[আমরা আগের দিন রুপকথার গল্প পড়েছি। কি করে রাজকুমার রাক্ষসপুরীতে ঢুকে রাক্ষসদের মেরে বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধার করেছিল_তাও দেখেছি। এবার গুরুমহারাজের কাছ থেকে গল্পটির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য শোনা যাক।]
……. গুরুমহারাজ বলতে লাগলেন _”এই গল্পের রাজকন্যা হচ্ছে মানুষের ‘বিবেক’। কামনা বাসনার (রাক্ষস-রাক্ষসী) কবলে পড়ে মানুষের বিবেক প্রসুপ্ত হয়ে যায়।ফলে মায়া এবং মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মানুষ _এটাই যেন রুপোর কাঠির ছোঁওয়ায় রাজকন্যার আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়া! দেখে মনে হচ্ছে মরে গেছে _কিন্তু মরে নি! সাধুসঙ্গ রূপে সোনার কাঠি বা জিওন কাঠির ছোঁওয়ায় আবার সুপ্ত বিবেক জেগে উঠে।
রাক্ষসের(কামনা-বাসনা) কবল থেকে রাজকন্যা (বিবেক) – কে উদ্ধার করতে পারেন একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি বা রাজকুমার (গুরু)! সাধুসঙ্গ, সৎসঙ্গে বিবেকের প্রাথমিক জাগরণ হয় _একথা ঠিক, কিন্তু তাকে parmanantly জাগ্রত করতে হলে সদগুরুর নিকটে গিয়ে সমিৎপাণি হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। তারপর সেই শিক্ষা জীবনে যোজনা করলে তবেই কার্যসিদ্ধি হয় ।।”
গুরুমহারাজ আরও বলতে লাগলেন _” অনেকই আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে _সদগুরু চিনব কি করে? আমি বলি _বোকা! তুই চিনবি কি করে? তোর চেনার ক্ষমতাটা কোথায় তৈরি হোল? তুই এই বিশ্বজগতের কি ই বা চিনিস_আর কতটুকুই বা চিনিস?? কোটি কোটি জনগনের মধ্যে কজনকেই বা চিনিস? আর যাদের চিনিস বলে মনে করিস__সত্যিই কি তাদের চিনিস??
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষ তার স্বভাবের বশে অথবা প্রবৃত্তির তাড়নায় ছুটে বেড়ায়! প্রতিটি মানুষই তো আবিষ্ট!! কামনাবিষ্ট-বাসনাবিষ্ট-মোহাবিষ্ট-মায়াবিষ্ট__আরও কত কিছুতে আবিষ্ট! আবিষ্ট ব্যক্তির ঠিক – বেঠিকের বোধ কোথায়?
ঠিকটি চিনতে হোলে আগে তো মানুষকে আবেশ মুক্ত হোতে হবে! আর তা হোতে পারলে গুরু-ই এসে তখন তোমার হাতটি ধরবেন! তাই সাধু বা গুরু চিনতে হয় না _তিনি চেনা দেন!! তাঁকে ধরা যায় না _তিনি ধরা দেন!!
আর একবার যদি তিনি ধরা দিয়ে দেন__তাহলে কখন যে তুমি তাঁর কাছে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে, কখন যে তুমি তাঁর হয়ে যাবে _তা তুমি নিজেই বুঝতে পারবে না! তোমার সমস্ত বিচার সেখানে ম্লান হয়ে যাবে _তখন তোমার শুধু সমর্পণের ভাব আসবে! আর তোমার সমস্ত ইন্দ্রিয়াদি, রিপু-আদি, সকলকিছু অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে যাবে, মনের অন্তর্মুখীনতা আসবে, সবসময় হৃদয়ে পরম শান্তি বা আনন্দের প্রবাহ চলবে। আর এ সমস্তই হবে চেতনার উত্তরণ এবং বিবেকের জাগরণের ফলে!
কিন্তু মুস্কিলটা কি হয় জানোতো_সাধারন মানুষের ক্ষয়ে আনন্দ, তাইতো সৃষ্টিতে বেদনার অনুভূতি হয়। মহামায়ার জগতে এই লীলা বড়ই বিচিত্র!”
