ঠাকুরমার ঝুলি অথবা ঠাকুরদাদার ঝুলির সেই বিখ্যাত রাজকন্যা – রাজপুত্র – জিওনকাঠি-মরনকাঠির গল্প জানে না এমন বাঙালি বোধহয় খুবই কম আছে! শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে বাঙালিসমাজে ছোটবয়সের ছেলেদের কাছে এই ধরনের গল্পের খুবই কদর! ছোটবেলায় দাদু বা ঠাকুরমার কোলে বসে বা ঘুমপাড়ানি রসদ হিসাবে রুপকথার গল্পের এখনও খুবই চল রয়েছে!
কিন্তু এই সব মজার মজার ছেলেভুলানো গল্পগুলির মধ্যেও যে আধ্যাত্মিক রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তা বোধহয় এই গল্পের সংকলকের ও জানা ছিল না!
সেদিন বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে পড়ন্ত বেলায় গুরুমহারাজ, মানবজীবনে__ সাধুসঙ্গ-সৎসঙ্গের প্রয়োজনীয়তা কতখানি, সে বিষয়ে আলোচনা করার সময়, আমাদেরকে বোঝাতে গিয়ে _ উদাহরণ হিসাবে এই গল্পটির অবতারনা করেছিলেন! আর সেই দিনই প্রথম আমরা এই গল্পের অন্তর্নিহিত অর্থটি যে কি _তা জানতে পারলাম!
গল্পটি আগে ছোট করে বলে নেওয়া যাক।
কোন এক দেশের রাজকন্যাকে, রাক্ষসদের রাজা ধরে নিয়ে গিয়ে রাক্ষসপুরীতে বন্দি করে রেখেছিল। সেখানে সেই রাজকন্যা সোনার পালঙ্কে সবসময় নিদ্রিত থাকতো–কারন তার শিয়রে থাকতো দুটি কাঠি, একটি মরন কাঠি-আর একটি জিয়ন কাঠি! একটি রুপোর কাঠি-আর অন্য কাঠিটি সোনার !!
জিয়নকাঠি টি ওর মাথায় ছুঁইয়ে দিলে রাজকন্যা জেগে উঠত এবং মরনকাঠিটি ছুঁইয়ে দিলেই রাজকন্যা মরার মতো ঘুমিয়ে পড়ত! রাক্ষসপুরীতে থাকতো এক হাজার রাক্ষস-রাক্ষসী। তারা রাজকন্যাকে তাদের প্রাসাদের চিলেকোঠার একটা ঘরে বন্দি করে রেখে, নিজেরা পালা করে পাহারা দিত!
প্রাসাদটির চারিদিকে উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল এবং দেয়ালের বাইরে ছিল পরিখা-কাটা(কৃত্রিম জলাশয়), তাতে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব কুমির ছাড়া থাকতো_যাতে কোন বন্দি ওখান থেকে বেড়োতে না পারে, আবার বাইরে থেকেও যেন কেউ প্রাসাদে ঢুকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে না পারে !!
রাক্ষসরাজার প্রাসাদের মধ্যেই ছিল একটি সরোবর। সেটি ছোট হলেও খুব গভীর! সেই সরোবরের নিচে জলে ডোবানো একটা রুপোর কৌটোর মধ্যে থাকতো রাক্ষস-রাক্ষসীদের সোনার প্রানভোমরা! যদি কেউ একডুবে ঐ সরোবরের তলা থেকে রুপোর কৌটোটি তুলে এনে সোনার ভোমরাটিকে তলোয়ারের এক কোপে কাটতে পারে _তাহলেই একসাথে সব রাক্ষসেরা মারা যাবে এবং রাজকন্যাকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে!
কিন্তু কে করবে এই দুঃসাধ্য কাজ? আছে! সে লোকও আছে __কোন এক অচিনপুরের রাজকুমার! যে নদীতে নাইতে গিয়ে পেয়ে গেল রাজকন্যার মাথার একটি কেশ! আর সেই কেশ পেয়েই কেশবতী কন্যার খোঁজে বেড়িয়ে পড়ল রাজকুমার! তারপরে পাহাড় – জঙ্গল – সাতসমুদ্র তেরোনদী পেড়িয়ে, শত বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে রাজকুমার পৌঁছে গেল রাক্ষসপুরীর দোরগোড়ায়!
পথিমধ্যেই এক জাদুকরী বৃদ্ধার উপকার করায় _সেই মা তাকে জানিয়ে দিয়েছিল রাক্ষসদের প্রানভোমরার হদিস! তাছাড়া সে আরো অনেককে মদত করে আরো কিছু শক্তিলাভ করেছিল! ফলে রাক্ষসপুরীর কাছে পৌঁছেই ঐ রাজকুমার, অবহেলায় কুমীরভর্তি পরিখা ও উঁচু পাঁচিল টপকে একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়ল! সেখানে তাকে কেউ দেখে ফেলার আগেই সে সরোবরের জলে মারল ঝাঁপ! সেখান থেকে এক ডুবে কৌটো সমেত সোনার ভোমরাটিকে তুলে এনে _তার একটা পা ছিঁড়ে দিতেই সব রাক্ষস-রাক্ষসীর একটা করে পা ভেঙে পড়ে গেল! এরপর ভোমরাটার গলা কেটে দিতেই সব রাক্ষস মারা পড়ল!
সব রাক্ষস মারা যাবার পর রাজকুমার সোজা প্রাসাদের চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত রাজকন্যার শিয়রে থাকা সোনার কাঠিটি নাড়িয়ে দিতেই রাজকন্যা ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসল(এই সব রহস্য সেই জাদুকরী বৃদ্ধা আগেই রাজকুমারকে বলে দিয়েছিল)! ঘুম ভেঙে রাক্ষসদের পরিবর্তে এক সুদর্শন তরুণ রাজকুমারকে দেখে রাজকন্যা কি খুশি – কি খুশি!! এরপর দুইয়ে দুইয়ে চার হোতে আর বেশি দেরি হল না! যাই হোক এতসব নানা কান্ডের পর রাজকন্যা উদ্ধার হোল।
এই হোল গল্পটা। এবার আসা যাক _গুরুমহারাজ এই গল্পের কি ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেই কথায়!! [ক্রমশঃ]