গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম আশ্রমে আমাদেরকে তিব্বতের বৌদ্ধ লামা মহাসাধক মিলোরাপার জীবনের কিছু কিছু কথা বলেছিলেন ৷ আগের দিন কিছুটা বলা হয়েছে, এখন আর একটি কাহিনী এখানে বলা হচ্ছে ! সুকঠোর সাধনায় সিদ্ধ হবার পর মিলোরাপা গুরুর নির্দেশে “বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়”– কর্মে নিয়োজিত হলেন । কিন্তু অদৃশ্যলোক থেকে বিধাতা পুরুষ একটু অন্যরকম ভেবে রেখেছিলেন, ফলে একটি এমন বিশেষ ঘটনা ঘটে গিয়েছিল – যেটা তিব্বতের ইতিহাসে খুবই অভূতপূর্ব ঘটনা ছিল ! ঘটনাটি কী ঘটেছিল সেইটা বলা যাক্ !
মিলোরাপার যে গ্রামে জন্ম হয়েছিল – সেখানে যে কোন কারনেই হোক না কেন ছোটখাটো দু একটা সংঘর্ষ লেগেই থাকত । প্রধানত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা এইরকম কিছুর জন্য প্রায়ই মারামারি হতো , এমনকি খুনখারাপিও হত ! মিলোরাপা গুরুর নির্দেশে অন্যত্র থাকলেও ওর মা গ্রামেই থাকতেন। একদিন ওই ধরনের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে সেই গ্রামের আরো দু-চারজনের সাথে মিলোরাপার মা-কেও খুন হতে হোল !
লোকালয় থেকে দূরে কোন আশ্রমে থাকা মিলোরাপার কাছে সেই দুঃসংবাদ পৌঁছাতে দেরি হলোনা ! খবর পেয়ে দৌড়ে এলেন মিলোরাপা নিজের গ্রামে – যেখানে মৃত মা মাটিতে পড়ে রয়েছে সেখানে !
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” সাধুই হও আর সন্ন্যাসীই হও – মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য কোনদিন বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় ! মায়ের ব্যাথায় যদি সন্তান ব্যথিত না হয় – তাহলে সেই সন্তানের কি মূল্য ? ব্রহ্মজ্ঞান পরে – আগে কান্ডজ্ঞান ! শুধুমাত্র যদি সন্তানের আত্মজ্ঞান লাভ হয় অর্থাৎ পূর্ণতা লাভ হয় তাহলে ওই মহাসাধকের (সন্তানের) মধ্যে এক বিশেষ ক্ষমতা আসে ৷ যার দ্বারা উনি পিতা-মাতাসহ পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয়কুলের উর্দ্ধতন সাত পুরুষের সমস্ত সদস্যদের মুক্তি দিতে পারেন !
যাইহোক, মিলোরাপা সেখানে পৌঁছে যখন দেখলেন তাঁর মৃত মা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন – তখন তিনি প্রচন্ড শোকে ও দুঃখে কেমন যেন হয়ে গেলেন । মৃত মায়ের মাথাটি নিজের কোলে তুলে নিয়ে তার চোখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন ! চেয়ে রইলেন তো চেয়েই রইলেন ! কারও কোন অনুরোধ আর তার কর্ণে প্রবেশ করলো না ! মায়ের মমতার কথা স্মরণ করতে করতে এই মহাযোগীর মনোজগতে এক তীব্র ঝড় উঠলো – “তাঁর সহজ সরল গর্ভধারিনীর এই পরিণতি ?”
মহাসাধক মহাযোগী মিলোরাপার সমস্ত সিদ্ধিই করায়ত্ত ছিল – ফলে তাঁর অন্তঃপ্রকৃতি বিক্ষুব্ধ হওয়ার সাথে সাথেই ওই অঞ্চলের বহিঃপ্রকৃতিতেও তার প্রভাব পড়ল! তিব্বতের দীর্ঘকালের ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি – তাই সেদিন ঘটে গিয়েছিল ! শুরু হয়ে গেল তীব্র ঘূর্ণিঝড় ! এমন সেই ঝড়ের তীব্রতা যে ওই অঞ্চলের সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যেতে থাকল ! মিলোরাপার অন্তঃর্জগতের বেদনা যত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল – বাইরের ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ তত বাড়তে থাকল !
এদিকে এই অলৌকিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ব্যাপারটি হিমালয়ে থাকা মহা মহা যোগীদের দৃষ্টি এড়ালো না ! তাঁরা জ্ঞানচক্ষুতে ব্যাপারটি দেখে নিয়ে একটা ছোটখাটো মিটিং সেরে নিলেন – তারপর মিলোরাপার গুরুকে নির্দেশ দিলেন যেন তিনি মিলোরাপার মনোজগতের এই ক্ষোভ দূর করতে এখনই সেখানে হাজির হন ৷ গুরুকুলের নির্দেশে মিলোরাপার গুরুদেব পৌঁছে গেলেন সেই গ্রামে, যেখানে মিলোরাপা মৃতা মায়ের চোখে চোখ রেখে ত্রাটক ক্রিয়ায় নিবদ্ধ হয়ে রয়েছেন!
গুরুদেব শিষ্যের পাশে বসে তাঁর হাত থেকে ওর মাকে সরিয়ে নিতেই মিলোরাপার ত্রাটক ক্রিয়াটি কেটে গেল! সাধারণ অবস্থায় ফিরে এলেন মিলোরাপা!গুরুদেবকে সামনে দেখতে পেয়ে – মিলোরাপা সাথে সাথে গুরুদেবকে প্রণাম ও শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন ৷ তখন গুরুদেব ওকে সবকিছু বোঝালেন এবং যাতে তাঁর মন থেকে শোক বিনষ্ট হয় _তার উপদেশ দিলেন।
গুরুদেবের কথায় শান্ত হয়ে গেল মিলোরাপা! আর কি আশ্চর্য ! প্রায় সাথে সাথেই বাইরের প্রকৃতির চরম অশান্ত ভাব যেন মুহুর্তের মধ্যে কেটে গেল ! মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য হেসে উঠলো ৷ গুরুদেব মিলোরাপাকে প্রকৃতিস্থ করে – বাইরের প্রকৃতির বিপর্যয়ের দৃশ্য দেখিয়ে বললেন – ” দ্যাখো , তুমি এক্ষুনি কি কান্ড করতে চলেছিলে ! কত মানুষ মারা যেতে পারতো – কত ক্ষয়ক্ষতি হতো – তার কি ইয়ত্তা আছে ! শোক সংবরণ কর ৷ আর শান্তিপূর্ণভাবে মায়ের শেষকৃত্যের আয়োজন কর ।”
গুরুর উপস্থিতিতে এরপর মায়ের সমস্ত শেষকৃত্যের আয়োজন করলেন এবং সবকিছু সমাপনান্তে আবার ফিরে গেলেন তাঁর নির্দিষ্ট সাধনস্থলে বা কর্মস্থলে ।৷ [ক্রমশঃ]