[পাঁচজন ঋষি শাপগ্রস্থ হয়ে মর্তে শরীর নিলেন! তাদের কেয়ার টেকার হয়ে শরীর নিলেন দেবগুরু বৃহস্পতি! এই জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ছেলেগুলিকে নিয়ে নানা মুস্কিলে পড়েছিলেন তিনি!একটা মরা গরু হাট থেকে এনে গুরুদেবের অনেক টাকা নষ্ট করে ফেলেছিল ওরা! গুরুমা রেগেমেগে ওদেরকে না খেতে দিয়ে ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন! এখন এরপর…..]
……. যেহেতু ওরা originally ঋষি, তাই ওদের তো সব সিদ্ধিই করায়ত্ত! এ জন্মে না হয় শাপগ্রস্থ _কিন্তু তাতে কি? মনোজগতে ক্রিয়া হোতেই প্রতিক্রিয়া!!
ওরা কাঁদছিল আর দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা মারছিল_ হটাৎ করে হাতির মতো বলশালী ছেলেগুলির ধাক্কায়_ দরজার উপরের দিকের চৌকাট টি আলগা হয়ে গেল এবং ঝনঝন্ শব্দে কিছু সোনার মোহর ঝড়ে পড়তে লাগল!!
হয়েছে কি _বর্তমানের ঐ আশ্রমটি কোনসময় ঐ রাজ্যের রাজার গুরুদেবের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। রাজা ইচ্ছে করেই এক কলসী সোনার মোহর দরজার উপরে গাঁথনির সময় রেখে দিয়েছিলেন– যদি গুরুদেবের কোনো প্রয়োজন হয় _ওখান থেকে নিয়ে ব্যবহার করতে পারবেন! কিন্তু গুরুদেবের প্রয়োজন হয় নি, তাই মোহর ওখানেই থেকে গিয়েছিল ! পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ গুরু পরমানন্দ পরম্পরাগত ভাবে সেখানে স্থান পেয়েছিলেন, তিনিও ব্যপারটা জানতেন না__ কিন্তু ঐ বালক রূপী ঋষিদের খানিকটা অজ্ঞাতেই সিদ্ধির প্রয়োগ ঘটে গেল এবং এদের পালন-পোষনের প্রয়োজনে ঐ অর্থ ব্রাহ্মণীর কাজে লেগে গেল_বরং বেশিই পেয়ে গেল !
এইভাবে মাঝে মাঝেই এদের দ্বারা ভালো বা মন্দ বিভিন্ন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে যেত! এ সবের অন্তর্নিহিত কারণ গুরুদেব পরমানন্দ জানতেন কিন্তু যেহেতু প্রায়শই বালকেরা কিছু না কিছু অনর্থ ঘটিয়ে ফেলত, ফলে ব্রাহ্মণী সবসময় মেজাজ ঠিক রাখতে পারতেন না!ওদেরকে মারধর করতেন, অপমান করে বসতেন।
এই রকম ভাবে বার বার লাঞ্ছিত হতে হতে বালক গুলির মধ্যেও একটা জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা-ভাব এসে গেল।
একদিন ব্রাহ্মণী নাড়ু তৈরি করছিলেন আর ছেলেগুলো জুল জুল করে তাকিয়ে ছিল সেই দিকে। ব্রাহ্মণী বুঝলেন___ যে ক’টি নাড়ু তৈরি হয়েছে, সুযোগ পেলেই তা ওরা মুঠো মুঠো করে একবারে খেয়ে নেবে– একটাও রাখবে না! তাই নাড়ু তৈরি শেষ হলে ব্রাহ্মণী ওদের হাতে একটি করে নাড়ু দিয়ে বললেন যে_ বাকী নাড়ু গুলোতে বিষ মেশানো হলো, যে খাবে সে ই মারা যাবে! তারপর ব্রাহ্মণী নিশ্চিন্ত মনে কৌটোটা ঘরে রেখে দিলেন । উনি জানতেন_এই কথা বলে দিলে _ওরা আর চুরি করে খাবে না!
