গুরু মহারাজ একদিন বলেছিলেন এক বিখ্যাত তিব্বতীয় সিদ্ধ যোগী মিলোরাপার কথা ! মিলোরাপা ছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং যে কজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অমিতাভ বুদ্ধের পরে অর্হত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন – ইনি ছিলেন তাদের মধ্যে একজন ৷ গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “মিলোরাপা তিব্বতের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন , ওনার বাবা ছোটবেলায় মারা যান৷ ঐ সমস্ত পাহাড়ি গ্রামগুলির মানুষজন ছিল খুবই গরীব আর গোষ্ঠী সংঘর্ষে দীর্ণ ! মারপিট-খুনোখুনি প্রায় লেগেই থাকতো । মিলোরাপা উন্নত সংস্কারের বালক তাই খুব ছোট বয়সেই কোন বৌদ্ধ যোগীর পাল্লায় পড়ে যান। যোগীবর ওই বালককে নিয়ে যান হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে, সাধন-ভজন করানোর জন্য৷ সেখানে তিনি তার সমস্ত চেলাদের নিয়ে যোগ শিক্ষা দিতেন _ মিলোরাপাও শিখত । কিন্তু মিলোরাপা দলের মধ্যে থেকে শিক্ষা করতে চাইছিলেন না, তিনি চাইছিলেন একা একা সাধনা করে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে ! এদিকে গুরুদেব তার কম বয়স দেখে, তাঁকে একা একা সাধন করতে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না । কিন্তু মিলোরাপা নাছোড়বান্দা ! তাই খানিকটা বিরক্ত হয়ে বা বাধ্য হয়েই গুরুদেব রাজি হয়ে যান ৷
উনি মিলোরাপাকে পাহাড়ের গায়ে এক নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে বলেন _”আগে তুমি এই পাহাড়ের গায়ের পাথর কেটে একটা গুহা বানাও – যে গুহায় তুমি সাধন ভজন করতে পারবে, তারপর আমি তোমাকে সাধন পদ্ধতি শেখাবো!”
লোকালয়ে ফিরে যাওয়ার আগে গুরুদেব তাকে আরও বলে গেলেন যে, গুহা তৈরি হয়ে গেলে মিলোরাপা যেন ওনাকে জানান , তাহলে উনি এসে সেই গুহাতে ওকে প্রকৃত দীক্ষা দিয়ে সাধন করার অনুমতি দেবেন! এই বলে গুরুদেব ওকে প্রাথমিক ভাবে একটা মন্ত্র দান করেন – যে মন্ত্র জপ করতে করতে ও কাজ করতে (গুহা তৈরির কাজ) পারবে। গুরুদেব ওকে আরো একটা কথা বলেছিলেন যে ও এই গুহার প্রস্তুত করাকালীন এই স্থানের চারিদিকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই ও যেন থাকে, গন্ডীর বাইরে গেলেই _disqualify!!! গুরুদেব আর একটা কথা ওকে বলেছিলেন যে, সেই বিশেষ গন্ডীর মধ্যেই সে যা আহার্য পাবে – তাই খাবে! কোন কারনে(খাদ্য বা নিরাপত্তা)-ই সে যেন ওই নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে না যায় !
মিলোরাপা গুরুর আজ্ঞা অনুসারে – ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে পাহাড়ের পাথর কেটে কেটে গুহা প্রস্তুত করতে শুরু করলেন এবং ওই স্থানের পাশাপাশি স্থানে যা শাকপাতা, ফলমূল এবং ঝরনার জল পাওয়া যায় তাই দিয়েই আহার্য প্রস্তুত করে খেয়ে জীবন ধারণ করতেন ।
নিরলস ভাবে কাজ করেও তাঁর দুই তিন মাস লেগে গেল _পাথর কেটে কেটে একটা মানুষ থাকার মত একটা গুহা তৈরি করতে। এদিকে হাতুড়ি চালিয়ে চালিয়ে তাঁর হাতের অবস্থা খুবই খারাপ । ফোস্কা পড়ে গেছে – দুটো হাতেই! গুরুর কাছে খবর গেল – তিনি এলেন , এসে ভালো করে গুহাটি দেখলেন কিন্তু বললেন – ” এই গুহাটি ঠিক মতো হয়নি , এটি ভেঙে ফেলো এবং পাশের পাথরের দেওয়ালে আর একটি গুহা বানাও।” এত কষ্ট করে গুহা বানিয়েও গুরুর মন-পসন্দ হলো না – আবার বানাতে হবে !!!!!
