গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) অসাধারণ মজার মানুষ , রসিক মানুষ ছিলেন । যখন তিনি মজা করতেন তখন নিজে হেসে , সকলকে হাসিয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন! তিনি যখন গম্ভীর বা ভারিক্কী অবস্থায় থাকতেন তখন যেমন কারো সাধ্য হোত না তাঁর সাথে কোন কথা বলার , তেমনি যখন তিনি হালকা মেজাজে থাকতেন তখন যে কেউ তাঁর সাথে মজা করতে পারতো । অনেক সময় তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ কাউকে (বনগ্রামের নগেন মন্ডল , দূর্গাপুরের ব্যানার্জীবাবু , বরশুলের ভন্টেদা ইত্যাদি) উঠে দাঁড়িয়ে কোন মজার ঘটনা বলতে বলতেন বা গান গাইতে বলতেন । তারা মজা করে সেটি পরিবেশন করতে শুরু করলেই গুরু মহারাজ বাচ্ছা ছেলের মতো হেসে গড়িয়ে পড়তেন! তার মুখ চোখ লাল হয়ে যেতো! উপস্থিত জনেরাও হাসতো , উনিও হাসতেন! আর উপস্থিত জনেরা সেই আনন্দময় পুরুষের অনাবিল আনন্দের হাসি প্রত্যক্ষ করে ধন্য হোত । সেইরকম দু-একটা মজার গল্প আগে বলা হয়েছে – এখানে আরও কয়েকটা বলা হচ্ছে!
___এক জায়গায় একবার একটা পানকৌড়ির সাথে একটা বকের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল । দুজনেই জলাশয়ে থাকে, দুজনেই খাদ্য অন্বেষনে ব্যস্ত থাকে! তবু ঐ ব্যস্ততার মধ্যে কিছু কথাবার্ত্তা হত – এইরকম বন্ধুত্ব আর কি ! যাইহোক সেবার গ্রীষ্মকালে খাল বিলের জল এমনভাবে শুকিয়ে গেল যে একমাত্র বড় জলাশয় ছাড়া !
বক যে অঞ্চলে থাকতো সেখানে বড় জলাশয় ছিল না , তাছাড়া বড় জলাশয়ে বকের শিকার পদ্ধতি অচল , অল্পজলে বকের শিকার পদ্ধতি কার্য্যকরী ৷ তাই বকের অনশন অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠল । এমতাবস্থায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল বন্ধুবর পানকৌড়ি! সে বলল যে সে অনেক বড় বড় জলাশয়ের সন্ধান জানে , সেখানে গেলে বকের খাবার অভাব হবে না ৷ কিন্তু গভীর জলাশয়ে সে মাছ ধরবে কি করে – ? এর উত্তরে পানকৌড়ি জানাল যে কোন চিন্তা নাই , সে জলের গভীরে ডুবে ডুবে মাছ ধরে নিয়ে আসবে আর দুজনায় মিলে ঐ মাছ ভাগ করে খাবে।
যেমনি কথা তেমনি কাজ! ওরা দুজনে চলে গেল সেই জলাশয়ের তীরে। রোজ রোজ পানকৌড়ি গভীর জল থেকে মাছ ধরে ধরে নিয়ে আসে আর দুজনে মিলে খায় ৷
এইভাবে চলতে থাকল বেশ কয়েক মাস । তারপর আবার এসে গেল বর্ষাকাল! ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরার সাথে সাথে খালে, বিলে, মাঠে-ঘাটে জল থৈ থৈ করতে লাগল ৷ আর সেই তিরতিরে জলে খেলা করতে লাগল ছোট ছোট মাছ । বক কল্পনার দৃষ্টিতে সেই সব দেখতে থাকে আর ছটফট করে ৷ পানকৌড়ির নজরে পড়ল ব্যাপারটা! জিজ্ঞাসা করল – ব্যাপারটা কি ? বক বলল তার আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না , তাই সে চলে যেতে চায় তার পুরানো জায়গায় । পানকৌড়ি বলল , ” ও আচ্ছা ! চারিদিকে বৃষ্টি হচ্ছে , তোমার ওখানে মাঠে-ঘাটে জল হয়েছে , মাছ হয়েছে – তাই যেতে চাও তো ? তাহলে যাও !” বক উপহাসির হাসি হেসে বলে উঠল , ” না – না ! ওসবের জন্যে যাচ্ছি না ! তুমি বেঁটে, তোমার গায়ের রঙ কালো, তোমার মত একটা ছোটলোক পাখীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হচ্ছে — এটা আমি আর নিতে পারছি না !” পানকৌড়ি অবাকও হোল আবার খুবই মর্মাহত হ’ল । তবু জিজ্ঞাসা করল , ” কিন্তু ওই সব দেখেই তো তুমি আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলে! ওগুলো তো আসল কারণ নয় ?সত্যি সত্যি বলোতো আমার ক্রটিটা কোথায় ? কি দোষে তুমি আমায় পরিত্যাগ করে যাচ্ছ ?”
তখন বক চিন্তা ভাবনা করে _একটা কারণ ভেবে নিয়ে বলল , ” তাহলে শোন! তুমি যখন জলে ডুব দাও , তখন তোমার পিছনটা কেমন বেঁকে যায় !” বকের কথা শুনে ম্লান হেসে পানকৌড়ি বলল , “বন্ধু ! তুমি তো যাবেই ! এটা তুমি মনস্থ করেই ফেলেছ । শুধু শুধু আমার শরীরের পিছন অংশের(গুরুজী অঙ্গটির ডাকনামটাই বলেছিলেন, আর সেটা শুনে সকলের সে কি হাসি!) দোষ দিয়ে আর যাওয়া কেন ?
গুরু মহারাজ গল্পটা শেষ করে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন –” দ্যাখো, বেশিরভাগ মানুষও কিন্তু এমনি! এটা মানুষের একটা স্বভাব! প্রয়োজনে মানুষ অপরের কাছ থেকে সাহায্য নেয় , তার কাছে ছোট হয় _যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না! তারপর প্রয়োজন মিটে গেলে , নিজের কাজ গুছিয়ে নিয়ে উপকারীর উপকার ভুলে যায়। আর শুধু ভুলেই যায় না , তাকে অপ্রয়োজনে অপমান করতেও ভোলে না!” [ক্রমশঃ]