এক স্থানে এক সরোবরের ধারে একজন সাধুর আশ্রম ছিল । সেই সরোবরের অপর পারে নগরের প্রান্তে এক নগরবধূ কুটীর স্থাপন করে তার ব্যাবসা বেশ জমিয়ে ফেলল । নগরবধূ কুটীর বানানোর আগে পর্যন্ত সাধুবাবা বেশ ধ্যানজপ করে উন্নতি করছিল কিন্তু যেদিন থেকে নগরবধূর কুটীর হ’ল , সেইদিন থেকে তার ধ্যান-জপ , সাধন-ভজন মাথায় উঠল! সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের খরিদ্দাররা ঐ নগরবধূর কাছে আসে, আর সরোবরের অপর পারের আশ্রম থেকে সাধুবাবা তাদের সংখ্যা গোনে! ঐসব দেখে শুনে মনে মনে সাধুবাবা ঐ মহিলাকে ধিক্কার জানায় তার ঘৃণিত জীবনযাপনের জন্য!
এদিকে সেই নগরবধূটি কিন্তু সরোবরের অপরপারে থাকা সাধুবাবাটিকে বা তার আশ্রমকে দেখে আর মনে মনে সকাল সন্ধ্যায় প্রণাম জানায় ৷
সে ভাবে, ঐ সাধুবাবার জীবন কি পূণ্যের – অভাবের তাড়নায় তাকে এই ঘৃণিত জীবনকে বেছে নিতে হয়েছে , কিন্তু সাধুর জীবন কত পবিত্র ! এইভাবে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নগরবধূটি নিজে জঘন্য জীবনযাপন করলেও সবসময় অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হোত, আর সাধুর পবিত্র জীবনের কথা চিন্তা কোরতো!
অন্যদিকে সাধুটি আশ্রম জীবন যাপন করলেও সারাদিন ঐ নগরবধূর-ই চিন্তা কোরতো এবং তার ঘৃণিত জীবনযাপনের কথাই ভাবতো! তাছাড়া কতজন খরিদ্দার আসা-যাওয়া করছে তার সংখ্যা গুণতো , হিসাব রাখতো!
এইভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল! কিন্তু সব জিনিসেরই একটা শেষ থাকে , কালের নিয়মে সাধুবাবাটি বৃদ্ধ হ’ল , শরীর ছাড়ার সময়ও উপস্থিত হোল! এদিকে মহাকালের নিয়মে সেই একই সময়ে নগরবধূটিরও শরীর ছাড়ার সময় উপস্থিত হোল!
উভয়ের শরীর ত্যাগের পূর্ব মূহুর্ত্তে যমদূত ও বিষ্ণুদূত এসে হাজির! তবে মজার ব্যাপার হোল এই যে, বিষ্ণুদূত গেল নগরবধূর কাছে এবং যমদূত গিয়ে হাজির হ’ল সাধুবাবার কাছে!
মরনোন্মুখ সাধুবাবা যমদূতদের দেখে বিরক্ত হোল , বলল – ” বাবাদের ভূল হচ্ছে ! তোমরা সরোবরের ওপারে ঐ যে নগরবধূর কুটীর রয়েছে _ওখানে যাও! আর বিষ্ণুদূতদের এখানে পাঠিয়ে দাও!” যমদূতেরা বলল – ” ভুল আমাদের হয়নি সাধুবাবা ! ভুল হয়েছে তোমার ! যে জীবনের ব্রত তুমি গ্রহণ করেছিলে, সেই ব্রত পালনে ব্যর্থ হয়েছ তুমি! ‘মন না রাঙায়ে বসন রাঙালে, কি ভুল করিলে যোগী !!’ – তুমি গেরুয়া বসন পড়েছিলে , পূজা-পাঠ, ধ্যান-জপও করেছিলে, কিন্তু তোমার মন পড়েছিল ঐ বেশ্যালয়ে ! তাই মনের গতি তোমাকে নরকে নিয়ে যাচ্ছে ! আর ঐ নগরবধূ সারাজীবন গণিকাবৃত্তি করলেও তার মনটা সবসময় পড়ে থাকত সাধুর জীবন এবং সেই জীবনের পবিত্রতার প্রতি! প্রতিনিয়ত অনুতাপের অনলে তার সমস্ত ময়লা পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ৷ তাই ওর গতি হবে বিষ্ণুলোকে ৷ এইজন্যই বিষ্ণুদূতেরা এসেছে ওকে নিতে । আর আমরা এসেছি তোমাকে নিয়ে যেতে! সুতরাং এবার সাধুবাবা চল আমাদের সঙ্গে!”
গল্পটি বৈষ্ণবশাস্ত্রের এবং বহুল প্রচলিত । তবু কথাপ্রসঙ্গে গল্পটি বলার পর গুরু মহারাজ উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন – “শাস্ত্রে রয়েছে – ‘যাদৃশী যস্য ভাবনা সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী’ । ভাবনা-ইচ্ছা-ক্রিয়া ৷ মানুষের মনোজগতে প্রথমে ভাবনার উদয় হয় , সেই ভাবনা অনুযায়ী মানুষের কর্মে প্রবৃত্তি জন্মে এবং মানুষ তার প্রবৃত্তি অনুসারে কর্ম করে থাকে । সুতরাং এটা জানবে যে, মানুষের জীবনে ভাবনা-ই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ৷ ভালো ভাবনা মানুষকে ভালো দিকে নিয়ে যায় এবং খারাপ বা মন্দ ভাবনা মানুষের চরিত্র নষ্ট করে দেয় ৷ আর মানুষের চরিত্র একবার নষ্ট হয়ে গেলেই সেই জীবনের চরম সর্বনাশ হয়ে যায়!
সেইজন্যেই মানুষের গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে, বিবেকাশ্রিত হয়ে _ভালো এবং মন্দের বিচার করে, ভালোটিকে গ্রহন করা উচিত। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও বলতেন , “যার যেমন ভাব , তার তেমন লাভ”।৷” [ক্রমশঃ]
( সাধু ও নগরবধূ )