কি আর করা যায় _ গুরু আজ্ঞা তো লঙ্ঘন করা যায় না , তাই মিলোরাপা আবার শুরু করে দিল নতুন গুহা তৈরির কাজ !
গুরু-আজ্ঞা রক্ষার জন্য দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা পাথর কেটে যেতে লাগলো সেই মহাসাধক! এবারের গুহা তৈরীর কাজ কিন্তু আরও তাড়াতাড়ি শেষ হোল – গুহাটি আগের থেকে প্রশস্তও হল । আবার গুরুদেব এলেন – কিন্তু আবার সেই একই ফল হোল! গুরুদেব এসে এই নতুন গুহাটিকেও Reject করলেন এবং পাশে আর একটা গুহা বানাতে বললেন!
ফলে শিষ্য আবার গুরু আদেশে নতুন গুহা তৈরির কাজ শুরু করলো ! এইভাবে মিলোরাপাকে দিয়ে পরপর সাতটি (!) গুহা নির্মাণ করিয়েছিলেন গুরুদেব ! প্রতিবার অত কষ্ট করে গুহা তৈরি সম্পন্ন করার পর – যখনই গুরু সেটি Reject করতেন__ তাতে শিষ্য দুঃখিত নিশ্চয়ই হতেন , কিন্তু কখনও গুরুবাক্যে কোন বিরক্তি বা কোন সংশয় প্রকাশ করেননি । নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে একাগ্রচিত্তে কাজ করে যেতেন এবং গুরুদত্ত বীজমন্ত্র জপ করতেন ৷ এ ছাড়াও আর একটি বিশেষ কাজ উনি করেছিলেন গুরু আজ্ঞায় – সেটি হল ঐ গুহার ধারেপাশের শাকপাতা সিদ্ধ করে খাওয়া ! ঐ গাছগুলির বেশীরভাগই ছিল হিমালয়ান বিছুটি গাছ ! বিছুটি গাছ এমনিতে বিষাক্ত-কুটকুটি , শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে ! কিন্তু ঐ গাছ জলে সিদ্ধ করে ছেঁকে খেলে কোন অসুবিধা হয় না ! [এছাড়াও ঐ হিমালয়ান বিছুটির আরও একটি গুন রয়েছে – এটি নিয়মিত খেলে শরীরের সমস্ত ক্ষয় বন্ধ হয়ে যায় এবং নতুন কোষ-কলা জন্মাতে শুরু করে! ফলে বয়সের বৃদ্ধি না হয়ে যেন শরীরের বয়স কমে যায়!!!]
যাইহোক, সপ্তম গুহাটি নির্মাণ হবার পর মিলোরাপাকে গুরুদেব প্রকৃত বীজ মন্ত্র দিলেন এবং সাধন পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়ে ঐ নতুন গুহাটির মধ্যে বসিয়ে দিলেন! শিষ্য শুধু গুরুকে একটা জিজ্ঞাসা করেছিল _”এবার থেকে আমি কি মনে মনে ভগবান বুদ্ধের মূর্তি চিন্তা করব ?” গুরুদেব সন্মত হয়েছিলেন কিন্তু শিষ্য কিছুতেই বুদ্ধকে মনে আনতে পারছিলেন না!
