শৈব সম্প্রদায়ের সাধকদের সাধনের একটা অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে –মুখে পঞ্চাক্ষর শিবমন্ত্র(ওঁ নমঃ শিবায় – শিবায় নমঃ ওঁ) জপ করতে করতে বেনারসের (কাশী) ঘাট থেকে গঙ্গার জল ভরে নিয়ে পদব্রজে হাজার হাজার মাইল পথ হেঁটে দক্ষিণ ভারতের শেষপ্রান্তে রামেশ্বরমের শিবের মাথায় সেই জল ঢালা , আবার সেখান থেকে সাগরের জল ভরে আবার কাশী বিশ্বনাথের মাথায় ঢালা – অথবা উল্টোটা ৷ সাধু-সন্ত ছাড়া এই কষ্টকর সংকল্প সিদ্ধ করতে প্রায়শ-ই কেউ পারে না । এইরকম একটি সাধকের সংকল্প সিদ্ধির গল্প সেদিন গুরুমহারাজ বলেছিলেন। অবশ্যই এটি বহুকাল পূর্বের ঘটনা!
“একজন দক্ষিণ ভারতের শৈব সাধু রামেশ্বরের পূজো দিয়ে ওখান থেকে জল ভরে দীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে কাশী বিশ্বনাথে পৌঁছালো এবং সেখানে শিবের মাথায় জল ঢেলে প্রাণ ভরে পূজো করে পুনরায় গঙ্গার জল কলসীতে ভরে হাঁটতে শুরু করল রামেশ্বরমের দিকে! এই পরিক্রমায় প্রায় ৫/৬ মাস লেগে যায় , আর খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পা কেটে-ছিঁড়ে যায় , পায়ে ঘা হয়ে যায়! তাছাড়া সাধনার শর্ত অনুযায়ী সাধকের মাথায় থাকা ওই জলের কলসী সে মাটিতে নামাতে পারে না , কোন গাছের কোঠরে রাখতে পারলে রাখে, অন্যথায় মাথায় নিয়েই খাওয়া-দাওয়া করে , বিশ্রাম নেয় ৷ শুধু স্নান-পায়খানা করার সময় কোন বৃক্ষে ঝুলিয়ে রাখে বা কোঠরে রাখে ।
যাইহোক , এইভাবে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তিনি প্রায় পৌঁছে গেলেন রামেশ্বরমে । দূর থেকে রামেশ্বর মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে , ক্লান্ত-পথশ্রান্ত ভক্তটির দুটি পায়েই ঘা হয়ে গেছে । যতই যাত্রার শেষের দিক – ততই শক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে তাঁর শরীর – তবু টেনে টেনে চলা !
মন্দিরের চূড়া দেখা যেতেই ভক্তের শরীরে যেন নতুন জোর এসে গেল ৷ সে স্থির করল সন্ধ্যার পূর্বেই পৌঁছে যাবে মন্দিরে, যাতে পূজারীরা সান্ধ্যপূজা শেষ করে চলে যাবার আগেই সে পৌঁছাতে পারে । কষ্টে-সৃষ্টে যতটা সম্ভব অতিদ্রুত আগাতে আগাতে সামনে পড়ল একটা নদীর মতো জলাশয় ৷ যেটা পার হয়ে রামেশ্বর মন্দিরে পৌঁছানো যাবে!