কিন্তু ছেলেগুলির মনোজগতে তখন অন্যরকম ক্রিয়া চলছিল! ওরা যুক্তি করল– গুরুমা যখন বলেছে _ঐ নাড়ুগুলিতে বিষ আছে, তাহলে সেই নাড়ুর কৌটোটা রাত্রে চুরি করে নিয়ে বাইরে গিয়ে জঙ্গলে গিয়ে সবাই মিলে খেয়ে মারা যাবে।তাহলে তাদেরকে নিয়ে আর গুরুদেব এবং গুরুমাকে জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না!
যেমন ভাবা তেমন কাজ! সবাই শুয়ে পড়লে ওরা নাড়ুর কৌটো হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল। হাতির পালের মতো বন-ঝোপ মারাতে মারাতে তারা এক সরোবরের ধারে চলে এল। এবার তারা জলের ধারে বসে সবাই মিলে নাড়ু গুলো ভাগ করে খেয়ে নিল! তারপর সরোবরের জল আঁজলা ভরে খেয়ে ওরা পাঁচজনে গাছতলায় শুয়ে পড়ল আর তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়েও গেল !
সকলের ঘুম ভাঙ্গলো সকাল হলে! ওরা তো জেগে উঠে ভাবলো যে_ওরা মারা গেছে এবং এটা যমরাজের এলাকা(রাতের অন্ধকারে বনে ঢুকেছিল তাই এখানকার জায়গাটি ওদের সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল)! যমরাজের সাথে দেখা করার জন্য তারা গুরুদেবের বাড়ির উল্টো দিকে হেঁটে গভীর জঙ্গলের দিকে চলতে শুরু করল। পথে বনের ফল খায়, ঝরনা বা সরোবর পেলে জল খায় আর হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা পৌঁছে গেল পাশের রাজ্যে। সেখানে সেদিন রাজা- রাণীর রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে চলছে উৎসব! রাজ্যের এক বিখ্যাত নর্তকী কে আনা হয়েছে (এই নর্তকীই হোল স্বর্গের অপ্সরা চিত্রাঙ্গদা, আর ঐ রাজ্যের রাজা দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত!)! সেই সব নিয়ে রাজ্যে সাজো সাজো রব! রাজসভায় যখন নর্তকী এসে পৌঁছাল, মহামায়ার চক্রে ঠিক তখনই এই পাঁচ জন বালক-রূপী ঋষিরাও এসে পৌঁছাল সেখানে! আর সবাই সবাইকে যেই না দেখলো_ অমনি তাদের সবার পূর্ব স্মৃতি মনে পড়ে গেল! তাতেই সবার সব অভিশাপ কেটে গেল এবং সবাই মর্ত্যেলোকের বন্ধন কাটিয়ে ফিরে গেল আপন আপন লোকে!
এই গল্পটা বলার পর গুরুমহারাজ উপস্থিত সকলকে বললেন, এইভাবে মহামায়ার জগতে অনেক সময় “লঘু পাপে – গুরু দণ্ড” হয়ে যায়– আর যার ফল শুধু সাধারণ মানুষই নয়– উচ্চ কোটির সাধু-সন্তদের বা দেব-দেবীদেরকেও ভুগতে হয়। ভুগতে হয় বলছি _কিন্তু ঠিক সেই অর্থে ভোগা নয়, ওনারা স্বেচ্ছায় এইসব ব্যাপারে অংশগ্রহণ করে সমস্যার সমাধান করে দেন।
অবশ্য হয়তো সেই ঘটনার পিছনে কোনো শুভ কারণ নিহিত থাকে– সমকালীন মানুষ বুদ্ধিতে তার ব্যাখ্যা পায় না, কিন্তু উত্তরকালের মানুষ তার সুফল পায়! তখন আবার ঐ ধরনের ঘটনাগুলির নতুন করে মূল্যায়ন হয়!! [ক্রমশঃ]