মহারাষ্ট্রের এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করত। কিন্তু কোন কারনে এই পরিবারটি সমাজে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিল। ফলে তারা সমাজে অব্রাহ্মনের ন্যায় থাকতো। তখনকার দিনে অব্রাহ্মণ বা নিম্নশ্রেণীর লোকেরা সমাজে অচ্ছুত ছিল – তারা মন্দিরে প্রবেশ করতে পারত না , সামাজিক অনেক সুযোগ-সুবিধা পেতোনা বরং অবহেলা , লাঞ্ছনার শিকার হতো ৷ এইরকম সামাজিক পরিবেশে ঐ পরিবারে একে একে তিনটি পুত্রসন্তান এবং একটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। ঐ শিশুসন্তানেরা ছোট থাকতে থাকতেই ওদের পিতা এবং মাতা উভয়েই মারা যায় ৷ ফলে দরিদ্র পরিবারের ঐ কয়টি শিশু একেবারে অনাথ এবং অসহায় হয়ে পড়ল । কিন্তু এই বালক-বালিকাদের মধ্যে এমন কিছু অসাধারণ বিশেষত্ব ছিল, যা তাদের প্রতিবেশী বা স্থানীয় জনগণকে তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করতে বাধ্য করেছিল!
এদের মধ্যে মাঝের ভাইটি ছিল জ্ঞানদেব বা জ্ঞানেশ্বর ৷ বাকী দুজনও অসামান্য প্রতিভাধর হলেও জ্ঞানদেবের প্রতিভার কোন সীমা-পরিসীমা ছিল না ৷ এমন কথিত আছে যে মাত্র ১০ বছর বয়সে তার বেদজ্ঞান সম্পূর্ণ হয়ে যায় এবং ১২ বছর বয়সে তার বিখ্যাত গ্রন্থ জ্ঞানেশ্বরী গীতা রচনা করেন (কিন্তু ঐতিহাসিক গবেষণায় পাওয়া যায় উনি ১৯-বছর বয়সে গীতা-ভাষ্যটি রচনা করেন)!
স্থানীয়রা ওই তিনভাই ও একবোনকে ব্রহ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বর ও জগদম্বার অবতার বলে মান্য করতো! কি করে মানুষের মনে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হোল তার ঘটনাটা বলা হচ্ছে। একদিন তিন ভাই ও বোন ঘুরতে ঘুরতে কোন স্থানের একটি বিষ্ণুমন্দিরের ভিতরে ঢুকে পড়েছিল – যেটা তৎকালীন যুগে অন্যায় বলে বিবেচিত হোত কারণ যেহেতু সমাজে তারা অব্রাহ্মণ হিসাবে পরিগনিত ছিল! ফলে পূজারী ও মন্দিরের কর্মচারীদের মধ্যে কোলাহল পড়ে গেল! কেউ কেউ মারতে উদ্যত হল , কেউ বলল দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাইরে পাঠান হোক – ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু ঠিক সেই সময়েই একটা ঘটনা ঘটে গেল! প্রতিদিন মন্দিরের পোষা হাতি ঠাকুর পূজার মালা দেবতাকে বা প্রধান পুরোহিতকে পড়িয়ে দিয়ে তাকে বরণ করতো!
সেদিন কি ঘটল ,__ মন্দিরের দীর্ঘদিনের পোষমানা হাতি পূজার বিশেষ মালা নিয়ে ঠাকুরকে না পড়িয়ে _বালক জ্ঞানদেবের গলায় পড়িয়ে দিল! সবাই তো “রে রে” করে উঠল । কিন্তু প্রধান পুরোহিত সকলকে নিরস্ত করে বললেন — “এই অঘটন যখন ঘটল তখন নিশ্চই এর পিছনে কোন আধ্যাত্মিক রহস্য রয়েছে ।”
তাঁর কথায় সবাই সাময়িকভাবে চুপ করে গেল বটে কিন্তু অন্যান্য পুরোহিতরা, বালক- জ্ঞানেশ্বরকে ছাড়ল না । বলল , “এই যে বালক ! শুনেছি তুমি নাকি বেদ-জ্ঞানী বলে নিজেকে জাহির করো ! বলো তো বাছা বেদের দু-চারটে শ্লোক ?” বালক জ্ঞানেশ্বর একটুও বিচলিত না হয়ে বলে উঠল , ” আপনারা আমার মুখ থেকে বেদের শ্লোক তো শুনতেই পারেন –কিন্তু ঈশ্বরের যদি ইচ্ছা হয়, তাহলে ওই যে মন্দির প্রাঙ্গণে মোষ বাঁধা রয়েছে(মন্দির প্রাঙ্গণে কোন ভক্ত হয়তো কোন কারনে দেবতার কাছে একটি মোষ দেবার মানত করেছিল),_ ওর মুখ থেকেও বৈদিক শ্লোক বেরোতে পারে !”__ এই কথা বলে জ্ঞানদেব মোষটির কাছে গিয়ে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলেন – ” হে মহিষ ! মন্দিরের পূজারীদের একটু বেদের শ্লোক/মন্ত্র শোনাও তো !”