যাইহোক, এখন আবার ফিরে আসি গল্পের কথায়! রাজকন্যার সুপ্ত অবস্থায় আবির্ভাব হয় রাজকুমারের! যে পূর্ব থেকেই জানে যে, জলাশয়ের জলের তলায় কৌটো আছে, যার মধ্যে রয়েছে রাক্ষসকুলের প্রানভোমরা! যাকে এক ডুবে জলের তলা থেকে তুলে আনতে হবে, আর সেটাকে মেরে ফেলতে পারলেই রাজকন্যাকে ঘিরে যে শত-সহস্র রাক্ষস – রাক্ষসী রয়েছে, তারা মরবে এবং রাজকন্যার উদ্ধার হবে!
এই কথাগুলোর তাৎপর্য গুরুমহারাজ যা বলেছিলেন _সেইটা বলা যাক!
এখানে রাজপুত্রই হচ্ছে সদগুরু! যিনি সাধনার গভীরে ডুব দিয়ে ব্রহ্মবিদ্যারূপ সোনার কৌটো লাভ করেছেন! এর ফলে তিনি কামনা-বাসনারূপ রাক্ষসকুলের কবল মুক্ত! তাই তিনিই পারেন অন্য কারো প্রসুপ্ত বিবেকের জাগরণ ঘটাতে।
সাধক যখন ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করেন _তখন তাঁর সহস্রফনাবিশিষ্ট কালনাগিনী অর্থাৎ thousand faculties of mind – এর উপর control আসে।
কামনা বাসনার ক্রিয়া তো মনে__তাই মন control – এ এসে গেলে সাধকের সাধনপথের সমস্ত বাধা _যেমন রিপুর ক্রিয়া, অষ্টপাশের ক্রিয়া ইত্যাদি সবকিছুকে সহজেই অতিক্রম করা যায়।
সদগুরু কামনা-বাসনা মুক্ত _ঋষিস্থিতির মানুষ (অবতার পুরুষেরা এর উর্দ্ধলোকে যাতায়াত করার অধিকারী হোলেও, বেশিরভাগ সময়েই ওনারাও এই স্থিতিতেই থাকেন।)! Ascending এর সাধকেরা সাধনার দ্বারা আজ্ঞাচক্র পর্যন্তই অর্থাৎ ঋষিস্থিতি পর্যন্তই পৌঁছাতে পারেন! কিন্তু অবতার পুরুষেরা(decending) প্রয়োজনে আজ্ঞাচক্র থেকে সহস্রারে যাওয়া আসা করতে পারেন। এটা যেন নৌকার বাইচ খেলা! এই এপার_তো ঐ ওপার!!
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন _’ঈশ্বরের অবতারই সদগুরু হয়ে লীলা করেন।’ এই কথা একদম ঠিক! ঈশ্বরের descending শক্তি বা অবতারেরা মর্তের ভগবান, এঁরাই প্রকৃত গুরু বা সদগুরু!
মানুষের মঙ্গল করার জন্য, সর্বজীবের কল্যাণের জন্য করূনাপরবশ হয়েই তাঁরা শরীরধারন করেন! এঁদের জন্ম হয় না _এঁরা জন্মগ্রহণ করেন!
সুতরাং সাধারণভাবে জন্মানো মানবের কোন যোগ্যতাই নাই এঁদের কোন কাজের সমালোচনা করার!যদি কোথাও কেউ করে _জানবে সেটি একটি আহাম্মক!!
অবতার পুরুষের কখনোই কোন কাজের ভূল হয় না _এঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ জগতের কল্যাণের জন্য!
যাইহোক যে কথা হচ্ছিল _মানুষের জীবনে একবার সদগুরু লাভ হয়ে গেলে আর তার কোন ভয় থাকে না। তখন সে শুধু ‘নির্ভয়’-ই নয় _’অভয়’ হয়। রূপকথার গল্পে রাজপুত্র এসে গেলে যেমন রাজকন্যা উদ্ধার হবেই __ঠিক তেমনি মানবের জীবনে সদগুরু লাভ হলে, তার পূর্নতালাভ নিশ্চয়ই হবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা !!!
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ । [ ক্রমশঃ ]