি তোমার রাজার প্রজা নই যে তার হুকুম আমাকে মানতে হবে ৷ আমি তোমাদের রাজ্যের সীমানার ঠিক বাইরে বাস করি । আমি তোমাদের রাজ্যের কোন ফসল খাই না — বনের ফলমূল খাই , ঝরনার জল পান করি । কাজেই আমার কোন দায়বদ্ধতা নেই , যে তোমাদের রাজসভায় গিয়ে আমাকে রাজার মনোরঞ্জন করতে হবে ৷ যদি সত্যিই তোমাদের রাজার মনে কোন জিজ্ঞাসার উদয় হয় — তাহলে তাকে গিয়ে বোলো যেন এখানে এসে তার মীমাংসা করে নিয়ে যায়! ”
মন্ত্রী তখন ভয় দেখালো , বলল – ” জানেন , আমি আপনার কি করতে পারি ?” সাধু হেসে বলল – ” মাথা কাটতে পারো ; তাহলে সেটাই কেটে তোমাদের রাজার কাছে নিয়ে যাও! কিন্তু কাটা মাথা তো কথা বলতে পারে না! সেক্ষেত্রে তোমাদের রাজার জিজ্ঞাসার উত্তর দেবে কে ?” মন্ত্রী ভেবে দেখল – সত্যিই তো , একে তো মারা চলবে না , রাজাকেই নিয়ে আসতে হবে ৷
মন্ত্রী সাধুবাবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল রাজ্যে। রাজাকে সব কথা খুলে বলল ৷ রাজা সব শুনে রেগে গিয়ে বলল – “সেই বেয়াদবকে বেঁধে আনতে পারলে না ?
মন্ত্রী বলল – ” মহারাজ ! যে সাধু প্রাণের তোয়াক্কা করে না বরং প্রাণনাশের কথায় হাসে – তাকে চাপ দিয়ে কাজ আদায় করা যাবে না ৷ আপনাকেই যেতে হবে তার কাছে ।”
রাজার জিজ্ঞাসার উত্তর চাই ৷ যে কোন মূল্যে তার মনের বোঝা হালকা করতেই হবে , না হলে শরীর খারাপ হচ্ছে , রাজকার্য্য মাথায় উঠেছে , এভাবে তো চলতে পারে না — তাই রাজী হল রাজা!
মন্ত্রী পরামর্শ দিল, “মহারাজ ! সেই স্থান অনেক দূর ! রাজ্যের সীমান্তে সাধুর কুটির ৷ তাই খুব ভোরে ছদ্মবেশে দুজনে বেরিয়ে যাবো , যাতে কাক-পক্ষীতে টের টি না পায় !”
যেমন কথা তেমনি কাজ ! রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই দুজনে সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়ল সেই সাধুবাবার আশ্রমের উদ্দেশ্যে । দীর্ঘপথ পেড়িয়ে ওরা যখন সাধুর কুটিরের কাছে পৌঁছালো তখন বেলা দ্বিপ্রহর । গ্রীষ্মের দুপুর — চরম দবদাহ , তবে জায়গাটি জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় একটু আধটু ছায়া আছে ৷ রাজা ও মন্ত্রী দেখল একটা বাঁশের বেড়া দেওয়া ঘেরা স্থানে সাধুবাবার কুটির ৷ ছদ্মবেশী রাজা অর্গল (আগুড়) ঠেলে বেড়ার ভেতরে ঢুকতেই দেখল শীর্ণকায় জটা-দাড়ি সমন্বিত এক বৃদ্ধ কুটির প্রাঙ্গনে একটা গর্ত খুঁড়ছে ৷ … [ক্রমশঃ]