এই গল্পটিও দুই পাখির গল্প । উপনিষদে রয়েছে এই গল্পটি! দুটি পাখি একটি বৃক্ষের ডালে বসে রয়েছে , একটি রয়েছে উঁচু ডালে অন্যটি অপেক্ষাকৃত নিচু ডালে! নিচু ডালের পাখিটি সেই গাছের বিভিন্ন ফলে মুখ দিচ্ছে – যেটি মিষ্টি, সেটি খেয়ে পাখিটি আহ্লাদ প্রকাশ করছে, আর যেটি টক সেটি খেয়ে পাখিটি দুঃখ প্রকাশ করছে! পারিপার্শ্বিক দৃশ্যাবলী দেখেও পাখিটির প্রতিক্রিয়া একইরকম , অর্থাৎ ভালো দৃশ্যের বেলায় হর্ষ প্রকাশ আর খারাপ দৃশ্য দেখে বিষাদগ্রস্ত হওয়া!
কিন্তু উপরের পাখিটির কোন প্রতিক্রিয়া নেই! সে সবকিছুই দেখেছে, কিন্তু কেমন শান্ত, ধীর-স্থির হয়ে একই জায়গায় চুপটি করে বসে আছে ৷ হর্ষ-বিষাদের কোনরকম expression-ই তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে না , কারণ ঐ পাখিটি কোন কিছুতেই আসক্ত নয়, তাই বিরক্তও নয়!
নিচের পাখিটি যখন তার ঐ একঘেয়ে জীবন যাপন থেকে মুক্ত হতে চাইল, তখন সে উপরের পাখিটির দিকে চাইল। পাখিটির এই নির্লিপ্ততার ভাব তাকে বেশ আকৃষ্ট করল! তখন সে উপরের পাখিটির মত হবার চেষ্টা করতে শুরু করল!
সে একটু একটু করে উপরের ডালে উঠতে শুরু করল । আর এর ফলে তারমধ্যে যে চাঞ্চল্য ছিল তা কমতে শুরু করল ৷ তারপর নিচের পাখিটি যখনই উপরের ডালে উঠে _উপরের পাখিটির সন্নিকট হ’ল, তখন দেখা গেল দুটি নয় _ওরা দুয়ে মিলে একটিই পাখী! নিচের পাখিটি যেন উপরের পাখির প্রতিবিম্ব!!
গুরু মহারাজ গল্পটি শেষ করে সকলকে বললেন – এখানে নিচের পাখিটি জীবাত্মা ও উপরের পাখিটি পরমাত্মার প্রতীক। এই জগতের সুখ-দুঃখ , হাসি-কান্না , ভোগ-দুর্ভোগ , ভালো-মন্দ ইত্যাদি সবই বিপরীতক্রম একসাথে রয়েছে! এইজন্য পৃথিবীর আর এক নাম দেওয়া হয়েছে ‘দুনিয়া’, দুই নিয়া – দুনিয়া ৷ সাধারণ মানুষ (জীবাত্মা) এই দুই-এর মধ্যে রয়েছে তাই সে কখনো সুখ ,কখনো দুঃখ অনুভব করছে! ভোগের সামগ্রী লাভ হলে মানুষ সুখ পাচ্ছে আর তা না পেলে অথবা ভোগের সামগ্রী হাতে পেয়েও তা ভোগ করতে না পারলে সে কষ্ট পাচ্ছে , দুঃখ পাচ্ছে! উপরের গল্পের নিচের ডালে বসে থাকা পাখিটি যেমন মিষ্টি ফল খেয়ে আনন্দ করছে, আবার তেতো ফল, টক ফল খেয়ে দুঃখ পাচ্ছে _ঠিক তেমনিই!
গল্পের উপরের পাখিটি নির্বিকার! সে সাক্ষীস্বরূপ হয়ে সবকিছু অবলোকন করছে কিন্তু কোন কিছুতেই আসক্ত হচ্ছে না বা জড়িয়ে পড়ছে না! সে দ্রষ্টাবৎ , সাক্ষীবৎ থেকে যাচ্ছে! প্রতিটি মানবের শরীর বা দেহ-কেই এখানে বৃক্ষের সাথে তুলনা করা হয়েছে । উঁচু ডালে অর্থাৎ সহস্রারে পরমাত্মার অবস্থান – আর শরীরের নিচের দিকে জীবাত্মা ক্রিয়াশীল৷ মায়াগ্রস্থ, মোহগ্রস্থ, অজ্ঞান অন্ধকারে নিবদ্ধ মানুষকেই জীবাত্মা বলা হয়েছে ৷ কারণ সাধারণ মানুষের মনের ক্রিয়াশীলতা সদাসর্বদা আজ্ঞাচক্রের নিচে ৷ মন সততই নিম্নগামী , মনকে ঊর্দ্ধগামী করতে হলে প্রাণকে অবলম্বন করতে হয়! প্রাণ-ই শক্তি! এই শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে মূলাধার চক্রে সুপ্ত কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ হয় , আর শুরু হয় প্রাণের উৎক্রমন! একেই জীবের ঊর্দ্ধগতি বলা হয়েছে ৷ জীবের মধ্যে জীবাত্মার এই ঊর্দ্ধগতি যেন উজান বেয়ে রাধার কৃষ্ণ-অভিসার । সহস্রারে সহস্রদল পদ্মে অধিষ্ঠিত পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার মিলন-ই রাধাকৃষ্ণের যুগল-মিলন ৷৷ [ক্রমশঃ]