উপস্থিত সকলকে হতবাক করে দিয়ে মন্দিরের বাঁধা মোষ সকলের সামনে একটার পর একটা বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করল! সুললিত ছন্দে বৈদিক শ্লোক উচ্চারিত হতে লাগল মোষের মুখ থেকে! সেই থেকে জ্ঞানদেব বা তাঁর ভাই-বোনেরা যে আধ্যাত্মিকভাবে খুবই উন্নত _সে কথা জনসাধারণ জেনে গেল। এরপর থেকে ওনাদের উপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছিল !
যাইহোক, এরপর ওনারা পুন্ডরপুরের বিটঠল মন্দিরে এসে ওঠেন এবং সেখান থেকেই পুন্ডরীকের ভক্তিভাব এবং নাথ-যোগীদের যোগমার্গের সমন্বয় ঘটিয়ে _একটি সহজ-সরল সাধন পদ্ধতি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন।
খুব বেশীদিন শরীরে ছিলেন না এই ভাইবোনেরা । কিন্তু তৎকালীন সমাজে উচ্চবর্ণের লোকেদের_ নিম্নবর্ণের মানুষজনের প্রতি যে অত্যাচার ও অনাচার ছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন। সমাজের অবহেলিতদের কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে শরীর ধারণ করেছিলেন জ্ঞানদেব এবং তার বোন ও ভাইয়েরা ! এই পরম্পরায় পরবর্তী কালে মহারাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন মহাপুরুষ, ওখানকার সমাজে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেছিলেন। এদের মধ্যে নামদেব, তুকারাম, একনাথ প্রমূখরা উল্লেখযোগ্য। জ্ঞানদেব বিরচিত – “জ্ঞানেশ্বরী গীতা” পাঠ করলে তাঁর অসাধারণ জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় । বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে “জ্ঞানেশ্বরী গীতা” পুস্তকটি রয়েছে ৷ গুরু মহারাজ উপস্থিত অনেককে বইটি পড়ার জন্য বললেন । [ক্রমশঃ]
এদের মধ্যে মাঝের ভাইটি ছিল জ্ঞানদেব বা জ্ঞানেশ্বর ৷ বাকী দুজনও অসামান্য প্রতিভাধর হলেও জ্ঞানদেবের প্রতিভার কোন সীমা-পরিসীমা ছিল না ৷ এমন কথিত আছে যে মাত্র ১০ বছর বয়সে তার বেদজ্ঞান সম্পূর্ণ হয়ে যায় এবং ১২ বছর বয়সে তার বিখ্যাত গ্রন্থ জ্ঞানেশ্বরী গীতা রচনা করেন (কিন্তু ঐতিহাসিক গবেষণায় পাওয়া যায় উনি ১৯-বছর বয়সে গীতা-ভাষ্যটি রচনা করেন)!
স্থানীয়রা ওই তিনভাই ও একবোনকে ব্রহ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বর ও জগদম্বার অবতার বলে মান্য করতো! কি করে মানুষের মনে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হোল তার ঘটনাটা বলা হচ্ছে। একদিন তিন ভাই ও বোন ঘুরতে ঘুরতে কোন স্থানের একটি বিষ্ণুমন্দিরের ভিতরে ঢুকে পড়েছিল – যেটা তৎকালীন যুগে অন্যায় বলে বিবেচিত হোত কারণ যেহেতু সমাজে তারা অব্রাহ্মণ হিসাবে পরিগনিত ছিল! ফলে পূজারী ও মন্দিরের কর্মচারীদের মধ্যে কোলাহল পড়ে গেল! কেউ কেউ মারতে উদ্যত হল , কেউ বলল দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাইরে পাঠান হোক – ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু ঠিক সেই সময়েই একটা ঘটনা ঘটে গেল! প্রতিদিন মন্দিরের পোষা হাতি ঠাকুর পূজার মালা দেবতাকে বা প্রধান পুরোহিতকে পড়িয়ে দিয়ে তাকে বরণ করতো!