তাহলে কি করা যায় ? সেই সময় ওখান দিয়ে একটা ‘ইয়াক্’ বা চমরি গরু চরছিল – গুরুদেব ওইটা দেখিয়ে বললেন , ” তুই ওই ‘ইয়াক’-এর চিন্তা কর্ ।” এই বলে গুরুদেব চলে গেলেন এবং শিষ্য গুরু-আজ্ঞা অনুযায়ী ইয়াকের চিন্তা করতে করতেই ধ্যানস্থ হয়ে গেলেন।
এরপর দীর্ঘ ১২ (বারো) বছর কেটে গেছে – গুরুদেব কোন কর্মোপলক্ষে বহুদূর চলে গিয়েছিলেন ৷ সব কাজ সেরে উনি ফিরতে ফিরতেই ওই দীর্ঘ সময় লেগে গেছিল ৷ ফিরে এসে গুরুদেব মিলোরাপার খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন যে, সে সেই গুহাতেই সদা সর্বদা ধ্যানস্থ হয়ে বসে থাকে ! প্রথম প্রথম কিছুদিন দু-একবার গুহা থেকে বের হতো কিন্তু বর্তমানে তাও বেরোয় না !
গুরুদেব বুঝতে পারলেন মিলোরাপার সাধনায় সিদ্ধ হবার সময় হয়ে গেছে। দ্রুতপদে গুরুদেব গুহার কাছে গিয়ে ডাকতে লাগলেন – ” মিলোরাপা ! তুমি বাইরে বেরিয়ে এসো ! আমি তোমার গুরুদেব ! আমি ডাকছি – তুমি বেরিয়ে এসো !” গুরুদেবের আহ্বানে শিষ্যের ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেল – সে ভিতরে থেকেই বলে উঠলো – “গুরুদেব ! আমি আপনার আদেশ শুনতে পাচ্ছি কিন্তু গুহা থেকে বেরোতে পারছি না যে !” গুরুদেব বললেন – “কেন পারছ না ? আসন থেকে উঠে সোজা বেরিয়ে চলে এসো ৷” শিষ্য বলল – “গুরুদেব ! আমি তো উঠতেই পারছি না – আমার মাথার বড় বড় শিং-গুলো যে গুহার দেওয়ালে আটকে যাচ্ছে !”
গুরুদেব বুঝতে পারলেন যে , শিষ্য সিদ্ধ হয়ে গেছে! ১২ বছর আগে আসনে বসার আগে ওই যে তিনি শিষ্যকে ‘ইয়াক্’-এর চিন্তা করতে বলেছিলেন – শিষ্য সেই চিন্তায় একাগ্র হওয়ার ফলে সে তদ্রুপ প্রাপ্ত হয়ে গেছে – সারূপ্য লাভ হয়েছে !
গুরুদেব সব বুঝে ভেতরে গিয়ে – অস্ত্র হাতে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বললেন – “তোমার সিং কেটে দিলাম , এবার বাইরে চলো ৷” এই বলে তিনি শিষ্যকে বাইরে নিয়ে এলেন । শিষ্য বাইরে বেরোতেই গুরুদেবের অন্যান্য শিষ্যরা তো মিলোরাপাকে দেখে অবাক্ ! মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সে মিলোরাপা গুহায় সাধনা করতে বসেছিল – তারপর আরো ১৫/১৬ বছর কেটে গেছে (১২-বছর সাধনা এবং গুহা বানাতে আরো ৩/৪-বছর)– অর্থাৎ মিলোরাপার বয়স হওয়া উচিত ৩০/৩২ বছর। কিন্তু মিলোরাপাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যে কে সেই! সেই ১৫/১৬ বছরের কিশোর ! ব্যাপারটা কি !!
মিলোরাপার জীবনী মূলক গ্রন্থে এর উত্তর না পাওয়া গেলেও গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ এর উত্তর আমাদের কে বলেছিলেন ! উনি বলেছিলেন যে , হিমালয়ান বিছুটিতে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যাতে শরীরের DNA-এর পরিমাণ কমে যায় এবং RNA-এর পরিমাণ বেড়ে যায় । ফলে শরীরে ক্ষয় তো হয়ই না – বরং সঞ্চয় হয় ! এইজন্যেই মিলোরাপার বয়স না বেড়ে গিয়ে কমে গিয়েছিল ।৷ উনি আরও বলেছিলেন _’ইউরোপের বিভিন্ন দেশ (বিশেষত জার্মানি) ঐ ধরণের গুল্ম নিয়ে খুবই গবেষণা করছে _এর ফলে হয়তো আগামী দিনে আরো রহস্য উন্মোচিত হবে! [ক্রমশঃ]