সেখানে নৌকা পারাপারের ব্যাবস্থা রয়েছে কিন্তু সেই মুহূর্ত্তে ঐ ভক্তটি কাউকে কোথাও দেখতে পেল না ৷ ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে গেল ৷ ভক্তবর আর কি করে , সেই বেনারসের গঙ্গার জলসমেত ঘটটি মাথায় নিয়ে একটা গাছের তলায় শিবনাম জপ করতে লাগল আর প্রভুকে জানাতে লাগল – ” প্রভু ! এ তোমার কি পরীক্ষা ! এত পথ পেড়িয়ে এসে শুধু দোড়গোড়ায় আটকে দিলে ? ভক্তের উপর তোমার কি এতটুকুও মায়া হচ্ছে না মহাদেব ! তুমি তো আশুতোষ ! অল্পে সন্তুষ্ট হও – তাহলে এত কষ্টের , এত কৃচ্ছসাধনের পরও কি তুমি তুষ্ট হলে না !!” চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মহাদেবকে স্মরণ করতে করতেই ঊষার আলো ফুটে উঠল পূর্ব দিগন্তে ৷ ভক্তপ্রবর তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়েই হাঁটা লাগাল জলাশয়ের দিকে ৷ মাঝি এসে পৌঁছালেই তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে ওপারে আর মহাদেবের মাথায় ঢালবে সুদূর কাশীর গঙ্গা থেকে আনা ভক্তি-মিশ্রিত গঙ্গাবারি । তখনও মাঝি এসে পৌঁছায়নি — অপেক্ষার প্রহর গোনা । এমন সময় হঠাৎ একটি রোগাক্রান্ত মুমূর্ষ গাধা সেখানে এসে হাজির ! আর সেখানে পৌঁছেই ধরাস্ করে সাধুর পায়ের কাছে পড়ে গেল গাধাটি এবং হাঁপাতে হাঁপাতে তার জিভ এতখানি বেরিয়ে গেল! একটুখানি জলের জন্য তৃষ্ণার্ত , মৃত্যুপথযাত্রী গাধাটি জিভটা বারবার বের করছে আর করুণভাবে তাকিয়ে আছে সাধুর দিকে !
সাধু পড়ল চরম সংকটে ! কি করে ? এতদিনের সাধনা , এত শ্রম , সংকল্প সিদ্ধির দোরগোড়ায় এসে কি সে সংকল্প থেকে বিচ্যুত হবে ? অথবা মুমূর্ষ মৃত্যুপথযাত্রী গাধাটিকে জল খাইয়ে তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করবে ?
হটাৎ শৈবসাধুর মনে পড়ল মহাজন বাক্য – ” যত্র জীবঃ তত্র শিবঃ”। ব্যস্ , আর কোন চিন্তা না করে সাধুটি মাথার কলসী নামিয়ে হাতে করে নিয়ে গেল গাধার কাছে এবং তার মুখের উপর কলসীটি ধরে “ওঁ নমঃ শিবায়” বলতে বলতে ঢালতে লাগল জল! তারপর ??????
তারপর যখন তার সমস্ত জল শেষ হয়ে গেল — তখন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে যে সাক্ষাৎ মহাদেব সেখানে বসে আর তার ঢালা সমস্ত জলে সঞ্চিত হচ্ছে মহাদেবের জটা!!
আনন্দে অধীর হয়ে ভক্তপ্রবর মূর্ত্ত মহেশ্বরের চরণ বন্দনা করল , চোখের জলে তাঁর পা ধুইয়ে দিল! আশুতোষ মহাদেব বললেন – ” তোর কষ্ট দেখে নিজেই চলে এলাম তোর জল নিতে! ” তার উপর ভগবান শিবের এত করুণা দেখে চোখের জলে ভেসে যেতে থাকল ভক্তটি!
এত আনন্দের মধ্যেও ভক্তের মনে উদয় হোল একটি জিজ্ঞাসার এবং সে সেই জিজ্ঞাসা নিবেদন করল _ভগবান শিবের কাছে , ” প্রভু আপনি ছলনা করে মুমূর্ষ গাধার রূপ ধরে এলেন কেন ? যদি আমার ভুল হোত , যদি আমি সামান্য গাধা ভেবে অগ্রাহ্য করতাম ?”
মহাদেব স্মিত হেসে বললেন – ” লীলা আমি তার সাথেই করি – যে উপযুক্ত ! তোর মনে এতটুকু সংশয় ছিল যে , যেকোন ‘জীব’ কি ‘শিব’ হতে পারে ? তাই এই নিকৃষ্ট জীব রূপে এসে তোর ভ্রম কাটানো হ’ল ৷” মূর্ত্ত মহেশ্বর অন্তর্হিত হতেই শিবভক্তটি সেখানেই সমাধিস্থ হয়ে গেল ও সাধনায় সিদ্ধ হলো ৷” [ক্রমশঃ]