সেদিন কি ঘটল ,__ মন্দিরের দীর্ঘদিনের পোষমানা হাতি পূজার বিশেষ মালা নিয়ে ঠাকুরকে না পড়িয়ে _বালক জ্ঞানদেবের গলায় পড়িয়ে দিল! সবাই তো “রে রে” করে উঠল । কিন্তু প্রধান পুরোহিত সকলকে নিরস্ত করে বললেন — “এই অঘটন যখন ঘটল তখন নিশ্চই এর পিছনে কোন আধ্যাত্মিক রহস্য রয়েছে ।”
তাঁর কথায় সবাই সাময়িকভাবে চুপ করে গেল বটে কিন্তু অন্যান্য পুরোহিতরা, বালক- জ্ঞানেশ্বরকে ছাড়ল না । বলল , “এই যে বালক ! শুনেছি তুমি নাকি বেদ-জ্ঞানী বলে নিজেকে জাহির করো ! বলো তো বাছা বেদের দু-চারটে শ্লোক ?” বালক জ্ঞানেশ্বর একটুও বিচলিত না হয়ে বলে উঠল , ” আপনারা আমার মুখ থেকে বেদের শ্লোক তো শুনতেই পারেন –কিন্তু ঈশ্বরের যদি ইচ্ছা হয়, তাহলে ওই যে মন্দির প্রাঙ্গণে মোষ বাঁধা রয়েছে(মন্দির প্রাঙ্গণে কোন ভক্ত হয়তো কোন কারনে দেবতার কাছে একটি মোষ দেবার মানত করেছিল),_ ওর মুখ থেকেও বৈদিক শ্লোক বেরোতে পারে !”__ এই কথা বলে জ্ঞানদেব মোষটির কাছে গিয়ে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলেন – ” হে মহিষ ! মন্দিরের পূজারীদের একটু বেদের শ্লোক/মন্ত্র শোনাও তো !”
উপস্থিত সকলকে হতবাক করে দিয়ে মন্দিরের বাঁধা মোষ সকলের সামনে একটার পর একটা বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করল! সুললিত ছন্দে বৈদিক শ্লোক উচ্চারিত হতে লাগল মোষের মুখ থেকে! সেই থেকে জ্ঞানদেব বা তাঁর ভাই-বোনেরা যে আধ্যাত্মিকভাবে খুবই উন্নত _সে কথা জনসাধারণ জেনে গেল। এরপর থেকে ওনাদের উপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছিল !
যাইহোক, এরপর ওনারা পুন্ডরপুরের বিটঠল মন্দিরে এসে ওঠেন এবং সেখান থেকেই পুন্ডরীকের ভক্তিভাব এবং নাথ-যোগীদের যোগমার্গের সমন্বয় ঘটিয়ে _একটি সহজ-সরল সাধন পদ্ধতি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন।
খুব বেশীদিন শরীরে ছিলেন না এই ভাইবোনেরা । কিন্তু তৎকালীন সমাজে উচ্চবর্ণের লোকেদের_ নিম্নবর্ণের মানুষজনের প্রতি যে অত্যাচার ও অনাচার ছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন। সমাজের অবহেলিতদের কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে শরীর ধারণ করেছিলেন জ্ঞানদেব এবং তার বোন ও ভাইয়েরা ! এই পরম্পরায় পরবর্তী কালে মহারাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন মহাপুরুষ, ওখানকার সমাজে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেছিলেন। এদের মধ্যে নামদেব, তুকারাম, একনাথ প্রমূখরা উল্লেখযোগ্য। জ্ঞানদেব বিরচিত – “জ্ঞানেশ্বরী গীতা” পাঠ করলে তাঁর অসাধারণ জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় । বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে “জ্ঞানেশ্বরী গীতা” পুস্তকটি রয়েছে ৷ গুরু মহারাজ উপস্থিত অনেককে বইটি পড়ার জন্য বললেন । [ক্রমশঃ]